অ্যাকসেসিবিলিটি লিংক

ভালোবাসার দিনটিই যাদের বিয়ে বার্ষিকী 


বিবাহ বন্ধনে দম্পতি। (ছবি- অ্যাডোবি স্টক)
বিবাহ বন্ধনে দম্পতি। (ছবি- অ্যাডোবি স্টক)

মাশফিক ও শাজমি

মাশফিক ও শাজমি
মাশফিক ও শাজমি

ফোন রিসিভ করতেই অপরপ্রান্ত থেকে বসন্তের শুভেচ্ছা পাওয়া গেল। ধন্যবাদ জানিয়ে পাল্টা বিবাহবার্ষিকীর শুভেচ্ছা জানালাম। খানিক আলাপের পরেই জানালেন, তারা এই মুহূর্তে রয়েছেন গাজীপুরের একটি অবকাশ কেন্দ্রে। বলছিলাম, মাশফিক আহমেদ এবং শাজমি তৌহিদ ঐশ্বর্য দম্পতির কথা। বিবাহবার্ষিকীর দিনটি নিজেদের মতো উদযাপন করতে শহরের বাইরে গিয়েছেন তারা।

মাশফিকের গ্রামের বাড়ি ফেনী। শাজমি বরিশালের মেয়ে। দুজনেই পড়াশোনা করেছেন ঢাকার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে। একই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার সুবাদে দুজনের পরিচয় ও জানাশোনা।

মাশফিক বললেন, "যা হয় আরকি! ও আমার জুনিয়র ছিল ভার্সিটিতে। কথা বলতে বলতে একসময় মনে হল ওকে আমার ভালো লাগে। তারপরে আমরা সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ি। সেটা ২০১৮ এর দিকের ঘটনা। আমরা বিয়ে করলাম ২০২০ এর ১৪ ফেব্রুয়ারি, ভালোবাসা দিবসের দিন। দিনটিকে স্মরণ করে রাখতেই এই দিনে বিয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম আমরা।"

মাশফিক যখন অল্প সময়েই পুরো ঘটনা বলে ফেললেন, তখনই পাশ থেকে শারমিন বলতে শুরু করলেন। "আমরা প্রথমে সাতদিন টানা চ্যাটিং করেছি ফেসবুকে। আমার এখন মনে হয়, আমরা ঘুমানো ও গোসল করা ছাড়া সারাক্ষণই চ্যাট করতাম। ও কোথায় যাচ্ছে, কী করছে সব জানাচ্ছে। কোন রাস্তায় যানজটে বসে আছে সব ছবি তুলে তুলে পাঠাতো। আমিও কোথায় গেলে সবকিছু ছবি তুলে দিতাম। এভাবে সারাক্ষণই একে অপরের খবর জানা হত। একটা পর্যায়ে সাতদিন পার হওয়ার পরে আমরা পরস্পরের ফোন নাম্বার আদান-প্রদান করি। তখন শুরু হয় ফোনে কথা বলা আর মেসেজ করা। এভাবে প্রথমে ওর গ্রাজুয়েশন শেষ হল। আমার আরও বাকি আছে। ও তখন টিউশনি করতো। আমাদের বাসায় বিয়ের প্রস্তাব দেওয়া হলো। আমার আম্মু বলে দিলেন, চাকরি না পাওয়া পর্যন্ত বিয়ে হবে না। আমাকে মাশফিকের আম্মা, এখন যিনি আমার শাশুড়ি তিনি প্রথমবার দেখেই পছন্দ করলেন। কিন্তু মাশফিকের চাকরি না হওয়ায় বিয়ে করা সম্ভব হলো না। এভাবে সময় কাটতে থাকে। আমার সাথে ওর মাঝেমাঝেই ঝগড়া হতো। আমি বলতাম ব্রেকাপ। মাশফিক মেনে নিত। বলতো, আচ্ছা ব্রেকাপ। কিন্তু সন্ধ্যাার পরেই দেখা যেত আমাদের বাসার নিচে এসে দাঁড়িয়ে আছে। এভাবে আমাদের অসংখ্যবার ব্রেকাপ হয়েছে। তবে কোনোবরাই ব্রেকাপ একদিন অতিক্রম করতে পারেনি।"

