গত এক বছরে বিভিন্ন কারণে শতাধিক শিক্ষার্থী আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছেন। এই শিক্ষার্থীদের বেশির ভাগই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের। বেসরকারি সংস্থা আঁচল ফাউন্ডেশন শনিবার জানিয়েছে, সংবাদমাধ্যমে আসা তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে ২০২১ সালে ১০১ জন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। এর মধ্যে ৬২ জন বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিলেন। সংস্থাটি বলছে, এক বছরে এতো শিক্ষার্থী আগে কখনো আত্মহত্যা করেননি। বিষয়টিকে উদ্বেগজনক বলে বর্ণনা করেছেন মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, শিক্ষার্থীরা কেন আত্মহত্যা করছে তা খুঁজে বের করা জরুরি। একইসঙ্গে এই আত্মহত্যার প্রবণতা ঠেকাতে উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন। এই আত্মহত্যা প্রবণতার পেছনে বেশ কিছু কারণও চিহ্নিত করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগের অধ্যাপক কামাল উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী বলেন, "বাংলাদেশে গত কয়েক বছরের আত্মহত্যার পরিসংখ্যান বিশেষত কোভিড পরিস্থিতিতে এই বিষয়ের পরিসংখ্যান এবং তার ফলাফল যথেষ্ট ভীতিকর। কোভিড-১৯ ভাইরাস নিয়ে আমরা যতখানি আতঙ্কিত, আত্মহত্যায় মৃত্যুবরণ করা মানুষকে নিয়ে কিন্তু আমরা ততটা চিন্তিত নই"।
তিনি বলেন, "বিভিন্ন সমীক্ষা বলছে, শিক্ষা সংক্রান্ত চাপ, বিভিন্ন পরীক্ষায় ব্যর্থতা, পরিবারের সঙ্গে অভিমান, প্রেমঘটিত সম্পর্কের বিচ্ছিন্নতা, একাকিত্ব ইত্যাদি কারণ আত্মহত্যার জন্য দায়ী। এই আত্মহত্যার প্রবণতা রোধ করতে সরকারি এবং বেসরকারি পর্যায়ে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে"।
রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মানসিক রোগ বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ডা. জ্যোতির্ময় রায় মনে করেন, করোনার কারণে একটা অস্বাভাবিক সময় যাচ্ছে। ফলে শিক্ষার্থীদের মাঝে মানসিক চাপ বাড়ছে। এই মানসিক যন্ত্রণার বহিঃপ্রকাশ আত্মহত্যা। তিনি বলেন, "বাংলাদেশে মানসিক রোগের চিকিৎসা করানোকে অন্যায় ভাবা হয়। আত্মহত্যা ঠেকাতে মানসিক রোগের চিকিৎসা ব্যবস্থাকে উন্নত করতে হবে। মানুষকে সচেতন করতে হবে"।
শনিবার এক ভার্চ্যুয়াল সংবাদ সম্মেলনে আঁচল ফাউন্ডেশন জানায়, ২০২১ সালে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার ঘটনাগুলো সমন্বয় করে দেখা যায়, সবচেয়ে বেশি ৬২ জন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। যা মোট আত্মহত্যার ৬১.৩৯ শতাংশ। এছাড়াও মেডিকেল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ১২ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেন। এটি মোট আত্মহত্যার ১১.৮৮ শতাংশ। প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে ৪ জন এবং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৩ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন।
