'ডাবর', 'ফ্যাব ইন্ডিয়া', 'মান্যবর'-এর পরে সব্যসাচী মুখার্জী। ভারতে পরপর সরে গেছে বিজ্ঞাপন। কারণ অবশ্য একটাই, ধর্মীয় আবেগে আঘাতের অভিযোগ। আর সেই অভিযোগের অন্যতম সূত্র, বিজেপির অসন্তোষ। বিভিন্ন কারণ দেখিয়ে বিজেপি প্রতি ক্ষেত্রেই অভিযোগ তুলেছে ঐতিহ্য ও সংস্কার নষ্ট হওয়ার। আর সেই অভিযোগের চাপ এতই তীব্র, যে প্রতিক্ষেত্রেই বিজ্ঞাপন সরিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলি।
কোনও বিজ্ঞাপনে বিজেপির সমস্যার কারণ হয়েছে সম্ভারের নামে উর্দু শব্দের ব্যবহার, কোথাও সমস্যা সমকামী যুগলকে নিয়ে, কোথাও আবার সমস্যা অন্তর্বাস পরিহিতা অবস্থায় মঙ্গলসূত্র পরা নিয়ে। আর এইখানেই প্রশ্ন উঠেছে দেশের সাধারণ নাগরিকের বাকস্বাধীনতা নিয়ে। অনেকেই বলছেন, বিজ্ঞাপনে কোন ভাষা ব্যবহার করা হবে, কে কেমন পোশাক পরবেন, কে কাকে ভালবাসবেন-- এই সমস্তটাই ব্যক্তিগত স্বাধীনতার আওতায় পড়ে। এর উপর 'ফতোয়া' জারি করার অর্থ গণতন্ত্রের কণ্ঠরোধ করা।
অ্যাডভার্টাইজিং দুনিয়ার অন্যতম অভিজ্ঞ ব্যক্তিত্ব পীযূষ পাণ্ডে মনে করেন, আইন ও প্রশাসন যদি পক্ষে না থাকে, তাহলে এই ধরনের বিজ্ঞাপন চালিয়ে যাওয়া কঠিন। তাঁর কথায়, "কোনও বিজ্ঞাপনই চায় না সাধারণ মানুষের আঘাতের কারণ হতে। ফলে 'ভুল' স্বীকার করে কোনও বিজ্ঞাপন সরানোর মানে হয় না, নির্মাতাদের সুরক্ষার কথা ভেবেই সরিয়ে ফেলা ভাল যদি সরকার ও আইন এ বিষয়ে সমর্থন না করে।"
অ্যাডভার্টাইজিং জগতের আর এক ব্যক্তিত্ব অভিজিৎ প্রসাদের মতে, "বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে এমন একটা দুনিয়ার ছবি দেখানোর চেষ্টা করা হয়, যেখানে সাধারণ মানুষ বাঁচতে চায়। যেখানে বৈষম্য থাকে না। সেটা মেনে নিতে যদি অনেকের অসুবিধা হয়, তবে তা দুঃখজনক।"
সব্যসাচীর মঙ্গলসূত্রের বিজ্ঞাপন
সব্যসাচীর মঙ্গলসূত্রের বিজ্ঞাপনে ছিল কিছু অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ফ্রেম। একটি ছবিতে দেখা যায়, এক মহিলা মডেল কালো অন্তর্বাস পরে সব্যসাচীর ডিজাইন করা মঙ্গলসূত্র পরে রয়েছেন। ঘটনাচক্রে তাঁর গায়ের রং 'কালো' এবং তিনি 'স্থূলকায়'। অর্থাৎ গহনার মডেল বলতেই যে ছবি আমাদের চোখে ভাসে, তার চেয়ে আলাদা। তিনি সরাসরি চেয়ে রয়েছেন ক্যামেরার দিকে। লজ্জিত বা কুণ্ঠিত ভাবে নয়, রীতিমতো বোল্ড ভাবে। বিজ্ঞাপন নির্মাতাদের দাবি, এই বিষয়টিতেই আপত্তি সংকীর্ণমনা ডানপন্থীদের। কিন্তু বিজ্ঞাপন দেখে বলা হয়, মঙ্গলসূত্রের আড়ালে নগ্নতার প্রচার করছেন সব্যসাচী। এই নিয়েই তাঁরা প্রবল আপত্তি তুলেছেন।
