সাংবাদিকতা ও সম্পাদনায় অনন্য কাজী নজরুল ইসলাম

ধূমকেতু পত্রিকার ১ম সংখ্যার প্রচ্ছদ

বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের সাহিত্য ও সংগীতে যেমন ছিলো অবাধ বিচরণ ঠিক তেমনি সাংবাদিকতা ও পত্রিকার সম্পাদনাতেও তিনি ছিলেন অগ্রগামী। মূলত সমকালীন রাজনীতি সচেতনতা থেকেই তিনি সাংবাদিকতায় এসেছিলেন যা তাঁর লেখা সাহিত্য ও সম্পাদকীয়তে প্রকাশ পায়। তিনি তাঁর রাজনৈতিক মতাদর্শকে জোরালোভাবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্যই সাংবাদিকতা করেছিলেন। তাঁর সম্পাদিত পত্রিকাগুলোতে এর বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। যে বিদ্রোহী সত্ত্বার পরিচয় আমরা নজরুলের লেখায় পাই সেটা তাঁর সাংবাদিক জীবনেও প্রবল ছিলো। তাঁর সকল সাহিত্য ও শিল্পকর্মেও রাজনৈতিক মননেরও বাঙালি জাতীয়তা বোধের প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। গবেষক ড. ইসরাইল খান ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন, “নজরুলের সাংবাদিকতা ও সাহিত্যসাধনার মূল উদ্দেশ্যই ছিলো রাজনীতি করা। তাই রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে তিনি কখনও বিচ্যুত হননি। রাজনীতির মাধ্যমে তিনি সমাজ পরিবর্তন, উন্নয়ন ও নবজাগরণ ঘটাতে চেয়েছিলেন। নজরুল যখন ‘নবযুগ’ প্রকাশের ইচ্ছে ব্যক্ত করলেন তখন রাজনীতি করবেন কিনা এই প্রশ্নের জবাবে মুজফফ্‌র আহমদকে বলেছিলেন, তাই যদি না করি তবে ফৌজে গিয়েছিলাম কিসের জন্য? রাজনীতি করবো তবে সাহিত্যের মাধ্যমে। তাই মুজফফ্‌র আহমদ তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছেন, ‘তিনি করতে চাইলেন রাজনীতিক সাহিত্য।’”

অবিভক্ত বাংলার বেশ কয়েকটি উল্লেখযোগ্য পত্রিকার সম্পাদনা করেছেন বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। নজরুলের সম্পাদিত পত্রিকার মধ্যে উল্লেখযোগ্য পত্রিকা নবযুগ, ধুমকেতু, লাঙল (পরবর্তীকালে গণবাণী নামে প্রকাশিত)। পত্রিকাগুলো বাংলা সংবাদপত্রের ইতিহাসে উল্লেখযোগ্য স্থান অধিকার করে রয়েছে। সাহিত্য, সমকালীন রাজনীতি, বাঙালি জাতীয়তাবাদ, ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের মুখপত্র হয়ে উঠেছিলো কাজী নজরুল সম্পাদিত পত্রিকাগুলো। এছাড়াও সাংবাদিক হিসেবে চাকরী করেছেন গণবাণী, সেবক, সওগাত ও নবযুগ-এ (১৯৪১)।

ধূমকেতুর ১ম সংখ্যায় ছাপা হয় কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও অন্যান্য লেখকদের আশীর্বাণী

