অ্যাকসেসিবিলিটি লিংক

জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যুকে ঘিরে বর্ণবাদ নিরসণের দাবী গোটা বিশ্বে


যুক্তরাষ্ট্রের মিনেসোটায় পুলিশ হেফাজতে মৃত্যু হওয়া জর্জ ফ্লয়েডকে কেন্দ্র করে প্রতিবাদ বিক্ষোভ, শোক ও নিন্দার ঝড় যুক্তরাষ্ট্র থেকে ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বের নানা প্রান্তে। মেক্সিকো, স্পেনসহ বিশ্বের নানা স্থানে বর্ণবাদ নিরসণের দাবী উঠেছে।

আমাদের সহকর্মী মারিয়ামা দিয়ালো তার এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেন, যে পুলিশ কর্মকর্তা ডেরেক চাওভিন ৮ মিনিট ৪৬ সেকেন্ড, নিহত ফ্লয়েডের ঘাড় হাঁটু দিয়ে চেপে রেখেছিলেন, সেই ৮ মিনিট ৪৬ এখন প্রতিকী প্রতিবাদের সময় হয়ে উঠেছে।


যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক অধিকার নেতা রেভারেন্ড আল শার্পটন ফ্লয়েডের এক স্মরণ সভায় সকলকে বলেন, অনুভব করার চেষ্টা করুণ ৮.৪৬ মিনিট তার কেমন লেগেছিলো।

“এই লম্বা ৮ মিনিট আপনার শ্বাসরুদ্ধ থাকলে কেমন লাগে, ভাবুন সে কি জন্যে তখন জীবন ভিক্ষা চেয়েছিল। এটাকে বৃথা যেতে দিতে পারি না আমরা”।

মিনিয়াপোলিসের নর্থ সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটির ঐ স্মরণ সভায় হাজার হাজার মানুষ অংশ নেন। ফ্লয়েডের জন্ম, বেড়ে ওঠা ও মৃত্যু যে তিনটি শহরে তার সবগুলোতেই একটি করে স্মরণ সভা অনুষ্ঠিত হবে। এটি ছিল প্রথমটি।

বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে ফ্লয়েডের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে ২৫শে মে থেকে চলছে নানা প্রতিবাদ বিক্ষোভ। প্রথমদিকে যুক্তরাস্ট্রের বড় শহরগুলোতে ব্যাপক বিশৃংখলার সৃষ্টি হয়। কোথাও কোথাও বিক্ষোভকারীরা সহিংস হয়ে ওঠে, অনেক স্থানে ভাংচুর, মারামারি ও লুটপাট চলে। পরে কর্তৃপক্ষ বিপুল সংখ্যক নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য ও ন্যাশনাল গার্ড নিয়োগ করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। অনেক শহরে কার্ফিউ দিতে হয়।

যুক্তরাস্ট্র ছাড়িয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যুক্তরাস্ট্র দূতাবাস ও কন্সুলেটের সামনে প্রতিবাদ হয়। স্পেনের বার্সেলোনায় এক সভায় আয়োজক জোনাথন কোর্টনি বলেন,


“আমি আশাবাদী বিভিন্ন স্থানে এই মৃত্যুর বিচারের দাবীতে মানুষ সোচ্চার। তারা বলছেন যথেষ্ঠ হয়েছে। ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখাই যায়, যে কোনো পরিবর্তনের জন্যে এ ধরনের প্রতিবাদ অতীতেও হয়েছে। মানুষ রাজপথে নেমেছেন। জনগনের ক্ষমতা প্রমানিত হয়েছে বারবার। এজন্যই আমাদেরকে উঠে দাঁড়াতে হবে, সোচ্চার হতে হবে”।

ঐ সমাবেশে মত শত মানুষ মোমবাতি জ্বালিয়ে অংশ নেন।

মেক্সিকো সিটিতে একই ধরনের সমাবেশ হয়। আয়োজকরা সেই সমাবেশে জর্জ ফ্লয়েডসহ যারা একইভাবে মারা গেছেন তাঁদের নাম উচ্চারণ করেন। মোমবাতি জ্বেলে নিহতদের প্রতি শোক ও শ্রদ্ধা জানান।