নিজেদের বিয়ের দিনটির কথা স্মরণ করে শারমিন বললেন, "বেশ কিছুদিন পরে মাশফিকের চাকরি হয়ে গেল। মাশফিকের মা আমাদের বাসায় আবার প্রস্তাব দিলেন। পরে দিন তারিখ ঠিক করার পালা ঘনিয়ে এলো। মাশফিক বললো, লিপ ইয়ারে (২৯ ফেব্রুয়ারি) বিয়ে করবে। কিন্তু আমি কিছুতেই রাজি হলাম না। পরে তারিখ ঠিক করা হলো ১৪ ফেব্রুয়ারি।"

১৪ ফেব্রুয়ারি দিনটিকে কেন বেছে নিয়েছিলেন এমন প্রশ্নে জবাবে দুজনেই বললেন, এই দিনটি ভালোবাসার মানুষকে আজীবন পাশে পাওয়ার একটি প্রতিশ্রুতি করার দিন হিসেবে তারা বেছে নিতে চেয়েছিলেন।

ইরা ও মামুন

ইরা ও মামুন
ইরা ও মামুন

ভালোবাসা দিবসের বিয়ের গল্প শুনতে গিয়ে ইরা ইব্রাহিম এবং মাহমুদুল হাসান মামুন দম্পতির কথা জানা গেল। তাদের গল্পটি অন্যরকম। ইরা এখন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মানবসম্পদ বিভাগে কাজ করেন। অপরদিকে মামুন আরেকটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন।

মুন্সিগঞ্জের মেয়ে ইরার জন্ম ও বেড়ে ওঠা চট্টগ্রামে। আবার মামুনের বাড়ি কুমিল্লায়। মামুনের বেড়ে ওঠা একই শহরে, অর্থাৎ চট্টগ্রামে। ইরা এবং মামুনের পরিচয় কর্মসূত্রে। ইরা যখন চাকরিতে জয়েন করলেন তখন সেখানে পরিবহন এবং অ্যাকাউন্টস বিভাগে কাজ করতেন মামুন। একসময়ে দুজনের মধ্যে সম্পর্ক গড়ে ওঠে। ভালোবেসে তারা বিয়ে করেছেন ২০১৫ তে। তারা দুজনেই চেয়েছিলেন ভালোবাসা দিবসের দিন বিয়ে করবেন। সেজন্য দুজনে নানা পরিকল্পনা করতে শুরু করেন। দুজনেই বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত হওয়ায় ছুটি এবং অন্যান্য বিষয়ে একইভাবে প্ল্যান করতে শুরু করেন। কিন্তু বিয়ের দিন ঘনিয়ে আসতেই আপত্তি ওঠে পরিবার থেকে। এই দুই পরিবারের আপত্তির ধরনটা একটু ভিন্ন। ২০১৫ এর ১৪ ফ্রেবুয়ারি ছিল শনিবার। এভাকেই দুই পরিবারের মুরব্বিদের আপত্তি। কোনোভাবেই শনিবার বিয়ের মতো শুভকাজ হওয়া যাবে না। তাই পরিবারের মুরুব্বিদের কথা রাখতে গিয়ে একদিন আগে ১৩ ফেব্রুয়ারি শুক্রবার বিয়ের তারিখ ঠিক করা হয়।