সাংবাদিকতায় অনন্য কাজী নজরুল

অত্যন্ত আধুনিক ও অগ্রগামী চিন্তাধারার প্রতিফলন নজরুলের সম্পাদিত পত্রিকাগুলোর মধ্যে দেখতে পাওয়া যায়। নজরুলের সাংবাদিকতা ও সম্পাদিত পত্রিকাগুলো নিয়ে ভয়েস অফ আমেরিকা কথা বলে কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক এ এফ এম হায়াতুল্লাহর সঙ্গে। তিনি ভয়েস অফ আমেরিকাকে এ প্রসঙ্গে বলেন, “জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামকে মুসলমান সাংবাদিকদের মধ্যে আধুনিক সাংবাদিকতার পথিকৃত বলা যায়। কারণ অবিভক্ত বাংলায় আরো অনেক মুসলমান ব্যক্তি ছিলেন যারা সাংবাদিকতা ও পত্রিকা সম্পাদনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। যেমন মীর মশাররফ হোসেন, মাওলানা আকরাম খাঁ, শেখ আব্দুর রহিম প্রমুখ। কিন্তু কাজী নজরুল ইসলামের সাংবাদিকতার বৈশিষ্ট্য ছিলো, তিনি সাম্যবাদী দর্শন দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন। যেমন তাঁর লাঙল পত্রিকায় ম্যাক্সিম গোর্কীর ‘মা’ উপন্যাস, যা কিনা সমাজতান্ত্রিক ভিত্তির উপর রচিত তার অনুবাদ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হতো। এছাড়া নজরুল পত্রিকার অনেক সংবাদের শিরোনাম দিতেন কবিতার লাইন উদ্ধৃত করে। বিশেষ করে রবীন্দ্রনাথের অনেক গান ও কবিতা থেকে তিনি উদ্ধৃত করেছেন। যেমন: রবীন্দ্রনাথের একটি গানের লাইন, ‘তোমারই গেহে, পালিছ স্নেহে/আমি ধন্য ধন্য হে’ সেখান থেকে নজরুল তাঁর নিজের মতো করে একটি সংবাদের শিরোনাম করলেন, ‘তোমারই জেলে, পালিছ ছেলে/আমি ধন্য ধন্য হে’। তেমনি তাঁর সম্পাদকীয়র ধারা ভিন্ন ছিলো এবং এগুলোর ভাষাও অত্যন্ত তেজস্বী ও বিপ্লবী ছিলো।”

এ এফ এম হায়াতুল্লাহ আরো বলেন, “নজরুল চারটি পত্রিকার সম্পাদনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন এবং এই পত্রিকাগুলো সবগুলোর নাম বাংলা ভাষায় রাখা। সেসময় মুসলমান কবি সাহিত্যিক সাংবাদিকরা কোনো পত্রিকার সম্পাদনা করলে সেগুলোর নাম সাধারণত আরবি অথবা ফারসি হতো, যেমন সওগাত, আজাদ, মোহাম্মাদী ইত্যাদি।”

নজরুলের ভিন্ন ধারার সম্পাদকীয় স্টাইলের প্রভাব দেখা যায় ‘ধূমকেতু’ পত্রিকার ক্ষেত্রে। ধূমকেতুর অষ্টম সংখ্যা থেকে সম্পাদক শব্দটির পরিবর্তে ‘সারথি’ শব্দটি ব্যবহৃত হওয়া শুরু হল। ধূমকেতুর সারথি কাজী নজরুল ইসলাম। পত্রিকার সম্পাদককে সারথি হিসেবে চিহ্নিত করা নজরুলের একান্তই নিজস্ব ধরণ। বাংলা সংবাদপত্র বা পত্রিকার ক্ষেত্রে নজরুলের ‘ধূমকেতু’র আগে বা পরে এই ধরনের ব্যবহার আর কোথাও দেখা যায়নি।

