অ্যাকসেসিবিলিটি লিংক

কক্সবাজার থেকে ভাসানচরে গেল আরও ১ হাজার ৬৫৪ জন রোহিঙ্গা শরণার্থী


পুলিশ পাহারায় উখিয়া ডিগ্রি কলেজ মাঠ থেকে রোহিঙ্গা বোঝাই গাড়ির বহর চট্টগ্রামের পথে। (ছবি: ভয়েস অফ আমেরিকা)
পুলিশ পাহারায় উখিয়া ডিগ্রি কলেজ মাঠ থেকে রোহিঙ্গা বোঝাই গাড়ির বহর চট্টগ্রামের পথে। (ছবি: ভয়েস অফ আমেরিকা)

বাংলাদেশের কক্সবাজারের উখিয়া আশ্রয়শিবির থেকে নোয়াখালীর ভাসানচরের উদ্দেশে রওনা হয়েছেন আরও ১ হাজার ৬৫৪ জন রোহিঙ্গা।

বুধবার (১৬ ফেব্রুয়ারি) সন্ধ্যা পযন্ত দুই দফায় ৪৮৩ পরিবারের ১ হাজার ৬৫৪ জন রোহিঙ্গা (প্রথম দফায় ১ হাজার ৬ জন এবং দ্বিতীয় দফায় ৬৪৮ জন) রোহিঙ্গাকে ৩৪টি গাড়িতে তুলে চট্টগ্রাম পাঠানো হয়েছে। আগামীকাল বৃহস্পতিবার (১৭ ফেব্রুয়ারি) এই রোহিঙ্গাদের চট্টগ্রাম থেকে নৌবাহিনীর জাহাজে তুলে নেওয়া হবে ভাসানচরের উদ্দেশে। সেখানে তাদের থাকার নতুন ঘর বরাদ্দ দেওয়া হবে।

এর আগে ১০ ধাপে কক্সবাজারের বিভিন্ন আশ্রয়শিবির থেকে ভাসানচরের আশ্রয়প্রকল্পে স্থানান্তর করা হয় ২০ হাজার ৯৪২ জন রোহিঙ্গাকে। সব মিলিয়ে ভাসানচরে স্থানান্তর হলো ২২ হাজার ৫৯৬ জন রোহিঙ্গা।

কক্সবাজারে উখিয়া ও টেকনাফের ৩৪টি আশ্রয়শিবিরে নিবন্ধিত রোহিঙ্গা শরণার্থীর সংখ্যা সাড়ে ১১ লাখ। ২০১৭ সালে সেপ্টেম্বর মাসে এই দুই উপজেলার অন্তত ৭ হাজার একরের পাহাড়-জঙ্গল উজাড় করে গড়ো তোলা হয়েছে বিশ্বের সর্ববৃহৎ শরণার্থীর আশ্রয়শিবির। ঘনবসতিপূর্ণ এই ক্যাম্পসমূহে প্রতিনিয়ত ভয়াবহ অগ্নিকান্ড, ভুমিধস, বন্যার প্লাবনে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছিল রোহিঙ্গাবসতি।

চাপ কমাতে এখানকার ১ লাখ রোহিঙ্গাকে নোয়াখালীর ভাসানচরের আশ্রয়শিবিরে স্থানান্তরের পরিকল্পনা হাতে নেয় সরকার। লাখো রোহিঙ্গাকে রাখার জন্য জনমানবশূন্য ভাসানচরে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর তত্ত্বাবধানে এবং সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে ৩ হাজার ৯৫ কোটি টাকা ব্যয়ে আশ্রয়ণ প্রকল্প গড়ে তোলা হয়। ১৩ হাজার একর আয়তনের ওই জায়গায় তৈরি হয় ১২০টি গুচ্ছগ্রাম।

সরকারি একটি গোয়েন্দা সংস্থার তত্বাবধানে কক্সবাজার থেকে শরণার্থী স্থানান্তর কাযক্রম পরিচালনা করছে শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) কার্যালয়, আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নসহ (এপিবিএন) বিভিন্ন আইনশৃংখলা বাহিনী। সহযোগিতায় আছে কয়েকটি এনজিও সংস্থা।

উখিয়ার ১৮টি রোহিঙ্গা শিবিরের নিরাপত্তায় দায়িত্বে আছে ১৪ আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ান (এপিবিএন)। এই ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক ও পুলিশ সুপার নাঈমুল হক ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন, “উখিয়ার বিভিন্ন আশ্রয়শিবির থেকে স্বেচ্ছায় যেসব শরণার্থী ভাসানচরের আশ্রয়শিবিরে যেতে ইচ্ছুক, মূলত তাদেরকেই ক্যাম্প থেকে গাড়িতে তুলে প্রথমে উখিয়া ডিগ্রি কলেজ মাঠে আনা হয়। সেখানে আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করে শরণার্থীদের খাওয়ানো হয় দুপুরের খাবার। বেলা সোয়া ১টার দিকে প্রথম দফায় ১ হাজার ৬ জন রোহিঙ্গাকে ১৯টি বাসে তুলে চট্টগ্রাম পাঠানো হয়। দ্বিতীয় দফায় বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে আরও ১৮টি বাসে তুলে ৬৪৮ জন শরণার্থীকে চট্টগ্রাম পাঠানো হয়। রোহিঙ্গা বোঝাই গাড়ি বহরের আগে ও পেছনে কড়া নিরাপত্তা দেয় আইন–শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী। কাল বৃহস্পতিবার চট্টগ্রাম থেকে নৌবাহিনীর জাহাজে এসকল রোহিঙ্গাকে ভাসানচর আশ্রয়শিবিরে স্থানান্তর করা হবে।”

