ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা চট্টগ্রামে, তদন্ত নোয়াখালীতেঃ সাংবাদিক অধরা ইয়াসমিন

Your browser doesn’t support HTML5

টেলিভিশন সাংবাদিকতা শুরু করেছেন দুই বছর আগে। এর মধ্যেই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলার কবলে পড়তে হলো বাংলাদেশের নারী সাংবাদিক অধরা ইয়াসমিনকে। বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল আরটিভির এই স্টাফ রিপোর্টার ভয়েস অফ আমেরিকাকে জানিয়েছেন, চট্টগ্রামের সাইবার ট্রাইব্যুনালে তার নামে মে মাসে মামলা হলেও অবগত করা হয়েছে জুলাইতে এসে। মামলাটির তদন্ত হচ্ছে আবার নোয়াখালীতে।

নিজের প্রতিষ্ঠান আরটিভি আইনি সহায়তা দিচ্ছে জানিয়ে অধরা ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন, ‘‘আমি ঢাকায় বসে প্রতিবেদনটি প্রচার করেছি। সেই প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে মামলা করেছে সাকেরুল কবির। নিজেকে তিনি রাজারবাগ দরবার শরীফের একজন মুরিদ বলে পরিচয় দেন।’’

মামলার সর্বশেষ অবস্থা সম্পর্কে জানতে চাইলে অধরা বলেন, ‘‘আমি তদন্ত প্রক্রিয়ায় সহায়তা করতে ১৪ জুলাই নোয়াখালী গিয়েছিলাম। তদন্ত শেষ হলে হয়তো আদালতে যেতে হবে।’’

মামলাটির তদন্ত করছেন নোয়াখালী জেলা সিআইডির পরিদর্শক মুহাম্মদ রফিকুল ইসলাম। তদন্তের অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে চাইলে তেমন কোনো তথ্য দিতে রাজি হননি তিনি। শুধু বলেন, ‘‘তদন্ত চলছে। এটা নিয়ে কাজ করছি।’’

বাংলাদেশের এই আইন নিয়ে দেশ-বিদেশে সমালোচনা চলছে আগে থেকেই। ৫ জুন জাতীয় সংসদে প্রশ্নোত্তর পর্বে দেশের আইনমন্ত্রী আনিসুল হক জানান, ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পাস হওয়ার পর থেকে ২০২৩ সালের ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত সারা দেশে এই আইনে ৭ হাজার ১টি মামলা হয়েছে।

বাক স্বাধীনতা নিয়ে কাজ করা সংগঠন আর্টিক্যাল নাইনটিনের হিসাবে ২০২০ সাল থেকে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বাংলাদেশে ২২৩ জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে এই আইনে ১১০টি মামলা হয়েছে। এইসব মামলায় ৫৪ জন সাংবাদিককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এই সময়ে সব মিলিয়ে ৫৭৩টি মামলা হয়েছে। গ্রেপ্তার করা হয়েছে ৪০৪ জনকে।

সাংবাদিকদের অধিকার রক্ষায় সোচ্চার বৈশ্বিক সংগঠন কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টস (সিপিজে) অধরার বিরুদ্ধে চলমান তদন্ত বন্ধে দেশের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে আহ্বান জানিয়েছে। বাংলাদেশের বিভিন্ন সংগঠন থেকেও প্রতিবাদ জানানো হয়েছে।

চট্টগ্রামের সাইবার ট্রাইব্যুনালে গত ১৩ মে অধরা ও তার সোর্সের বিরুদ্ধে মামলাটি হয়। এর আগে গত ৩০ এপ্রিল আরটিভিতে অধরার একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রচার করা হয়। ওই প্রতিবেদনে তিনি রাজারবাগ দরবার শরীফ ও এর নেতা সাকেরুল কবিরের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের কথা প্রকাশ করেন। চট্টগ্রামের আদালতে সাকেরুল নিজেই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলাটি করেন।

সাকেরুল ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন, ‘‘আরটিভিতে সে (অধরা ইয়াসমিন) আমার নামে একটি মিথ্যা তথ্য, একটি মিথ্যা বক্তব্য পেশ করেছিল। সেটার জন্য আমি মামলা করেছি।’’

সাকেরুলের দাবি, ‘‘ওই রিপোর্টে আমার নামে হওয়া ২০১৭ সালের একটি মামলার কথা বলা হয়েছে। সাতক্ষীরাতে আমি এক লোকের কাছে ৩৫ লাখ টাকা পেতাম। তার সঙ্গে আমার এক কাজিন আছে। কাঞ্চন। তারাই যোগসাজশ করে আমার নামে মিথ্যা মামলাটা করছে। তখনই সিআইডির মাধ্যমে তদন্তে এটা মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছিল। ২০১৭ সালের এই মামলার কথা বলতে গিয়ে এখন ২০২৩ সালের এই রিপোর্টে আমার ছবি দেখানো হয়েছে।’’