সম্পাদক হিসেবে সাংবাদিক জীবনের শুরু

‘নবযুগ’ দিয়েই কবি কাজী নজরুলের সাংবাদিকতা জীবন শুরু হয় আবার পরবর্তীকালেও ‘নবযুগ’ দিয়েই তাঁর সংবাদিকতার পরিসমাপ্তি ঘটে। সান্ধ্য দৈনিক ‘নবযুগ’-এর প্রথম প্রকাশ ১৯২০ সালের ১২ জুলাই। এটি ছিলো পত্রিকার সাইজ ২০” X ২৬”, ১ শিট, মূল্য ছিলো ১ পয়সা। প্রকাশ হতো ৬ টার্নার স্ট্রিট, কলকাতা থেকে। সে সময় নজরুল সেনাবাহিনী থেকে কলকাতায় ফিরেছেন। তিনি কমরেড মুজাফফ্‌র আহমদ সঙ্গে পত্রিকা বের করতে উৎসাহী হন। কিন্তু যেহেতু তাঁদের একটি দৈনিক পত্রিকা চালানোর মতো আর্থিক সঙ্গতি ছিলো না তাই তাঁরা শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের শরণাপন্ন হন। ফজলুল হক রাজী হন, এক হাজার টাকা জামানত প্রদান করেন। এভাবে ‘দৈনিক নবযুগ’ সান্ধ্য দৈনিক পত্রিকা হিসেবে বের হয়। পত্রিকাটি মুজফফ্‌র আহমদ ও কাজী নজরুল ইসলাম যৌথভাবে সম্পাদনার দায়িত্বে ছিলেন। এ প্রসঙ্গে গবেষক ড. ইসরাইল খান বলেন, “মুজফফ্‌র আহমদ ‘বঙ্গীয় মুসলমান সমিতি’ এবং বঙ্গীয় মুসলমান সমিতি পত্রিকা’র প্রতিষ্ঠাতা। কলকাতায় ১৯১৫ সাল থেকে এ সমিতি শুরু হয়। তখন বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির কার্যালয়ে মুজফফ্‌র আহমদের সঙ্গে নজরুলের প্রথম পরিচয়। বয়সে নজরুলের চেয়ে মুজফফ্‌র দশ-বারো বছরের বড় হলেও তখন থেকেই দুজনের বন্ধুত্ব। সারাজীবনে তাঁরা দুজন দুজনকে শ্রদ্ধা করে গেছেন।”

উল্লেখ্য, যেহেতু তখন ইংরেজি দৈনিকগুলো সকালে বের হতো, বাংলা খবরের কাগজগুলো তাই সন্ধ্যায় বের করা হতো। ফলে সকালের কাগজের নির্বাচিত সংবাদ বাংলা কাগজে অনুবাদ করে পুনঃপরিবেশন করা হতো। মুজফফ্‌র আহমদ তাঁর ‘কাজী নজরুল ইসলাম: স্মৃতিকথা’ গ্রন্থে লিখেছেন, “নজরুল ইসলাম কোনো দিন দৈনিক কাগজের অফিসে ঢোকেনি। তবু সে বড়ো বড়ো সংবাদগুলি পড়ে সেগুলিকে খুব সংক্ষিপ্ত করে নিজের ভাষায় লিখে ফেলতে লাগলো। তা না হলে কাগজে সংবাদের স্থান হয় না। নজরুলকে বড়ো বড়ো সংবাদ সংক্ষেপণ করতে দেখে আমরা আশ্চর্য হয়ে যেতাম। ঝানু সাংবাদিকরাও এ কৌশল আয়ত্ত করতে হিমশিম খেয়ে যান। তার পরে নজরুলের দেয়া হেডিংয়ের জন্যেও ‘নবযুগ’ জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল।”

কাগজের নীতির অন্তর্ভুক্ত ছিল কৃষক ও শ্রমিকদের কথা লেখা। জনগণের সমস্যাবলীর দিকে পত্রিকাটির কড়া দৃষ্টি ছিল। তাই বেশ চড়া মেজাজের লেখা প্রকাশিত হতো ‘নবযুগ’ কাগজে। লেখাগুলোর সুর ছিল প্রবল ব্রিটিশ সাম্রাজ্য বিরোধী এবং আক্রমনাত্মক। এ ধরণের লেখার জন্য নবযুগকে বেশ কয়েকবার তখনকার সরকার কর্তৃক সতর্ক করা হয়েছিল। পত্রিকার সম্পাদকীয় কলামে কবি কাজী নজরুল ইসলামের জ্বালাময়ী ও আবেগপূর্ণ প্রবন্ধ নিয়মিত প্রকাশিত হতে থাকে। উল্লেখযোগ্য প্রবন্ধগুলো ছিল, ‘ডায়ারের স্মৃতিস্তম্ভ’, ‘গেছে দেশ দুঃখ নাই, আবার তোরা মানুষ হ!’, ‘মুহাজিরিন হত্যার জন্য দায়ী কে’, ইত্যাদি।

