‘সাহসী’ সিদ্ধান্তে ‘স্বস্তির’ জয়

CRICKET-ASIA-2023-BAN-AFG-ODI

প্রথম ম্যাচে হার। দ্বিতীয় ম্যাচে মেহেদী হাসান মিরাজকে টেল-এন্ডার থেকে একদম ওপেনিয়েং এনে ‘চমক’। উপহার দিলেন সেঞ্চুরি। সঙ্গে ধারাবাহিকতা বজায় রেখে নাজমুল হোসেন শান্তও শতক হাঁকালেন। অন্যদিকে বোলিংয়ে নেমে প্রথম ওভার থেকেই শরিফুল ইসলামের দাপট। নিষ্প্রাণ উইকেটে রাতের কৃত্রিম আলোয় তাসকিনও নিজের ধারাবাহিক উন্নতির ছাপ রাখলেন। রবিবার (৩ সেপ্টেম্বর) লাহোরে এভাবে এশিয়া কাপের দ্বিতীয় ম্যাচে আফগানিস্তানকে ৮৯ রানে হারিয়ে সুপার ফোরস-এ যাওয়ার দিন বাংলাদেশ যে ক্রিকেট খেলেছে তাতে ম্যানেজমেন্ট এবং অধিনায়কের ‘সাহসী সিদ্ধান্তকে’ কৃতিত্ব দিচ্ছেন বিশ্লেষকেরা।

শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে হারার পর দ্বিতীয় ম্যাচের ওপেনিং পজিশন নিয়ে শঙ্কায় পড়ে যায় বাংলাদেশ। নিয়মিত ওপেনারদের কাছে প্রত্যাশিত পারফর্ম্যান্স না মেলায় রবিবার ক্যারিয়ারে দ্বিতীয়বারের মতো ম্যাচের গোড়াপত্তন করতে আসেন ২৫ বছর বয়সী মিরাজ। এর আগে ২০১৮ সালে এশিয়া কাপের ফাইনালে উদ্বোধনীতে দেখা যায় তাকে। এভাবে তাকে উপরে আনার সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানিয়ে সাকিব-মুশফিকদের ছেলেবেলার ক্রিকেটগুরু নাজমুল আবেদিন ফাহিম ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন, ‘‘সাহসী এই সিদ্ধান্তটি দারুণ ছিল। মিরাজকে উপরে নিয়ে আসায় নিচে আমরা ব্যাটসম্যান যোগ করতে পেরেছি। এতে ব্যাটিং সামর্থ্য বেড়েছে।’’

অনূর্ধ্ব-১৯ ক্রিকেটে আলো ছড়িয়ে মিরাজ যখন জাতীয় দলে প্রথম সুযোগ পান, তখন স্পিনার হিসেবে জায়গা হয়। কিন্তু নিজেকে সবসময় তিনি অলরাউন্ডারই ভেবেছেন। ভাবনার এই সক্ষমতা একাধিকবার প্রমাণও করেছেন। মিরাজ এদিন যেভাবে ব্যাট করেছেন তা দেখে মুগ্ধ হয়েছেন ভারতের তারকা ক্রিকেটার রবিচন্দ্রন অশ্বিনও। টুইটারে নিজের ভেরিফায়েড অ্যাকাউন্টে তিনি লিখেছেন, ‘‘ব্যাটসম্যান হিসেবে মেহেদী হাসানের উত্থান বাংলাদেশের জন্য বিরাট ইতিবাচক দিক, বাংলাদেশকে যা ভারসাম্য গড়ার ক্ষেত্রে সুবিধা করে দেবে। মিরাজের ব্যাটিং দক্ষতা শেষ ১২ মাসে বাংলাদেশের ম্যানেজমেন্টে নতুনমাত্রা যোগ করেছে।’’

‘রিটায়ার্ড-হার্ট’ হয়ে মাঠ ছাড়ার আগে মিরাজ ১১৯ বলে ১১২ রান করে যান। ৯৪.১১ স্ট্রাইকরেটে সাতটি চার ও তিনটি ছক্কা হাঁকান তিনি। অন্যদিকে চার নম্বরে নামা শান্ত ৯৯.০৪ স্ট্রাইকরেটে ১০৫ বলে করেন ১০৪। এরমধ্যে চার ছিল ৯টি, ছক্কা দুটি। শেষ দিকে অধিনায়ক সাকিব আল হাসান ১৮ বলে ৩২ করে দলের স্কোর ৩৩৪-এ নিয়ে যান। জবাবে আফগানিস্তান ৪৪.৩ ওভারে গুটিয়ে যায় ২৪৫ রানে।