সংস্থাটির তথ্য অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয়গুলির মধ্যে সবচেয়ে বেশি আত্মহত্যা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের মোট ৯ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। এছাড়া জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ৬ জন, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ৫ জন এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪ জন শিক্ষার্থী আত্মহননের পথ বেছে নেন।
আত্মহত্যাকারীদের বয়সভিত্তিক তথ্য পর্যালোচনা করে আঁচল ফাউন্ডেশন জানিয়েছে, ২২ থেকে ২৫ বছর বয়সীদের মধ্যে আত্মহত্যা প্রবণতা তুলনামূলকভাবে বেশি। এই বয়সের ৬০ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। এটি মোট ঘটনার ৫৯.৪১ শতাংশ। অন্যদিকে, ১৮ থেকে ২১ বছর বয়সী তরুণদের আত্মহত্যার ঘটনা মোট সমন্বয়কৃত ঘটনার ২৬.৭৩ শতাংশ। ২৬ থেকে ২৯ বছর এবং ২৯ বছরের ঊর্ধ্বে এই হার যথাক্রমে ৯.৯০ শতাংশ এবং ৩.৯৬ শতাংশ।
সংস্থাটি জানায়, সাধারণত নারী শিক্ষার্থীদের মাঝে আত্মহত্যার হার বেশি দেখা গেলেও এবারের সমন্বয়কৃত তথ্য থেকে দেখা যায়, গত বছর আত্মহত্যাকারীদের একটা বড় অংশই ছিলেন পুরুষ শিক্ষার্থী। ১০১ জনের মধ্যে এই সংখ্যা ছিল ৬৫। আত্মহত্যার কারণ বিশ্লেষণ করে সংগঠনটি জানায়, অনার্স পড়ুয়া ৩য় এবং ৪র্থ বর্ষের শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মহত্যার হার তুলনামূলক বেশি। এই শিক্ষার্থীদের পেশায় যোগদানের জন্য সামাজিক চাপ বেশি থাকে এবং ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তার কারণে তাদের মধ্যে হতাশার ছাপ বেশি দেখা যায় বলে আঁচল ফাউন্ডেশন মনে করে।
আত্মহত্যাকারীদের ওপর জরিপ তথ্য অনুযায়ী প্রেমের সম্পর্কগত কারণে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন ২৪.৭৫ শতাংশ শিক্ষার্থী এবং পারিবারিক সমস্যার কারণে এ পথে ধাবিত হয়েছেন ১৯.৮০ শতাংশ। মানসিক যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে ১৫.৮৪ শতাংশ শিক্ষার্থী বেছে নিয়েছেন আত্মহননের পথ। পড়াশোনা সংক্রান্ত কারণে আত্মহত্যা করেছেন ১০.৮৯ শতাংশ। আর্থিক সমস্যা কবলিত হয়ে আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছেন ৪.৯৫ শতাংশ। সমন্বয়কৃত তথ্য থেকে আরও দেখা যায়, মাদকাসক্ত হয়ে নির্বিকারে নিজের জীবন হননের পথ বেছে নিয়েছেন ১.৯৮ শতাংশ শিক্ষার্থী। এছাড়া অন্যান্য কারণে আত্মহত্যা করেছেন ২১.৭৮ শতাংশ শিক্ষার্থী।
আঁচল ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি তানসেন রোজ বলেন, অনিশ্চিত ভবিষ্যতের জন্য শিক্ষার্থীদের যুগোপযোগী হিসেবে গড়ে তুলতে না পারায় আত্মহত্যা বেড়ে যাচ্ছে। পত্রিকা বিশ্লেষণ করে এটা স্পষ্ট যে, আত্মহত্যার কারণগুলো বাইরে থেকে যতটা দেখা যাচ্ছে, সমস্যা তার চেয়েও গভীর। নতুন পরিস্থিতির সাথে খাপ খাওয়ানোর প্রয়োজনীয় শিক্ষার সুযোগ অপর্যাপ্ত তাই তাদের জীবনে অপ্রত্যাশিত কিছু ঘটলে তারা সেটা সামলাতে পারে না। প্রেমে বিচ্ছেদ হলে তারা যেমন ভেঙে পড়ে, তেমনি পরীক্ষায় খারাপ ফলাফলও তাদেরকে আশাহত করে। দ্রুত সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণের প্রতি জোর দিয়ে তিনি বলেন, শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার ঘটনাগুলো চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে যে, এখনই পদক্ষেপ নিতে না পারলে পরবর্তীতে আমাদের অনুশোচনা করতে হবে।