১৯২০ সালে সারাদেশে তখন শ্রমিকদের ধর্মঘট চলছিলো। ঠিক সেসময় নজরুলের ‘মুহাজিরিন হত্যার জন্য দায়ী কে’ প্রবন্ধটি প্রকাশ হওয়ায় কবি কাজী নজরুল ইসলাম এবং নবযুগ পত্রিকাটিকে ব্রিটিশ সরকারের রোষানলে পড়তে হয়, জামানতের টাকাও বাজেয়াপ্ত করা হয়। জরিমানা দিয়ে নতুন করে সাহিত্যিক মোহাম্মদ ওয়াজেদ আলীর নামে ডিক্লারেশন নেয়া হয়। জ্বালাময়ী লেখা নিয়ে শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের সঙ্গে মতবিরোধের কারণে ১৯২০ সালের ডিসেম্বরে মাত্র সাত মাস কাজ করার পর নজরুল ‘নবযুগ’ ছেড়ে চলে যান। এরপর ১৯২১ সালে জানুয়ারি মাসে ‘নবযুগ’ পত্রিকার প্রকাশ বন্ধ হয়ে যায়।

দৈনিক সেবক-এ চাকরি ও একজন আপোষহীন সাংবাদিক

নবযুগ ছেড়ে আসার পর কাজী নজরুল ইসলাম বেশ কিছুদিন কুমিল্লায় ছিলেন। সেখানে বসে তিনি তাঁর সাহিত্য রচনায় মন দেন। চার-পাঁচ মাস পর তিনি আবার কলকাতায় চলে আসেন এবং ‘দৈনিক সেবক’ পত্রিকায় যোগদান করেন। এ পত্রিকার সত্ত্বাধিকারী ছিলেন মাওলানা আকরম খাঁ। ১৯২১ সালে গান্ধীজির ডাকে শুরু হওয়া অসহযোগ আন্দোলনের সময়েই ডিসেম্বরের ১ তারিখে ‘সেবক’ পত্রিকার প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হয়। কিন্তু ডিসেম্বরের ১০ তারিখ 'অগ্রসর' শীর্ষক সরকার-বিরোধী সম্পাদকীয় প্রকাশ করায় সরকার কর্তৃক পত্রিকাটি নিষিদ্ধ হয়। এই সম্পাদকীয় লেখার অজুহাতে একই দিনে সরকার মাওলানা আকরাম খাঁকে ভারতীয় দণ্ডবিধি ১২৪-ধারায় গ্রেপ্তার করে ।

কিছুদিন পর ‘দৈনিক সেবক’-এর ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা উঠে গেলে পুনরায় ‘দৈনিক সেবক’ প্রকাশ করা হয় এবং পত্রিকার জনপ্রিয়তা ফিরিয়ে আনার জন্য কাজী নজরুল ইসলাম, আবুল কালাম শামসুদ্দীন প্রমুখকে যুক্ত করা হয়। ক্রমে প্রচার সংখ্যাও বাড়ে। নজরুল এ পত্রিকায় একশত টাকার বেতনে চাকরী করতেন। যেহেতু তিনি লেখার ব্যাপারে স্বাধীনচেতা ছিলেন তাই একটি ঘটনার পরে নজরুল ‘সেবক’ পত্রিকাটি ছেড়ে দেন। কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের মৃত্যুর পর তাঁর স্মরণে নজরুল একটি সম্পাদকীয় লেখেন। ওই পত্রিকায় কর্মরত মোহাম্মদ ওয়াজেদ আলী ও আবুল কালাম শামসুদ্দীন এই রচনাটি নিজেদের মতো পরিমার্জিত করে প্রকাশ করেন কারণ তাঁদের মনে হয়েছিলো লেখাটিতে ‘হিন্দুয়ানি’ শব্দ বেশি। এতে স্বাধীনচেতা নজরুল অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হন এবং ডাকযোগে পদত্যাগ পত্র পাঠান। এর ভিতর দিয়ে নজরুলের সাথে ‘সেবক’ পত্রিকার সম্পর্ক ছেদ হয়। এ প্রসঙ্গে ড. ইসরাইল খান বলেন, “এখানে নজরুল তাঁর আপোষহীনতার পরিচয় দিয়েছেন। সেসময় একশত টাকা বেতনের একটি চাকরী এরকম একটি কারণে ছেড়ে দেয়ার মতো দৃঢ়তা দেখানোর শক্তি একমাত্র নজরুলেরই ছিলো। তিনি তাঁর চিন্তাধারা ও লেখার ক্ষেত্রে একটুকু ছাড় দিতেন না।”