ক্যালিফোর্নিয়ায় আমাদের সহকর্মী এলিজাবেথ লি তার এক প্রতিবেদনে জানান জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যুর পর যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন শহরে যে লুটপাট হয়, তার মধ্যে অভিবাসি অধ্যুষিত শহর লস এন্জেলেস ছিলো অন্যতম প্রধান একটি শহর যেখানকার অধিবাসিরা সহিংসতা ও লুটপাটের ভয়ে একটি রাত পার করেন ভয় ও শংকায়। সেই রতের চিত্র সেখানকার অনেককেই মনে করিয়ে দেয় অতীতের ভয়াল স্মৃতি।

ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ও ক্যাম্বোডিয়ার রুম্পো চিম তাদের একজন। বাস করেন লস এন্জেলেস শহরে। লং বীচে তার ব্যবসা।


“ভীষণ আতংকিত হই। ভাংচুর লুটপাটের অবস্থা ছিলো সিনেমার দৃশ্যের মতো”।

চিম বলেন সেই রাতে লুটেরারা ডাম বাম চতুর্দিক থেকে আসছিলো। ভয়ে সে তার রেস্টুরেন্ট ফেলে জীবন রক্ষার্থে পালিয়ে যান। পরে যখন ফিরে আসেন, তার রেস্টুরেন্ট তছনছ অবস্থায় পান। তার বোনের জুয়েলারীর দোকান পুড়িয়ে দেয়া হয়।

“ক্যাম্বোডিয়ায় আমরা গণহত্যা থেকে বেঁচে এসে এখানে আশ্রয় নিয়েছিলাম। আমার বয়স তখন কম ছিলো। তখন অনেক মার খেয়েছি। যুক্তরস্ট্রে এসে নিরাপদ পরিবেশে বড় হই- অথচ এখন।”

স্মৃতিচারণ করেন চিম আবেগী কন্ঠে।

চিমের প্রশ্ন, এখন যে আন্দোলন চলছে তাতে বলা হচ্ছে, ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার। তাহলে এশিয়ান বংশোদ্ভূত যারা আছেন বা অভিবাসী সম্প্রদায়ের ওপর কেনো এই অন্যায়?

চিমের মতো লং বিচের বহু ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীর একই অবস্থা। ১৯৭০ এর দশকে ক্যাম্বোডিয়ার গণহত্যা থেকে বেঁচে এখানে এসে আশ্রয় নিয়ে নানা ধরনের ক্ষুদ্র ব্যবসায় জড়িত তারা। চিমের মতে এটা সত্য যে অভিবাসি হিসাবে তারা নানা ধরনের বর্ণবাদের শিকার। এই লুটপাটও তাদের প্রতি এক ধরনের অন্যায় অবিচার।

চার্লস সং একজন সমাজ কর্মী। তার মতে, “এই ঘটনা শুধু আফ্রিকান আমেরিকানদের ক্ষতি করছে তা নয়; সকল সংখ্যালঘূ সম্প্রদায় এই ক্ষতির শিকার। আমরা অনেকেই এতে ক্ষতিগ্রস্থ। অনেকেই হয়তো জানাচ্ছেন না। কিন্তু ক্ষতি হয়েছে”।

চার্লস সং বলেন অতিতেও এমন হয়েছে। ১৯৯০ এর দিকে তিনি ক্ষুদ্র ব্যবসা করতেন তখন লস এন্জেলেসে দাঙ্গা হয় এবং তখন তার ব্যবসার ক্ষতি হয়।

“আমি স্মরণ করতে পারি তখন আমি ও আমার এক বন্ধু ছাদে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলাম। আমার কাছে একে ৪৭ ছিলো, বন্ধুর কাছে ছিল শটগান। তখন যে যেভাবে পারে নিজেদেরকে রক্ষা করেছিলেন; সেই ব্যবসা আর বন্ধুর এখনো আছে”।

তবে তার ভয়, এবার অনেকেই এমনভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছেন যে তারা আর তাদের ব্যবসা পুণ:প্রতিষ্ঠা করতে পার এন কিনা সন্দেহ।

“যা হয়েছে তা হয়েছে; আমি এখন ভিত সন্ত্রস্ত”। আমি জানি লুটাররা মনে ব্যা্থা পেয়ছেন, আমাদের ক্যাম্বোডিয়ানরাও ব্যা্থিত। আফ্রিকান আমেরিকানরা ব্যাথিত। কিন্তু এর সমাধান সকলের ঐক্য। তাদেরকে অভিযুক্ত করতে চাইনা। অভিযুক্ত করতে চাই এর পেছনের কারনকে।

