প্রত্যন্ত অঞ্চলের চিত্র ভিন্ন: নারী ও শিশুর স্বাস্থ্য সংক্রান্ত সাংবাদিক কর্মশালা, প্রতিবেদন ৩

বাংলাদেশে মাতৃ ও শিশু মৃত্যুর হার গত ১৫ বছরে কমিয়ে প্রায় চার ভাগের এক ভাগে নিয়ে আসা সম্ভব হয়েছে। এই সাফল্যে বাংলাদেশ পেয়েছে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিও। কিন্তু সাফল্যের এই চিত্র সর্বত্র সমান নয়। শহরাঞ্চলে যেভাবে মাতৃ ও শিশু মৃত্যু হ্রাস পেয়েছে গ্রামাঞ্চলে সেভাবে হয়নি। দেশে এখনও প্রতি ৬শ জীবিত শিশু জন্ম দিতে গিয়ে একজন মা মারা যান। বছরে মারা যান প্রায় ৬ হাজার মা। অথচ শুধু মাত্র সচেতনতা বাড়ানো গেলে এই মৃত্যু হারের ৬০ শতাংশই প্রতিরোধ করা সম্ভব।

বিভিন্ন জরীপ এবং অনুসন্ধানে দেখা গেছে, মা ও শিশু মৃত্যুর ক্ষেত্রে শহর এবং গ্রামের মধ্যে বিরাট তফাত। মূলত: দারিদ্র, শিক্ষার অভাব, অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা, সঠিক তথ্য না জানা, সনাতনী চিন্তা-ভাবনা এবং মাতৃ ও শিশু স্বাস্থ্যের ব্যাপারে অসচেতনতাই এর মূল কারণ। একই কারণে দেশের সাতটি বিভাগের মধ্যে সিলেট বিভাগে মাতৃ ও শিশু মৃত্যুর হার সবচেয়ে বেশি। সন্তান ধারণ ও জন্মদানের সময় সিলেট বিভাগে সবচেয়ে বেশি মাতৃমৃত্যুর ঘটনা ঘটছে।

জাতীয় জনসংখ্যা গবেষণা ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট (নিপোর্ট) সম্প্রতি দেশের ৭টি বিভাগ নিয়ে এক জরীপের ফলাফল প্রকাশ করে। এতে দেখা গেছে, দেশে প্রতি বছর যে হারে মাতৃ ও শিশু মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে তার ৬০ শতাংশই অজ্ঞতার কারণে ঘটছে। জরিপে পাওয়া তথ্যমতে, দারিদ্র, উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার অভাব, স্বাস্থ্য সম্পর্কিত তথ্য না জানা, হাতুড়ে চিকিত্সা ব্যবস্থায় সন্তান প্রসব এবং যুগ যুগ ধরে চলে আসা কিছু কুসংস্কারের কারণে এই সংখ্যক মৃত্যু ঘটছে। তথ্য মতে, প্রায় ৩১ শতাংশ মাতৃমৃত্যু ঘটে প্রসবের পর অধিক রক্তক্ষরণের কারণে। ২০ শতাংশ মৃত্যুর কারণ খিচুনি বা একলেমসিয়া। অধিক পরিশ্রম বা চাপের কারণে মৃত্যু ঘটে প্রায় ৭ শতাংশের। এছাড়া ১ থেকে ২ শতাংশ মৃত্যু ঘটে গর্ভপাতজনিত কারণে।

সেভ দ্য চিলড্রেন এর খাদ্য ও পুষ্টি বিষয়ক ডিরেক্টর ড. ইশতিয়াক মান্নান জানালেন, একমাত্র জনসচেতনতা বৃদ্ধি এবং প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষের গর্ভকালীন স্বাস্থ্য পরিচর্যা নিশ্চিত করতে পারলেই এই ৬০ শতাংশ মৃত্যু প্রতিরোধ করা সম্ভব। তিনি বলেন, প্রসবোত্তর সময়ে অধিক রক্তক্ষরণের কারণে যে ৩১ শতাংশ মৃত্যু ঘটে তা মাত্র দুটো ট্যাবলেট খেলেই এড়ানো সম্ভব। শুধু তাই নয় এ দুটো ট্যাবলেটের মূল্যও খুবই কম। অথচ এ সম্পর্কে না জানার কারণেই এই মৃত্যু ঘটছে।