যতদিন অসহযোগ আন্দোলনের তীব্রতা ও উত্তেজনা ছিলো ততদিন পত্রিকাটির চাহিদা ছিলো। ১৯২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে মহাত্মা গান্ধী আন্দোলন প্রত্যাহার করে নিলে পত্রিকাটি ক্রমশ জনপ্রিয়তা হারায়। অবশেষে ১৯২২ সালের আগস্ট কিংবা সেপ্টেম্বর মাসে ‘দৈনিক সেবক’-এর প্রকাশনা বন্ধ হয়।

ধূমকেতুর আগমন

“আমি যুগে যুগে আসি, আসিয়াছি পুন: মহাবিপ্লব হেতু

এই স্রষ্টার শনি মহাকাল-ধূমকেতু!” (ধূমকেতু/ কাজী নজরুল ইসলাম)

১৯২২ সালের আগস্ট মাসে কাজী নজরুল ইসলামের সম্পাদনায় আত্মপ্রকাশ করে ‘ধূমকেতু’ পত্রিকা। ঐতিহাসিক দিক থেকে এ পত্রিকাটি ভারতবর্ষের এক অমূল্য দলিল। পত্রিকাটি অর্ধ-সাপ্তাহিক ছিলো অর্থাৎ সপ্তাহে দুবার প্রকাশিত হতো। নজরুল নিজে তাঁর কাগজের নামকরণ করেছিলেন। পত্রিকাটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯২২ সালের ১২ আগস্ট মতান্তরে ১১ আগস্ট। ২০২২ সালে ‘ধূমকেতু’ পত্রিকার একশত বছর পূর্ণ হয়েছে। কমরেড মুজফফর আহমেদ ও কবি কাজী নজরুল দুজনেই স্বাধীনভাবে রাজনৈতিক বক্তব্য প্রচারের লক্ষ্যে এই অর্ধ সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশ করেন। পত্রিকা প্রকাশক ছিলেন আফজাল-উল হক। ‘ধূমকেতু’র ঠিকানা ছিল ৩২ কলেজ স্কোয়্যার। ছাপা হয় ৭৯ বলরাম দে স্ট্রিটের মেটকাফ প্রেস থেকে। পৃষ্ঠা সংখ্যা ছিলো ৮। সাইজ: ক্রাউন ফলিও। প্রতি সংখ্যার মূল্য ১ আনা, বার্ষিক গ্রাহক চাঁদা ছিল ৫ টাকা। পত্রিকার ৭ম সংখ্যা পর্যন্ত কাজী নজরুল ইসলাম স্বনামে সম্পাদক হিসেবে যুক্ত ছিলেন। ‘ধূমকেতু’ পত্রিকার প্রকাশ লগ্নে নজরুল, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছ থেকে আশীর্বাণী সংগ্রহ করেছিলেন যা পত্রিকার ৬ষ্ঠ সংখ্যা পর্যন্ত প্রথম পৃষ্ঠায় এবং ৭ম সংখ্যা থেকে তৃতীয় পৃষ্ঠায় ছাপা হতে থাকে। রবীন্দ্রনাথের হাতের লেখার হুবহু প্রতিলিপি হিসেবে এই আশীর্বাণী প্রকাশিত হতো।

ধূমকেতুর ১ম সংখ্যায় কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দেয়া আশীর্বাানী

“কাজী নজরুল ইসলাম কল্যাণীয়েষু

আয় চলে আয় রে ধূমকেতু,

আঁধারে বাঁধ্ অগ্নিসেতু,

দুর্দ্দিনের এই দুর্গশিরে

উড়িয়ে দে তোর বিজয় কেতন!

অলক্ষণের তিলক রেখা,

রাতের ভালে হোক্ না লেখা,

জাগিয়ে দে রে চমক্ মেরে,

আছে যারা অর্দ্ধচেতন!”