মুশফিকের ‘কার্যকরী অবদান’

বড় জয় পাওয়ার এই ম্যাচে মুশফিকুর রহিম ১৫ বলে ২৫ রানের একটি ইনিংস খেলেছেন। এটিকে সাদামাটা একটি ব্যক্তিগত স্কোর মনে হলেও এই ম্যাচে সেটি ছিল দারুণ কার্যকরী। চতুর্থ এবং পঞ্চম জুটিতে তিনি শান্ত-সাকিবের সঙ্গে যথাক্রমে ২১ ও ১৬ রান যোগ করেন। মুশফিকের কথা উল্লেখ করে নাজমুল আবেদিন বলেন, ‘‘শেষদিকে সাকিব-শান্তর সঙ্গে মুশফিক কার্যকরী দুটি জুটি গড়েছেন। এতে স্কোর বড় হয়েছে। সাকিব তার মতো করেই খেলে গেছেন। ব্যক্তিগত এই স্কোরগুলো বাংলাদেশকে স্বস্তি দিয়েছে।’’

ব্যাটসম্যান মুশফিকের এমন অবদানের পাশাপাশি উইকেটরক্ষক মুশফিকও ম্যাচের মোড় ঘুরিয়েছেন। ২৮তম ওভারে হাসান মাহমুদের করা তৃতীয় বলে ইব্রাহিম জাদরানের অমন ক্যাচ ধরতে না পারলে ম্যাচের মোড় ঘুরেও যেতে পারতো। আফগান ওপেনার ইব্রাহিম তখন ব্যক্তিগত ৭৫ রানে। তাকে মেরে খেলতে দেখে হাসান পঞ্চম স্টাম্পে বল পিচ করান। বাউন্স ছিল। জাদরান পুশ করতে গেলে বাইরের কোনায় লেগে বল যায় উইকেটের পেছনে। মুশফিক ডানদিকে পুরো শরীর হাওয়ায় ভাসিয়ে ক্যাচ নেন। ১৩১ রানে তৃতীয় উইকেটের পতন হয় আফগানিস্তানের।

ক্রিকেটবিষয়ক ওয়েবসাইট ক্রিকইনফোর ম্যাচপরবর্তী বিশ্লেষণে ভারতের সাবেক ক্রিকেটার ওয়াসিম জাফর এই ক্যাচের কথা উল্লেখ করে বলেন, ‘‘মুশফিকের নেওয়া ওই ক্যাচ সত্যিকার অর্থে ম্যাচের মোমেন্টাম পাল্টে দিয়েছে। কারণ জাদরানকে দারুণ ছন্দময় মনে হচ্ছিলো। জাদরান আর ৩০-৪০ রান করে দিতে পারলে বাকিদের জন্য কাজটা সহজ হয়ে যেত। কিন্তু ওই ক্যাচ ম্যাচের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে।’’

নতুন বলে শরিফুলের ‘রাজত্ব’

বাংলাদেশের ইনিংস থেকেই বোঝা গেছে উইকেটে বোলারদের জন্য খুব বেশি কিছু নেই। টিভি ধারাভাষ্যকাররাও শুরুতে একথা বলছিলেন। দ্বিতীয় ইনিংসে উইকেট আরও নিষ্প্রাণ হয়ে যায়। এমন পিচে নতুন বলে শরিফুল প্রথম ডেলিভারি থেকেই আক্রমণাত্মক ছিলেন। সুইং পেয়েছেন।