পরিসংখ্যান অনুযায়ী বাংলাদেশে এখনও ৫৮ শতাংশ নারী অপ্রশিক্ষিত পদ্ধতিতে সন্তান প্রসব করেন। বাড়িতে সন্তান জন্ম দেন প্রায় ৬৩ শতাংশ নারী। যা মাতৃমৃত্যুর অন্যতম কারণ। এখনও ৩৩ শতাংশ শিশু কম ওজন নিয়ে জন্মায়।

পপুলেশন কাউন্সিলের কান্ট্রি ডিরেক্টর ড. ওবায়দুর রব জানান, আমাদের দেশে প্রায় ৬০ শতাংশ শিশু মারা যায় জন্মের ৫ ঘন্টার মধ্যে। আর জন্মের এক সপ্তাহের মধ্যে মারা যায় ৭৫ শতাংশ শিশু। কিন্তু আমরা যদি গর্ভকালীন সময়ে যথাযথ চেকআপ এবং সেবার আওতা বাড়িয়ে দক্ষতার সাথে গর্ভকালীন এবং প্রসবোত্তর পরিচর্যা নিশ্চিত করতে পারি তাহলে এই মৃত্যু প্রতিরোধ সম্ভব।

এদিকে বাংলাদেশের প্রবাসী অঞ্চল হিসেবে পরিচিত সিলেট বিভাগে মাতৃ ও শিশু মৃত্যুর হার সবচেয়ে বেশি। বিভাগের জেলা সমুহের প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চল, হাওর এলাকা এবং সীমান্ত এলাকায় জনসচেতনতার অভাব এবং শিক্ষায় অনগ্রসরতার কারণে এই উদ্বেগজনক পরিস্থিতি বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। বিভাগের সুনামগঞ্জ জেলার হাওর অঞ্চলে উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার অভাবে অধিকাংশ মা ও শিশু স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। কারণ এ জেলার অনেকগুলো উপজেলা বর্ষাকালে পানির নিচে থাকে।

বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক এন্ড হেলথ সার্ভে-২০১১ এর তথ্য অনুযায়ী সারাদেশে প্রায় ৩৬ শতাংশ শিশু বয়সের তুলনায় কম ওজন নিয়ে জন্মায়। অথচ সিলেট বিভাগে এ হার ৪৫ শতাংশ। ৫ বছরের কম বয়েসি শিশু মৃত্যুর হার সারাদেশে ৪৮ শতাংশ হলেও সিলেটে এ হার ৭১ শতাংশ। নবজাতকের মৃত্যুর হার সারাদেশে গড় ৩২ শতাংশ হলেও সিলেট বিভাগে সর্বোচ্চ ৪৫শতাংশ। যদিও গত চার বছরে এ হার কিছুটা কমেছে কিন্তু সার্বিকভাবে সিলেটের চিত্র অভিন্ন। দেশের চট্টগ্রাম বিভাগেও অনুরূপ চিত্র পরিলক্ষিত হয়।

গত এক দশকে বাংলাদেশে মাতৃ ও শিশু মৃত্যুর হার কমলেও তা জাতিংঘের সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্য অর্জনের জন্য যথেষ্ট নয়। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে মাতৃ ও শিশু মৃত্যুর হার পুরো চিত্রটাই পাল্টে দিচ্ছে। তাই প্রত্যন্ত এলাকায় স্বাস্থ্য অবকাঠামো তৈরির পাশাপাশি চিকিত্সা ব্যবস্থা, নার্স ও দক্ষ সহায়তাকারীর সংখ্যা বাড়াতে হবে। পাশাপাশি জনসচেতনতা বাড়াতে, সমাজের প্রভাবশালী জনগোষ্ঠী এবং গণমাধ্যমকে বড় ভূমিকা রাখতে হবে বলেও বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।

আহমেদ নূর

ব্যুরোপ্রধান, কালের কণ্ঠ, সিলেট