‘ধুমকেতু’র রচনা ও সম্পাদকীয়র ভাষা ছিল তীব্র জ্বালাময়ী। এ প্রসঙ্গে কবি নজরুল ইনস্টিটিউট-এর নির্বাহী পরিচালক এ এফ এম হায়াতুল্লাহ বলেন, “ধূমকেতু পত্রিকার ১৩ অক্টোবর সংখ্যায় কাজী নজরুল ইসলামই প্রথম ভারতবর্ষের পূর্ণ স্বাধীনতা দাবী করেছিলেন ‘ধূমকেতুর পথ’ নামক সম্পাদকীয়তে। এর সাথে ১৯১৭ সালের একটি ঘটনার মিল পাওয়া যায়। উর্দু সাহিত্যের বিখ্যাত কবি হযরত মোহানি কংগ্রেসের অধিবেশনে ভারতবর্ষের স্বাধীনতার দাবী তুলেছিলেন। সে কারনে পরবর্তী সময়ে তাঁর বিরুদ্ধে মামলা হয় এবং দুই বছর কারাভোগ করেন। কাজী নজরুল ইসলাম এ কথা জেনেও তাঁর পত্রিকায় বাঙালিদের মধ্যে প্রথম ভারতবর্ষের পূর্ণ স্বাধীনতার দাবী উত্থাপন করেছিলেন।” কাজী নজরুল সেই সম্পাদকীয়তে লিখেছিলেন, “...সর্বপ্রথম ধূমকেতু ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতা চায়। স্বরাজটরাজ মানি না।… ভারতবর্ষের এক পরমাণু অংশও বিদেশির অধীনে থাকবে না। যারা এখন রাজা বা শাসক হয়ে এ দেশে মোড়লি করে দেশকে শ্মশানভূমিতে পরিণত করছেন, তাদের পাততাড়ি গুটিয়ে, বোঁচকা-পুঁটলি বেঁধে সাগরপারে পাড়ি দিতে হবে।”

ধুমকেতু পত্রিকার ১ম সংখ্যায় ছাপা হয় কাজী নজরুল ইসলামের ধুমকেতু কবিতাটি

১৯২২ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর সংখ্যায় প্রকাশিত হয় নজরুলের বিখ্যাত ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ কবিতাটি। এ কবিতাটি সে সময়ের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে ব্যঙ্গাত্মক ও শ্লেষপূর্ণ ছিলো। ঐ একই সংখ্যায় ছাপা হয় লেখিকা লীলা মিত্রের ‘বিদ্রোহীর কৈফিয়ত’ নামক ছোটো প্রবন্ধ। ব্রিটিশ সরকার লেখা দুটির কারণে ‘ধূমকেতু’ পত্রিকার সেই সংখ্যা বাজেয়াপ্ত করে এবং রাজদ্রোহিতার অভিযোগে কুমিল্লা থেকে নজরুলকে গ্রেফতার করে। কলকাতা চিফ প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট সুইনহোর আদালতে নজরুলের বিচার শুরু হয়। গবেষক ড. ইসরাইল খান জানালেন, সে সময় নজরুলের বিরুদ্ধে গোঁড়া মুসলমানরাও খেপে গিয়েছিলো।ইসলাম দর্শন, মুসলিম দর্শন, মুসলিম জগৎ ইত্যাদি পত্রিকার সম্পাদক ও মালিকরা তাঁকে ‘কাফের’ উপাধিও দেয়। এ ধরণের বিরূপ সমালোচনা ‘মোহাম্মদী’ পত্রিকাতেও ছাপা হতো।”

বিচারাধীন অবস্থায় আত্মপক্ষ সমর্থন করে নজরুল লেখেন তাঁর বিখ্যাত আত্মপক্ষীয় বয়ান ‘রাজবন্দীর জবানবন্দি’। ঐতিহাসিক এই বিবৃতিটি ধূমকেতু পত্রিকার ১৯২৩ সালের ২৭ জানুয়ারি সংখ্যায় ছাপা হয়। এই সংখ্যাটিই ছিলো ‘ধুমকেতু’র বত্রিশতম ও সর্বশেষ সংখ্যা। বিচারে নজরুলের এক বছরের সশ্রম কারাদণ্ড হয়। নজরুল ছাড়া পেয়েছিলেন ১৯২৩ সালের ১৫ ডিসেম্বর।