শরিফুলের প্রশংসা করে ওয়াসিম জাফর ক্রিকইনফোর লাইভে বলেন, ‘‘শরিফুল দারুণ লেংথে বল করেছেন। এই উইকেটে সুইংও করিয়েছেন। প্রথম ওভারেই গুরবাজকে ফিরিয়ে আফগানদের ব্যাকফুটে ঠেলে দেন। শরিফুলের পাশাপাশি তাসকিন দ্বিতীয় স্পেলে দারুণ বল করেছেন। হাসান মাহমুদ একটু খরুচে হলেও গুরুত্বপূর্ণ উইকেটটি নিয়েছেন। আফগানিস্তানের বোলারদের তুলনায় সম্পূর্ণ বিপরীত ভূমিকায় দেখা গেছে বাংলাদেশিদের।’’

তাসকিন এদিন ৮.৩ ওভার বল করে ৪ উইকেট নেন। খরচ করেন ৪৪ রান। শরিফুল ৯ ওভারে ৩৬ রান দিয়ে নেন ৩ উইকেট। এরমধ্যে এক ওভার মেডেন। হাসান ৯ ওভারে ৬১ রান দিলেও মারমুখী জাদরানকে সাজঘরে ফেরান।

আফগানিস্তানের কৌশল নিয়ে প্রশ্ন

এই জয়ে বিশ্লেষকেরা বাংলাদেশকে কৃতিত্ব দিলেও আফগানিস্তানের ব্যাটিং লাইনআফ নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। ওয়াসিম জাফর যেমনটি বললেন, ‘‘অধিনায়ক হাশমতুল্লাহ শহীদী চার নম্বরে ফিফটি করলেও যেভাবে খেলেছেন তা ফলপ্রসূ ছিল না। ৫১ করতে ৬০ বল খরচ করেছেন তিনি। তার এমন ব্যাটিংয়ের কারণে আফগানিস্তানের রানরেট বেড়েছে। তার অ্যাপ্রোচই ইতিবাচক ছিল না। রশিদ খান কেন ৯ নম্বরে নামলেন সেটি বোধগম্য নয়। আমার মনে হয় তিনি সাত নম্বরেই বেশি মানানসই। ৯ নম্বরে নয়। বিশেষ করে ৩৩৪ রান তাড়া করতে নামলে রশিদের মতো ক্রিকেটারকে আপনার বেশি বল খেলতে দিতে হবে। অনেকবার তাকে আমরা এই পজিশনে ম্যাচ বের করতে দেখেছি। ’’

বাংলাদেশের চিন্তা যেখানে

নিষ্প্রাণ উইকেটে পাঁচজন নিয়মিত বোলার নিয়ে মাঠে নামলেও শরিফুল-তাসকিন বাদে বাকিরা সেভাবে প্রভাব বিস্তার করতে পারেননি। বাধ্য হয়ে সাকিবকে মোট সাতজনের হাতে বল তুলে দিতে হয়। মিরাজ ৮ ওভার হাত ঘুরিয়ে ৪১ রান দিয়ে ১ উইকেট নিয়েছেন। উইকেটহীন সাকিব ৮ ওভারে নিজে দিয়েছেন ৪৪। আফিফ মাঝে এসে এক ওভার করে যান। ৬ রান দেন। পরে আর তাকে ডাকেননি অধিনায়ক। আফিফের মতো শামীম হোসেনও এক ওভার হাত ঘোরান। ১০ রান দিয়ে কোনো উইকেট পাননি।

এশিয়া কাপের পর বিশ্বকাপের ভাবনা বাংলাদেশের। বিশ্বকাপের জন্য ১৫ সদস্যের দল ঘোষণার শেষ তারিখ ৫ সেপ্টেম্বর। প্রথম ম্যাচের এলোমেলো হারের পর দ্বিতীয় ম্যাচের এমন জয়ে কে কোথায় থিতু হবেন-তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। মিরাজ কি ওপেনই করবেন? সাত নম্বরে আবার কে খেলবেন? মাহমুদউল্লাহ রিয়াদকে ফেরানো হবে কি না-অল্প সময়ের ভেতর এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হবে নির্বাচকদের।

সবকিছুর ভিড়ে সুপার ফোরস পর্বে যাওয়ার আগে এই জয় দলের আত্মবিশ্বাস জোগাবে বলে মনে করেন নাজমুল আবেদিন ফাহিম। সঙ্গে এটাও বলে দিয়েছেন-একটা দল হয়ে খেলার মানসিকতা আরও প্রখর করতে হবে।