অ্যাকসেসিবিলিটি লিংক

সিংহাসনে রানী এলিজাবেথের সাত দশক পূর্ণ


সিংহাসনে রানী এলিজাবেথের সাত দশক পূর্ণ হওয়া উপলক্ষ্যে লন্ডনের বাকিংহাম প্যালেসে রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথ। (ছবি- ইউই মক/ পুল ফটো/ এপি)
সিংহাসনে রানী এলিজাবেথের সাত দশক পূর্ণ হওয়া উপলক্ষ্যে লন্ডনের বাকিংহাম প্যালেসে রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথ। (ছবি- ইউই মক/ পুল ফটো/ এপি)

ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অধিপতি হওয়ার কথা ছিল না তার। কিন্তু বাধ সাধে নিয়তি। তিনি অধিষ্ঠিত হন পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিধর ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সিংহাসনে। রবিবার ৭০ বছর পূর্ণ হলো রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথের শাসনের।

গত ৭০ বছরে মণিমুক্তাখচিত মুকুট পরা আকর্ষণীয় তরুণী রানী থেকে সম্প্রতি জাতির পিতামহী হয়েছেন তিনি। দেখেছেন ব্রিটিশ উপনিবেশের পতন, বহু সংস্কৃতিবাদের আবির্ভাব, সন্ত্রাসবাদের উত্থান, ব্রেক্সিট নিয়ে দর কষাকষি এবং সাম্প্রতিক কোভিড-১৯ অতিমারি। সদা পরিবর্তনশীল বিশ্বে তিনি থেকেছেন অবিচল- রাজনৈতিক কোন্দলের ঊর্ধ্বে থেকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ব্রিটেনের স্বার্থ উপস্থাপন করেছেন। দেশের সাফল্যে উচ্ছ্বসিত হয়েছেন, ব্যর্থতায় দিয়েছেন সান্ত্বনা।

তার পুর্ববর্তী শাসকদের যেমন “দিগবিজয়ী উইলিয়াম”, “পুরোহিত এডওয়ার্ড” এবং “মহান আলফ্রেড”–এর মতো রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথেরও রাজকীয় উপাধি পাওয়া উচিত বলে মন্তব্য করেন ইতিহাসবিদ হুগো ভাইকারস।

“আমার সবসময় মনে হয়েছে তার উপাধি হওয়া উচিত “অবিচল এলিজাবেথ”, এপি সংবাদ সংস্থাকে বলেন ভাইকারস। “তার জন্য এটা উপযুক্ত উপাধি। তার রানী হওয়ার কথা ছিল না, অথচ তিনি সফলভাবেই সেই দায়িত্ব পালন করেছেন।”

দ্বিতীয় এলিজাবেথ ছিলেন রাজা পঞ্চম জর্জের দ্বিতীয় পুত্রের জ্যেষ্ঠ কন্যা। ৯৫ বছর বয়সী রানীর জন্ম ১৯২৬ সালের ২১ এপ্রিল। রাষ্ট্রীয় বাড়ি, আস্তাবলে ঘোড়া, পোষা কুকুর আর একজন উপযুক্ত স্বামী-এমনই একটা জাঁকজমকহীন তবে স্বাচ্ছন্দ্য জীবন হতে পারত তার।

অথচ এক দশকের মধ্যেই বদলে যায় পট। তার চাচা রাজা তৃতীয় এডওয়ার্ড যুক্তরাষ্ট্রের এক তালাকপ্রাপ্ত নারী ওয়ালিস সিম্পসনকে বিয়ে করতে রাজসিংহাসন ত্যাগ করেন। তখন রাজা হন দ্বিতীয় এলিজাবেথের বাবা রাজা ষষ্ঠ জর্জ। ভবিষ্যৎ রানী হওয়ার পথ খুলে যায় ষষ্ঠ জর্জের জ্যেষ্ঠ কন্যার।

২০১০ সালে মুক্তি পাওয়া চলচিত্র “দ্য কিংস স্পিচ” থেকে রাজা ষষ্ঠ জর্জের তোতলা হওয়ার কথা জানা যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় লন্ডনে বোমা নিক্ষেপিত হলেও রাজধানী ছেড়ে যাননি এই সমাদৃত রাজা।

দেশ শাসনে বাবার পদাঙ্ক অনুসরণ করেন দ্বিতীয় এলিজাবেথ। রাজপরিবার থেকে প্রথম নারী সদস্য হিসেবে ১৯৪৫ সালে অক্সিলিয়ারি টেরিটোরিয়াল সার্ভিসে যোগদান করেন তিনি। তার ২১তম জন্মদিনে তিনি দেশ এবং এক সময় ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অধীনে থাকা দেশগুলো নিয়ে গঠিত কমনওয়েলথের জন্য নিজের জীবন উৎসর্গের প্রতিজ্ঞা করেন।