দুপুরের খাবার শেষ করে রোহিঙ্গারা সারিবদ্ধভাবে বাসে ওঠা শুরু করেন। বেলা ১টার মধ্যে ১ হাজার ৬ জন রোহিঙ্গা ১৯টি বাসে উঠে পড়েন। বেশির ভাগ নারী ও শিশু। প্রতিটা পরিবারের সদস্য সংখ্যা দুই থেকে ছয়জন। গাড়িতে ওঠার আগে কয়েকজন রোহিঙ্গার সঙ্গে কথা বলেন ভয়েস অফ আমেরিকার এই প্রতিনিধি। তারা স্বেচ্ছায় ভাসানচরে চলে যাওয়ার কথা বলেন। গাড়ির সামনে গ্লাসে লেখা আছে “চলো যাই ভাসানচর”।

উখিয়া ডিগ্রি কলেজ মাঠে ভাসানচরে যেতে গাড়িতে উঠছেন রোহিঙ্গারা। ১৬ই ফেব্রুয়ারি-২০২২। (ছবি- ভয়েস অফ আমেরিকা)
উখিয়া ডিগ্রি কলেজ মাঠে ভাসানচরে যেতে গাড়িতে উঠছেন রোহিঙ্গারা। ১৬ই ফেব্রুয়ারি-২০২২। (ছবি- ভয়েস অফ আমেরিকা)

উখিয়ার বালুখালী আশ্রয়শিবির ছেড়ে ভাসানচরে যেতে স্ত্রী ও তিন ছেলেমেয়ে নিয়ে একটি বাসে ওঠেন রোহিঙ্গা আবুল কালাম। তার বাড়ি মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের ঢেকিবুনিয়া গ্রামে। ২০১৭ সালের ২৮ অগাস্ট মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ও স্থানীয় মগ সম্প্রদায়ের উগ্রবাদী যুবকেরা অগ্নিসংযোগ করে আবুল কালামসহ ওই গ্রামের ২০টির বেশি ঘর জ্বালিয়ে দেয়। এ সময় এলোপাথাড়ি গুলিতে প্রায় ২২ জন রোহিঙ্গার মৃত্যু হয়। প্রাণ বাঁচাতে রোহিঙ্গা ঢলের সঙ্গে আবুল কালামও নাফ নদী অতিক্রম করে পালিয়ে আশ্রয় নেন উখিয়ার বালুখালী ক্যাম্পে। পাহাড়ের ঝুপড়ি ঘরে কখন যে চার বছর কেটে গেলে বুঝতেও পারেনি এই রোহিঙ্গা।

আবুল কালাম (৪৮) ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন, মিয়ানমার সেনাবাহিনীর অত্যাচারে আমরা জন্মভুমি ছেড়ে বাংলাদেশ আশ্রয় নিয়েছিলাম। জাতিসংঘের সহযোগিতায় বাংলাদেশ সরকার বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গাকে মাথা গোঁজার ঠাঁই করে দিয়েছে। আমরা বাংলাদেশ সরকারের প্রতি কৃতজ্ঞ। কিন্তু রোহিঙ্গাদের ভেতরে তৈরি হওয়া একাধিক সন্ত্রাসীগোষ্টী চাইছেনা পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে ফিরে যাক। সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলো আশ্রয়শিবিরে খুন খারাপি, অপহরণ, ধর্ষণ চালিয়ে যাচ্ছে। জীবনের নিরাপত্তার কথা ভেবে অনেকের মতো তিনিও সপরিবারে ভাসানচরে চলে যাচ্ছেন।

উখিয়ার মধুরছড়া আশ্রয়শিবিরের রোহিঙ্গা নেতা ছলামত উল্লাহ বলেন, পালিয়ে আসার চার বছরের বেশি সময়েও রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু হয়নি। বিগত সময়ে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনসহ মযাদাপুর্ণ প্রত্যাবাসনের লক্ষ্যে প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন রোহিঙ্গাদের শীর্ষনেতা মুহিবুল্লাহ। আন্তর্জাতিক মহলে রোহিঙ্গাদের মুখপাত্র হিসেবে লড়তেন এই নেতা।