সং বলেন আন্দোলন করতে হবে অহিংস, এভাবে নয়।

আমাদরের আরেক সহকর্মী জেসাসমেন ওনি তার এক প্রতিবেদনে জানান, জর্জ ফ্লয়েডের স্মরণ সভায় দল মত নির্বিশেষে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা কর্মী ও নানা শ্রেনী পেশার মানুষ অংশ নেন।

মিনিয়াপোলিসে অনুষ্ঠিত বৃহস্পতিরের ঐ স্মরণ সভায় শতম শত মানুষ ফ্লয়েডের প্রতি শদ্ধা জানান।

ওয়াশিংটনে সেনেট ডেমোক্রেটরা ৮ মিনিট ৪৬ সেকেন্ডের নীরবতা পালন করে শ্রদ্ধা প্রদর্শন করেন ফ্লয়েডের প্রতি।

সেনেটর কোরি বুকার বলেন, “আমরা সমবেত হয়েছি তাঁর বিদেহী আত্মার শান্তি কামনার জন্যে”।

রাজধানী ওয়াপশিংটনের বিভিন্ন স্থানে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার দাবীতে প্রতিবাদ সমাবেশ অব্যাহত রয়েছে।

পুলিশ কাস্টডিতে মারা যাওয়া জর্জ ফ্লয়েডের প্রতি শোক ও নিন্দা করেছেন ডেমোক্রেট ও রিপাব্লিকান আইনপ্রণেতারা। ওই ঘটনায় সংশ্লিষ্ট চার পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধেই অভিযোগ দাখিল করা হয়েছে।

সাউথ ক্যারোলাইনার রিপাব্লিকান সেনেটর লিন্সসে গ্রাহাম বলেন, “এটি এই দেশে দীর্ঘ সময় ধরে থাকা একটি বিষয় যা আবারো ওয়েকাপ কলের মতো মনে করিয়ে দিলো যে পুলিশ কাস্টডিতে আফ্রিকান আমেরিকান মৃত্যুর ঘটনা এখানে আরো অনেক ঘটেছে”।

ইলিনয় ডেমোক্রেট আইনপ্রণেতা ডিক ডারবিন বলেন, “আজ আমরা আমাদেরকে প্রশ্ন করতে পারি- আমাদের ন্যায় বিচারের প্রক্রিয়া কি বর্ণবাদ দ্বারা এমনভাবে সংক্রমিত যে আমাদের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ কাজ করছে না?”

ফ্লয়েডের মৃত্যুকে ঘিরে ফুঁসে ওঠা সংঘাত সহিংসতা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন শীর্ষ রিপাব্লিকান নেতারাও। সেনেট মেজরিটি লীডার মিচ ম্যাককনেল বলেন, “পৃথিবির কোথাও এমন অভিযোগের নজীর নেই যে সামান্য অপরাধে পুলিশ একজনকে গ্রেফতার করে হাটু দিয়ে তার ঘাড় চেপে রাখবে প্রায় নয় মিনিট, আর সে দম নিতে পারছি না বলে আকুতি জানাবে এবং এক সময় নিস্তব্ধ হয়ে যাবে”।

রিপাব্লিকান নেতারা ফ্লয়েডের মৃত্যুর নিন্দা শোক এবং তার পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানালেও, ঘটনার পর উদ্ভুত পরিস্থিতে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের কার্যক্রমের তেমন সমালোচনা কেউ করেন নি।

রিপাব্লিকান সেনেটর টম কটন প্রেসিডেন্টের প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করে ফক্স নিউজে দেয়া সাক্ষাৎকারে কথা বলেছেন।

কংগ্রেশনাল ডেমোক্রেটরা নিন্দা করছেন, সমালোচনা করেছেন। নিউইয়র্ক সেনেটর কিরস্টেন জিলিব্রান্ড বলেন, “আমরা সমালোচনা করতে পারি। পুলিশের শরীরে ক্যামেরা রাখাটা অবশ্য করনীয় করতে পারি। ঘটনার প্রতিবেদন দাখিলকে অবশ্য করনীয় করা দরকার। আইন পরিবর্তন করতে পারি, যেনো এসব মামলা আরো গুরুত্ব দিয়ে দেখা হয়”।

গত কয়েকদিন ধরে যুক্তরাষ্ট্রে চলমান অবস্থার নিরিখে রিপাবলিকান ও ডেমোক্রেট নেতা কর্মীরা দেশে শান্তি শস্তি ও নিরাপত্তা ফিরিয়ে আনার নানা প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছেন।

XS
SM
MD
LG