ফ্যাব ইন্ডিয়ার বিজ্ঞাপন
ফ্যাব ইন্ডিয়ার বিজ্ঞাপনে আবার কাঠগড়ায় উঠেছিল উর্দু শব্দ। মূলত এথনিক পোশাকের জন্য ফ্যাব ইন্ডিয়া পরিচিত। দীপাবলির আগে 'জসন-ই-রিওয়াজ' নামে দিওয়ালি কালেকশন আনে সংস্থাটি। এই উর্দু নাম নিয়েই আপত্তি ওঠে সোশ্যাল মিডিয়ায়। দাবি করা হয়, এই নাম হিন্দুদের অনুভূতিতে আঘাত করে। হিন্দুদের উৎসব দীপাবলি, তার কালেকশনের নাম কীভাবে উর্দুতে দেওয়া হতে পারে, তাই নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। তীব্র জনরোষের মুখে টুইটার থেকে এই ক্যাম্পেনের ছবি সরিয়ে নেয় ফ্যাব ইন্ডিয়া।
ডাবরের বিজ্ঞাপন
ডাবরের বিজ্ঞাপনে দেখানো হয়েছে, দুই তরুণীর একজন অন্যজনের মুখে ক্রিম লাগিয়ে দিতে দিতে আলোচনা করছেন করবা চৌথ উৎসবের গুরুত্ব ও তার ব্যাখ্যা নিয়ে। সেই সময় আরও একজন মহিলা ওই দুই তরুণীকে শাড়ি উপহার দেন। এর পরে বিজ্ঞাপনের একেবারে শেষে দেখা যায়, ওই দুই তরুণী করবা চৌথ পালন করছেন, পরস্পরের মুখ দেখছেন। যা থেকে পরিষ্কার হয়ে যায়, তাঁরা দু’জন পরস্পরের ‘পার্টনার’। অর্থাৎ দুই সমকামী মেয়ে করবা চৌথ ব্রত পালন করছে পরস্পরের জন্য। এই বিজ্ঞাপনের বিরুদ্ধেও দাবি ওঠে হিন্দুত্বের অপমানের।
মান্যবরের বিজ্ঞাপন
মান্যবরের বিজ্ঞাপনে বিয়ের সময়কার ‘কন্যাদান'কে পিছিয়ে থাকা এক সংস্কৃতি হিসেবে দেখানো হয়েছিল এবং কন্যাদানের বদলে ‘কন্যামান' নামের একটি বিকল্প প্রথা শুরু করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল। বলা হয়েছিল, এই নতুন চিন্তা কন্যার সম্মানের কথা ভেবেই। তবে কন্যাদান এবং হিন্দু সংস্কৃতির বিরুদ্ধে মান্যবরের এই অভিযান নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় তুমুল সমালোচনা হয়। সেই একইভাবে হিন্দু ধর্মকে অপমান করার অভিযোগ ওঠে মান্যবরের বিরুদ্ধে।
ব্র্যান্ডের স্ট্র্যাটেজি নির্মাতা সিদ্ধান্ত লাহিড়ী এই বিষয়ে জানান, "প্রচলিত ভাবনার বাইরে কেউ কিছু প্রকাশ করলেই তারা টার্গেট হয়ে যাচ্ছে সনাতনপন্থীদের। এটা অসহিষ্ণুতা ছাড়া আর কিছু নয়। যা আমার সঙ্গে মিলছে না, তাই খারাপ, তাই অপমানজনক-- এমন ভাবনা ঠিক নয়। আর এই ভুল ভাবনা যেন বেশি জোর পায় সোশ্যাল মিডিয়াকে হাতিয়ার করে। কেউ কোনও কিছুর সঙ্গে একমত নাই হতে পারেন। কিন্তু কেউ একমত নন বলেই কাউকে সরে যেতে হবে, সরিয়ে ফেলতে হবে, এই ভাবনা খুবই বিপজ্জনক।"