মোদির যুক্তরাষ্ট্র সফর: কোন পথে উপমহাদেশের রাজনীতি

মঙ্গলবার নিউইয়র্কে পৌঁছানোর সাথে সাথে সমর্থকদের স্বাগত জানিয়েছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি । ২০ জুন, ২০২৩।

বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির ‘উন্নতি’ এবং ‘সুষ্ঠু নির্বাচনে সহযোগিতা’ করতে যুক্তরাষ্ট্র নিজেদের অবস্থান পরিষ্কার করার পর উপমহাদেশের রাজনীতিতে যখন নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে, তখন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির যুক্তরাষ্ট্র সফর ঘিরে চলছে নানা হিসাব-নিকাশ। বাংলাদেশের জাতীয় দৈনিক প্রথম আলোসহ কয়েকটি গণমাধ্যমের খবরে ইতিমধ্যে দাবি করা হয়েছে, এই সফরে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে বাংলাদেশ প্রসঙ্গে আলাপ করবেন নরেন্দ্র মোদি। তবে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক বিশ্লেষকেরা ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেছেন, ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী দ্বিপাক্ষিক স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়েই বেশি জোর দেবেন। কেউ আবার বলছেন, বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের ‘কমন ইন্টারেস্টের’ বিষয়গুলো যুক্তরাষ্ট্রকে তিনি স্মরণ করিয়ে দিলেও দিতে পারেন।

ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে উদ্ধৃত করে দ্য হিন্দুস্তান টাইমসের খবরে বলা হয়েছে, ২০-২৪ জুন যুক্তরাষ্ট্র সফরে থাকবেন নরেন্দ্র মোদি। জো বাইডেন প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর দ্বিতীয়বারের মতো দেশটি সফরে যাচ্ছেন তিনি। এর আগে সাতবার তিনি যুক্তরাষ্ট্র সফর করেছেন।

খবরে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র সফর শেষ করে (২৪-২৫ জুন) মোদি মিশরে প্রথমবারের মতো রাষ্ট্রীয় সফরে যাবেন।

মোদির এই সফরে বাংলাদেশ প্রসঙ্গের চেয়ে দ্বিপাক্ষিক বিষয়ই বেশি গুরুত্ব পাবে বলে মনে করেন বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের সিনিয়র রিসার্চ ফেলো শাফকাত মুনির। তিনি ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন, "এটি একটি দ্বিপাক্ষিক সফর। আমি মনে করি না সেখানে বাংলাদেশের প্রসঙ্গ খুব একটা উঠবে।’’

নরেন্দ্র মোদির এই সফর ঘিরে খুব একটা উচ্চাশা দেখাচ্ছেন না ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের হয়ে নানা ধরনের বুদ্ধিবৃত্তিক কাজে যুক্ত থাকা ব্যক্তিরাও। তাদের ধারণা, আঞ্চলিক রাজনীতিতে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের যে ভাবনাগুলো নিয়ে মিল আছে সেসব বিষয়ে আলোচনা হতে পারে।

অধ্যাপক মোহাম্মদ এ আরাফাতের ভাষায়, ‘‘নরেন্দ্র মোদি যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে তাদের দ্বিপাক্ষিক ইস্যুগুলো নিয়ে আলোচনা করবেন। সেখানে তিনি আমাদের হয়ে যুক্তরাষ্ট্রকে কিছু বলবেন বা করবেন, এমন চিন্তা আমাদের নেই। আঞ্চলিক নিরাপত্তার স্বার্থে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আমাদের যেমন সম্পর্ক, তেমন সম্পর্ক ভারতেরও আছে। দুদেশের জন্যই সেটি গুরুত্বপূর্ণ।’’

‘‘বাংলাদেশে শেখ হাসিনার রাজনীতি গুরুত্বপূর্ণ। আমরা যেমন মনে করি, এই অঞ্চলে জঙ্গিবাদ দমন করতে হবে, তেমনি ভারতও মনে করে। এখানে যুক্তরাষ্ট্র যদি তার অন্য কোনো স্বার্থে বৈশ্বিক রাজনীতি অন্যভাবে পরিচালনা করে, তাহলে স্বাভাবিকভাবে আঞ্চলিক রাজনীতির স্বার্থে পার্টনার হিসেবে বাংলাদেশ-ভারতের এক ধরনের অবস্থান থাকতেই পারে।’’

বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব

তিন দিকে ভারত, একদিকে মিয়ানমার। দক্ষিণে উন্মুক্ত বঙ্গোপসাগর। চীন সেখানে নিকটতম প্রতিবেশী। বাংলাদেশ ঘিরে তিন দেশের এমন ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কয়েক শ কোটি মানুষের রাজনীতি, অর্থনীতি ও ব্যবসা-বাণিজ্যে বাংলাদেশের গুরুত্ব দিনকে দিন বাড়ছে। গুরুত্ব বাড়ার এই সময়ে বাংলাদেশ ঘিরে ভারত ও চীনের প্রতিযোগিতাও বাড়ছে সমান তালে। বিষয়টির ধারণা পাওয়া যায় দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনীতি বিষয়ক গবেষক ফরেস্ট কুকসন ও টম ফেলিক্স জোয়েনেকের ‘China and India's geopolitical tug of war for Bangladesh’ শিরোনামের নিবন্ধে। দুই লেখক অস্ট্রেলিয়ার গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইস্ট এশিয়া ফোরামে এটি প্রকাশ করেন। সেখানে উঠে এসেছে বাংলাদেশ নিয়ে চীন এবং ভারতের ভূ-রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব-যুদ্ধ। তাদের মতে বাংলাদেশকে নিয়ে ভারত ও চীনের প্রতিযোগিতার পেছনে ভিন্ন ভিন্ন কারণ রয়েছে। ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা ও রাজনৈতিক কারণে বাংলাদেশকে প্রয়োজন। জাতীয় নিরাপত্তার বিষয়টি হচ্ছে, ভারতের উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের সাতটি রাজ্য বা সেভেন সিস্টার্সের নিরাপত্তা রক্ষায় বাংলাদেশের সহায়তা ভারতের দরকার। রাজনৈতিক বিষয়টি হচ্ছে, বাংলাদেশের মধ্যে চীন বা অন্য কোন পরাশক্তির উপস্থিতি ভারতের জন্যও অস্বস্তিকর। অন্যদিকে চীনের সাথে বাংলাদেশের সীমানা না থাকলেও চীনের বাংলাদেশকে প্রয়োজন তার আঞ্চলিক আধিপত্য বিস্তার ও অর্থনৈতিক কারণে।

ফরেস্ট কুকসন ও টিম ফেলিক্সের গবেষণায় বলা হয়েছে, ভারত এবং চীন বাংলাদেশকে যা দেয় তারচেয়ে অনেক বেশি নিয়ে যায়।

অন্যদিকে চীন প্রায়ই বলে থাকে, এই অঞ্চলে তাদের গুরুত্ব কমাতে বাংলাদেশে প্রভাব বিস্তার করতে চায় যুক্তরাষ্ট্র। তাদের দাবি, বঙ্গোপসাগরে সামরিক উপস্থিতিও বাড়াতে চায় যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র সরকার বারবারই বলে আসছে, বাংলাদেশের কোনো ভূখণ্ডেই তাদের আগ্রহ নেই।

এ বিষয়ে ঢাকাস্থ যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের পাবলিক অ্যাফেয়ার্স কাউন্সেলর শন ম্যাকিনটোশ সম্প্রতি বাংলাদেশের গণমাধ্যমকে বলেছেন, ‘‘যুক্তরাষ্ট্র এবং বাংলাদেশ শক্তিশালী এবং সহযোগিতামূলক অংশীদারিত্ব বজায় রাখে। আমরা বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বকে সম্মান করি। দেশটির কোনো ভূখণ্ডের ওপর আমরা কোনো দাবি করিনি। নিরাপদ ও সুরক্ষিত ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চল নিশ্চিতে বাংলাদেশের সঙ্গে আমাদের অংশীদারিত্বকে আমরা মূল্য দেই এবং অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনসহ গণতন্ত্রের প্রচারে একসঙ্গে কাজ করার মাধ্যমে আমাদের সম্পর্ক জোরদারের চেষ্টা করি।’’

এই অঞ্চলে বাংলাদেশ কতটা গুরুত্বপূর্ণ, সেটি বোঝা যায় চীন এবং ভারতের মনোভাব থেকে। সীমান্ত নিয়ে দুই দেশের মধ্যে তুমুল বৈরিতা দেখা গেলেও বাংলাদেশে তাদের আগ্রহ প্রায় এক।

মোহাম্মদ এ আরাফাত বলছেন, ‘‘চীনের সঙ্গে ভারতের বিশাল একটা দূরত্ব আছে; কিন্তু বঙ্গোপসাগরে যুক্তরাষ্ট্র যদি তাদের সামরিক অবস্থান গড়তে চায়, তাহলে চীনেরও যেমন আপত্তি, ভারতেরও আপত্তি। এখানে বাংলাদেশেরও আপত্তি আছে। এই আপত্তি চীন কিংবা ভারতকে সহযোগিতা করার জন্য নয়। বাংলাদেশ তার নিজের স্বার্থে চায় না এখানে পরাশক্তিদের কোনো সামরিক অবস্থান থাকুক। এগুলো শেখ হাসিনার আদর্শিক অবস্থান: বাংলাদেশের স্বার্থে জঙ্গিবাদ, বিচ্ছিন্নতাবাদের বিপক্ষে তার অবস্থান, সার্বভৌমত্বের স্বার্থে পরাশক্তির মিলিটারি প্রেজেন্সের বিপক্ষে তার অবস্থান। কোনোভাবে এগুলো ভারত-চীনের সঙ্গে মিলে গেছে। তাই চীন এবং ভারত একে অপরে নানা বিষয়ে দ্বিমতে থাকলেও বাংলাদেশকে বন্ধু ভাবছে। এসব দিক বিবেচনায় আমাদের কিছু কমন ইন্টারেস্ট আছে। সেগুলো আমরা যেমন তুলে ধরি, এই সফরে ভারতও একইভাবে তুলে ধরতেই পারে।’’