মেহেনতি মানুষের মুখপত্র লাঙল ও গণবাণী

১৯২৫ সালের নভেম্বর মাসে আত্মপ্রকাশ ঘটে ‘লাঙল’ পত্রিকাটির। কংগ্রেসের একটি সংগঠন লেবার স্বরাজ পার্টি। নজরুল জেল থেকে বেরিয়ে এই সংগঠনে যোগ দেন। এই লেবার স্বরাজ পার্টির ইশতেহার তিনি স্বহস্তে রচনা করেছিলেন এবং সেটা লাঙলে প্রকাশ করেছিলেন। এ প্রসঙ্গে এ এফ এম হায়াতুল্লাহ বলেন, “নজরুল ব্যতীত আর কোন কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক কোনো দলের ইশতেহার লিখে পত্রিকায় প্রকাশ করেছেন এমন কোনো রেকর্ড নেই। এই ইশতেহারটি অত্যন্ত সুলিখিত।”

লাঙল পত্রিকাটির ১ম ও বিশেষ সংখ্যার প্রচ্ছদ

লেবার স্বরাজ পার্টির মুখপত্র ‘লাঙল’ সাপ্তাহিক পত্রিকা হিসেবে প্রকাশিত হয়। পরবর্তী সময়ে লেবার স্বরাজ পার্টির নাম পরিবর্তিত হয়ে পেজ্যান্টাস এন্ড ওয়ার্কার্স পার্টি অফ বেঙ্গল (বঙ্গীয় কৃষক ও শ্রমিক দল) হয়। ‘লাঙল’ পত্রিকার সর্বশেষ সংখ্যাটি প্রকাশিত হয় ১৯২৬ সালের ১৫ এপ্রিল। কলকাতার ৩৭ নং হ্যারিসন রোডে লেবার স্বরাজ পার্টির অফিস থেকে ‘লাঙল’ প্রকাশিত হতো। প্রধান পরিচালক হিসেবে কাজী নজরুল ইসলামের নাম ছাপা হতো। সম্পাদক হিসেবে নাম থাকতো নজরুলের সৈনিক জীবনের বন্ধু মণিভূষণ মুখোপাধ্যায়ের, যদিও সম্পাদনার কাজটি প্রকৃতপক্ষে কাজী নজরুল ইসলাম করতেন। ‘লাঙল’ পত্রিকার প্রথম বর্ষের প্রথম সংখ্যায় লেবার স্বরাজ পার্টির সংবিধানের নীতি সম্বলিত ইশতেহারটি পূর্ণাঙ্গ রূপে মুদ্রিত হয়েছিল। প্রথম সংখ্যাটি তাই ‘লাঙল’ পত্রিকার বিশেষ সংখ্যা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল। পত্রিকার প্রচ্ছদে ‘বিশেষ সংখ্যা’ কথাটি ছাপা হয়েছিল। প্রথম সংখ্যাতেই ছাপা হয়েছিল নজরুলের বিখ্যাত কবিতা ‘সাম্যবাদী’। কবিতাটির বিপুল জনপ্রিয়তার কারণে প্রথম সংখ্যাটির ৫ হাজার কপি কয়েক ঘন্টার মধ্যে সম্পূর্ণভাবে বিক্রি হয়েছে। এ পত্রিকার দ্বিতীয় এবং তৃতীয় সংখ্যায় ক্রমান্বয়ে নজরুলের ‘কৃষানের গান’ এবং ‘সব্যসাচী’ এই দুটি বিখ্যাত কবিতা ছাপা হয়। ‘লাঙল’ পত্রিকার প্রথম সংখ্যা থেকে প্রতিটি সংখ্যাতেই সম্পাদকীয় লিখতেন নজরুল নিজেই। নিপীড়িত, বঞ্চিত মানুষের প্রতি সহমর্মিতা এবং তাদের সঙ্গে একাত্মতার প্রকাশ ঘটতো তাঁর প্রতিটি সম্পাদকীয়তে। ১৯২৬ সালের আগস্ট মাসের ‘লাঙল’ বদলে ‘গণবাণী’ হয়। কাগজের দায়িত্ব নেন মুজফফ্‌র আহমেদ। গণবাণীতে লেখা হয়, “বঙ্গীয় কৃষক ও শ্রমিক দল গণবাণীর প্রকাশ ভার গ্রহণ করেছে। এই দলের পূর্বে প্রকাশিত ‘লাঙল’ গণবাণীতে পরিবর্তিত হয়ে গেল।” ‘লাঙল’-এর তুলনায় ‘গণবাণী’ অধিক মাত্রায় রাজনৈতিক ছিল। সম্পাদনার দায়িত্বে না থাকলেও ১৯২৭ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত নজরুল এই পত্রিকায় নিয়মিত লিখতেন। ১৯২৬ সালের দাঙ্গার পটভূমিতে ‘গণবাণী’ পত্রিকার প্রথম বর্ষের তৃতীয় সংখ্যায় ছাপা হয়েছিল নজরুলের লেখা প্রবন্ধ ‘মন্দির ও মসজিদ’। এর পরবর্তী সংখ্যায় ছাপা হয় নজরুলের লেখা ‘হিন্দু-মুসলমান’ নামক প্রবন্ধটি।