১৯৫২ সালে অসুস্থ বাবাকে রেখে কমনওয়েলথ দেশগুলো সফরে বের হন তিনি। স্বামী প্রিন্স চার্লসের সঙ্গে কেনিয়ায় অবস্থানকালে বাবার মৃত্যু সংবাদ শোনেন তিনি।

অনতিবিলম্বে সফর বাতিল করে লন্ডনে ফেরেন তিনি। কালেভদ্রে মুকুট এবং রাজদণ্ড হাতে দেখা গেলেও, বেশিরভাগ সময় চওড়া পাড়ের হ্যাট এবং সাধারণ ব্যাগ নিয়ে ঘোরেন তিনি।

সাত দশকের শাসনকালে রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথের অধীনে ১৪ জন প্রধানমন্ত্রী কাজ করেছেন এবং রানী যুক্তরাষ্ট্রের ১৩ জন প্রেসিডেন্টের সঙ্গে সাক্ষাত করেছেন।

বছরে একবার বাকিংহাম প্যালেস থেকে হাউস অব লর্ডসে সংসদের অধিবেশনের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করতে যান রানী। বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধানদের সন্মানে আয়োজন করেন রাজকীয় ভোজের।

১৯৫৬ সালে মিসর ব্রিটেনের কাছ থেকে সুয়েজ খাল কেড়ে নেয়। ১৯৮০ সালে হয় শ্রমিক বিদ্রোহ। ২০০৫ সালে লন্ডনে সন্ত্রাসী হামলা হয়। তার দীর্ঘতম শাসনকালে সবকিছু প্রত্যক্ষ করেও রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথ থেকেছেন অবিচল।

অতিমারির সময় স্বামী প্রিন্স ফিলিপের শেষকৃত্যে আর দশজন সাধারণ নাগরিকের মতো কোভিড বিধিনিষেধ এবং শারীরিক দুরত্ব মেনে কালো রঙের মাস্ক পরে বসেছিলেন তিনি।

সাংবাদিক এমিলি ন্যাশ হ্যালো ম্যাগাজিনে লেখেন, “কোনোরকম আপত্তি ছাড়াই নিজের দায়িত্ব পালন করেন তিনি। আর সে কারণেই লোকে তাকে সন্মান করেন।”

তাকে নিয়ে বিতর্কও কম নয়।

১৯৯০ সালে রানীর ব্যক্তিগত সম্পদ এবং রাজতন্ত্রের খরচ নিয়ে ব্যপক সমালোচনা শুরু হয় গণমাধ্যমে। ১৯৯২ সালে রানী তার পরিবারের বেশিরভাগের খরচ বহনে রাজি হন এবং ১৯৩০ সালের পর প্রথম কোনো রানী হিসেবে কর দিতে সম্মত হন।

১৯৯৭ সালে প্রিন্স চার্লসের সাবেক স্ত্রী প্রিন্সেস ডায়ানার দুর্ঘটনা এবং মৃত্যু নিয়ে রাজপরিবারের নীরবতায় ক্ষুদ্ধ হন ডায়ানার ভক্তরা।

এমনকি সম্প্রতি রানীর দ্বিতীয় পুত্র প্রিন্স অ্যান্ড্রুর বিরুদ্ধে আনা হয়েছে যৌন হয়রানির অভিযোগ। অন্যদিকে রাজ পরিবারের দুই সদস্য, রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথের পৌত্র প্রিন্স হ্যারি এবং তার স্ত্রী মেগান রাজতন্ত্রের পদ ছেড়ে ক্যালিফোর্নিয়ায় বসবাস করছেন।

সকল সমালোচনা উপেক্ষা করে সমান জনপ্রিয় রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথ, জনমত প্রতিষ্ঠান ইপসোস ইউকের সিইও কেলি বিভার বলেন।

রবিবারের আয়োজন রানীর জন্য মিশ্র এক আবেগের দিন। এদিনে তার ৭০ বছরের শাসনকাল পূর্ণ হয়েছে, আবার এই একই দিনে তার বাবা ষষ্ঠ জর্জের ৭০তম মৃত্যুবার্ষিকী।

ভাইকারসের ভাষায়, “আমার সবসময় মনে হত, তার জীবনের অন্যতম দর্শন হয়তো নিজেকে অত্যন্ত ভালো সন্তান হিসেবে প্রমাণ করা এবং তার বাবার সব স্বপ্ন পূরণ করা। যদি ধরে নিই পরজন্ম বলে কিছু আছে এবং সেখানে যদি আবার বাবা কন্যার দেখা হয়, ষষ্ঠ জর্জ নিশ্চয় তার কন্যাকে তার কর্মের জন্যে ধন্যবাদ জানাবেন।”

XS
SM
MD
LG