তখন ১৩ ফেব্রুয়ারি আবার বাংলা মাসের ১লা ফাল্গুন উদযাপন করা হতো। এখন চলতি বছর থেকে বাংলা একাডেমি নতুন ক্যালেন্ডার করায় পহেলা ফাল্গুন এবং ভালোবাসা দিবস একই দিনে এসে পালিত হচ্ছে। তাই এবারের বিয়ে বার্ষিকীটি তাদের কাছে নতুনভাবে হাজির হয়েছে। ৭ বছরের দাম্পত্য জীবনে একবারের জন্যও মনে হয়নি, তারা ভালোবাসাহীন থেকেছেন একটি দিন। তাই ভালোবাসা দিবসে বিয়ে করতে না পারার কষ্টটাও তারা সেভাবে অনুভব করেন না।

তানভীর ও শারমীন

তানভীর ও শারমীন
তানভীর ও শারমীন

তানভীর আলম এবং শারমীন সুলতানার বিয়ে হয়েছে ২০১৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি। তাদের সন্তান রায়মান এর জন্ম ২০১৭ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি। নিজেদের বিবাহ বার্ষিকীতে আদরের সন্তান জন্ম নেওয়ার ঘটনাটি এই দম্পতির কাছে সেরা উপহার।

তানভীর এবং শারমীনের পরিচয় ২০০২ এর দিকে। তাদের বিয়ে হয়েছে ২০১৩তে। এইচএসসি পাশের পর তানভীর উচ্চশিক্ষার জন্য যান লন্ডনে। অপরদিকে শারমীন ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগে। দুইজন দুইদেশে থাকলেও তাদের সম্পর্কে কোনো বদল ঘটে নি। দূরত্ব দুজনকে আরও গভীরভাবে অনুভব করার সুযোগ করে দেয়। পড়াশোনা শেষ করে তানভীর দেশে ফিরেন ২০১৩ এর দিকে। ততদিনে শারমীনেরও পড়াশোনা শেষ হয়েছে। মাঝে শারমীনের অন্যত্র বিয়ের জন্য পরিবারের চাপ ছিল। কিন্তু শারমীন তা এড়িয়ে গেছেন।

অবশেষে দুই পরিবারের সিদ্ধান্তে নিজেদের জানশোনার প্রায় এক যুগের মতো কাছাকাছি সময়ে তারা বিয়ে করেন ভালোবাসা দিবসের দিনে। আবার একইদিনে তাদের সন্তান জন্ম হওয়ায় এই দিনটি তাদের কাছে আরও বেশি আনন্দের।

বিশেষজ্ঞরা যা বলছেন

ভালোবাসা দিবসে এমন আরও অনেক বিয়ের নজির আছে। প্রত্যেকের গল্প হয়তো আলাদা আলাদা। কিন্তু মূল সুর একই। অর্থাৎ, বিশ্বব্যাপী ভালোবাসার দিবস হিসেবে স্বীকৃত দিনটিতে প্রেমিক-প্রেমিকারা নিজেদের আজীবন পাশাপাশি রাখার প্রতিশ্রুতি দেওয়ার জন্য ১৪ ফেব্রুয়ারিকে বেছে নিচ্ছেন। তাই এই দিবসটি প্রিয়জনের হাত শক্ত করে ধরে রাখার অঙ্গীকার করারও দিন।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোরোগবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ডা. সুলতানা আলগীন বলেন, "সহজে বলতে গেলে মানুষ সাধারণত একটি কমন বিষয়ে আগ্রহী হয়ে থাকে। উদযাপনের জন্যও তাই একটি নির্দিষ্ট দিনকে বেছে নিতে পারে। ভালোবাসা দিবস যেহেতু একটি দিবস হিসেবে উদযাপিত হয়ে আসছে, তাই এই দিনটিতে বিয়ে করার মধ্য দিয়ে তারা সেটি ধরে রাখতে চায় বা উদযাপন করতে চায়। এটা অনেকটা একের ভেতর দুই-এরকম। অর্থাৎ একই সাথে দুইটি উৎসব পেতে চাওয়া।"

XS
SM
MD
LG