লাঙলের ১ম সংখ্যায় প্রকাশ হয় কাজী নজরুল ইসলামের বিখ্যাত সাম্যবাদী কবিতাটি

অন্যান্য পত্রিকায় সাংবাদিকতা

কাজী নজরুল ইসলাম এরপর আর নিজ উদ্যোগে কোনো পত্রিকা প্রকাশ করেননি। তবে তিনি সাংবাদিকতা করেছিলেন আরো বেশ কিছুদিন। ১৯২৭ সালের নভেম্বর মাসে তিনি যোগ দেন ‘সওগাত’ পত্রিকায়। এ পত্রিকায় তিনি দীর্ঘ চার বছর চাকরি করেছেন, প্রচুর লিখেছেন।

১৯৪১ সালের অক্টোবর থেকে ‘নবযুগ’পত্রিকাটি নতুনভাবে আবারও প্রকাশিত হয়। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম এখানে তাঁর সান্ধ্য দৈনিকের অভিজ্ঞতা কাজে লাগান। ‘নবযুগ’ পত্রিকাটির প্রথম সংখ্যাতেই ‘নবযুগ’ নামে নজরুলের লেখা একটি কবিতা প্রকাশিত হয়। পত্রিকাটির কার্যালয় ছিল লোয়ার সার্কুলার রোডে। শুরুতে নজরুল সম্পাদক হিসেবে বেতন পেতেন মাসিক ৩৫০ টাকা। প্রথাগত সাংবাদিকতার বাইরে ‘নবযুগ’ নতুন মাত্রা যোগ করে। কবি নজরুলের নিজস্ব ঢঙে লেখা সম্পাদকীয় বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মী ও জনসাধারণের মধ্যে আগ্রহ সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়। পত্রিকাটিতে প্রকাশিত কবি কাজী নজরুল ইসলামের কবিতাগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল নবযুগ, ঈদের চাঁদ, নতুন চাঁদ, নৌজোয়ান, জোর জমিয়াছে খেলা, কেন আপনারে হানি হেলা, ফুল ও হুর, আগুনের ফুল কি ছোটে, শ্রমিক মজুর, নারী, মহাত্মা হাজী মোহাম্মদ মোহসিন, মহাত্মা মোহসিন ইত্যাদি। কাজী নজরুল ইসলামের সম্পাদনায় ১৯৪২ সালের ১০ জুলাই পর্যন্ত ‘দৈনিক নবযুগ’ প্রকাশিত হয়। এরপর তিনি অসুস্থ হয়ে পড়ায় পত্রিকাটির জনপ্রিয়তা হ্রাস পেতে থাকে এবং ১৯৪৩ সালের পর ‘দৈনিক নবযুগ’ বন্ধ হয়ে যায়।

সহায়ক গ্রন্থ:

১. মুজফফ্‌র আহমদ, কাজী নজরুল ইসলাম: স্মৃতিকথা, হাওলাদার প্রকাশনী, ঢাকা।

২. রফিকুল ইসলাম, নজরুল জীবনী, নজরুল ইনস্টিটিউট, ঢাকা।

৩. কবি নজরুল ইনস্টিটিউট পত্রিকা: একচল্লিশতম সংকলন, কবি নজরুল ইনস্টিটিউট, ঢাকা।