‘‘আমার দেশের বাড়ি নোয়াখালী। তাই তদন্ত নোয়াখালীতে হচ্ছে,’’ জানিয়ে সাকেরুল বলেন, ‘‘বিচারক যেকোনো স্থানেই তদন্ত করতে নির্দেশ দিতে পারেন।’’

‘হালাল মামলার ফাঁদ’ শিরোনামে ১৭ মিনিট ৪৭ সেকেন্ডের ওই প্রতিবেদনে সাকেরুলের প্রসঙ্গ এসেছে শুরু থেকেই। প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে, রাজারবাগ দরবার শরীফের মুরিদ হওয়ার পরই বদলে যেতে থাকে সাকেরুলের জীবন। সেখানে তার বাবারও মন্তব্য আছে। ছেলে সম্পর্কে তাকে বলতে শোনা গেছে, ‘‘তারে মেরে ফেলবে। কারণ সে (সাকেরুল) সব জানে, তাই বের হতে পারবে না।’’

‘বিভিন্ন মানুষের সম্পত্তি দখল করতে’ কীভাবে একটি সিন্ডিকেট দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে নির্দিষ্ট কোনো ব্যক্তির নামে একের পর এক মামলা দেয়, প্রতিবেদনটিতে সেসব বিষয় তুলে ধরা হয়েছে।

প্রতিবেদনে সাকেরুলের বিষয়ে আরও তথ্য দিতে ২০১৭ সালের ১৬ মার্চ প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনের কথা উল্লেখ করা হয়। প্রতিবেদনে প্রকাশিত ছবি দেখিয়ে অধরা ইয়াসমিন ভয়েসওভারে বলতে থাকেন, ‘‘সাকেরুলের গল্পটা আমরা এখানেই শেষ করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু হঠাৎই পত্রিকার একটি কাটিং আমাদের সন্দেহ বাড়ায়। পত্রিকার সংবাদ বলছে সাতক্ষীরায় একটি মামলা সাজাতে গিয়ে সাঙ্গপাঙ্গসহ ধরা পড়েন সাকেরুল। খবর নিয়ে জানা যায়, ভাড়া করা তিন মেয়েকে নিয়ে এক ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা করতে গিয়েছিল সাকেরুল। এ বিষয়ে যোগাযোগের চেষ্টা করলে তাকে (সাকেরুলকে) পাওয়া যায়নি।’’

প্রতিবেদনে দেখা যায়, উপস্থাপিকা অধরা ইয়াসমিন সাকেরুলের মুঠোফোনে কল করছেন। কিন্তু রিসিভ হচ্ছে না।

সাকেরুল ব্যক্তিগত নম্বরে সরাসরি খুব একটা কথা বলতে চান না। তবে হোয়াটসঅ্যাপে তাকে পাওয়া যায়। এই প্রতিবেদক তার নম্বরে একাধিকবার কল করেন। কিন্তু রিসিভ করেননি। পরে দুদিন বাদে তাকে হোয়াটসঅ্যাপে পাওয়া যায়।

প্রতিবেদনে ছবি ব্যবহার নিয়ে মূলত আপত্তি বেশি সাকেরুলের। তিনি ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন, ‘‘আমাকে নিয়ে সেখানে যে বক্তব্যটা দিছে, বিশেষ করে আমার একটা মামলা সংক্রান্ত বিষয় বলছিল, ছবি ব্যবহার করছিল। যে বক্তব্য সে দিয়েছিল, সেটা মিথ্যা। এই মিথ্যা বক্তব্যের বিরুদ্ধে মামলাটা করেছি।’’

সাকেরুলের বাড়ি নোয়াখালী, ৩৫ লাখ টাকা পান সেই সাতক্ষীরায়, এত দূরে এত টাকা কীভাবে একজন মানুষের কাছে তিনি পান, কী কাজ তিনি করেন-এ বিষয়ে জানতে চাইলে সাকেরুল দাবি করেন, ‘‘আমার মধুর ব্যবসা ছিল। সেই ব্যবসা সংক্রান্তে তার কাছে পেতাম।’’

মধুর ব্যবসায় এতটাকা লেনদেন সম্ভব কি না-এমন প্রশ্নের জবাবে সাকেরুল দাবি করেন, ‘‘জ্বি, এত টাকা।’’

অধরা ইয়াসমিন বলছেন, ‘‘এগুলো তারা হয়রানির জন্যই করেন। আমি প্রতিবেদনে সব তথ্য-প্রমাণ দেখিয়েছি। কীভাবে তারা মামলা করে, সেসব তুলে ধরেছি। তবু আমার নামে মামলা হলো। এখন মামলার পেছনে দৌড়াবো, না কি কাজ করবো-সেটা বুঝতে পারছি না।’’

নিরাপত্তাহীনতার কথা উল্লেখ করে অধরা বলেন, ‘‘কখনো কখনো মনে হয় কেউ আমাকে অনুসরণ করছে।’’