২০২১ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর রাতে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের গুলিতে খুন হন রোহিঙ্গাদের শীর্ষনেতা মুহিবুল্লাহ। একই বছরের ২২ অক্টোবর রাতে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা আরেকটি আশ্রয়শিবিরের একটি মসজিদ-মাদ্রাসায় হামলা চালিয়ে হত্যা করে আরও ৬ জন রোহিঙ্গাকে। তাদের ৪ জন মাদ্রাসা শিক্ষক ও দুজন মাদ্রাসা ছাত্র। এই হামলার জন্য মিয়ানমারের সশস্ত্র সন্ত্রাসী গোষ্টিী “আরাকান স্যালভেশন আর্মি”কে (আরসা) দায়ী করা হয়। আইন–শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতায় সন্ত্রাসীরা আত্মগোপন করলেও সাধারণ রোহিঙ্গার মনে আতঙ্ক কাটছে না। তাই অনেকে নিরাপত্তার কথা ভেবে ভাসানচরে চলে যাচ্ছেন।

কুতুপালং ক্যাম্পের রোহিঙ্গা রহিম উল্লাহ (৪৫) বলেন, রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা যখন তখন তাদের ভয়ভীতি প্রদর্শণ করে, আদায় করে চাঁদা। ক্যাম্পে খুন-খারাবি, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, অপহরণ লেগেই আছে। তা ছাড়া বর্ষায় পাহাড়ধসের ঝুঁকি নিয়ে ঝুপড়ি ঘরে বসতি করতে হয়। শীতকালে আবার অগ্নিকান্ড নিয়ে আতঙ্কে থাকতে হয়। এ ক্ষেত্রে ভাসানচর অনেক নিরাপদ।

উখিয়ার বালুখালী ক্যাম্পের পাহাড়ের ঝুপড়ি ঘরে চার বছর কাটিয়েছেন রোহিঙ্গা নারী সখিনা বেগম। সন্তান কোলে ভবিষ্যৎ চিন্তায় মগ্ন এই নারী একটাই ভাবনা-কখন মিয়ানমারে ফিরে যাওয়া হবে। ১৬ই ফেব্রুয়ারি-২০২২। (ছবি: ভয়েস অফ আমেরিকা)
উখিয়ার বালুখালী ক্যাম্পের পাহাড়ের ঝুপড়ি ঘরে চার বছর কাটিয়েছেন রোহিঙ্গা নারী সখিনা বেগম। সন্তান কোলে ভবিষ্যৎ চিন্তায় মগ্ন এই নারী একটাই ভাবনা-কখন মিয়ানমারে ফিরে যাওয়া হবে। ১৬ই ফেব্রুয়ারি-২০২২। (ছবি: ভয়েস অফ আমেরিকা)

শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনারের (আরআরআসি) কাযালয়ের তথ্য মতে, গত ৫ জানুয়ারি দশমতম ধাপে কক্সবাজার থেকে ভাসানচরে যায় ৭০৫ জন রোহিঙ্গা। বুথবারের এগারতম ধাপে ১ হাজার ৬৫৪ জনসহ কক্সবাজার থেকে ভাসানচরে গেলেন মোট ২২ হাজার ৫৯৬ জন রোহিঙ্গা।

মিয়ানমার সেনাবাহিনীর অত্যাচার নির্যাতন ও নৃশংসতার শিকার হয়ে ২০১৭ সালের ২৫ অগাস্ট থেকে পরবর্তী কয়েক মাসে বাংলাদেশ পালিয়ে আসে ৮ লাখ রোহিঙ্গা। এর আগের কয়েক দফায় আসে আরও কয়েক লাখ। বর্তমানে উখিয়া ও টেকনাফের ৩৪টি আশ্রয়শিবিরে নিবন্ধিত রোহিঙ্গার সংখ্যা সাড়ে ১১ লাখ।

কক্সবাজারের আশ্রয়শিবিরের চাপ কমাতে অন্তত ১ লাখ রোহিঙ্গাকে ভাসানচরের আশ্রয়শিবিরে সরিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার। আগামী কয়েক মাসে আরও ৮০ হাজার রোহিঙ্গাকে ভাসানচরে স্থানান্তরের পরিকল্পনা আছে সরকারের।

সরকারি তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ নৌবাহিনীর তত্ত্বাবধানে সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে ৩ হাজার ৯৫ কোটি টাকা ব্যয়ে ইতিমধ্যে ভাসানচর আশ্রয়ণ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে। ১৩ হাজার একর জায়গায় এক লাখ রোহিঙ্গা বসবাসের উপযোগী ১২০টি পৃথক গুচ্ছগ্রাম আদলে অবকাঠামো তৈরি করা হয়েছে। সেখানে বিনোদন, শিক্ষা-স্বাস্থ্যসহ নিরাপত্তার ব্যবস্থাও রাখা হয়েছে। শুরুতে জাতিসংঘ ভাসানচরে দায়িত্ব নিতে রাজি হয়নি। গত বছর দায়িত্ব নেওয়ার পর রোহিঙ্গা স্থানান্তর কার্যক্রম ত্বরান্বিত হচ্ছে।

XS
SM
MD
LG