বাংলাদেশের পররাষ্ট্র বিষয়ক নীতিনির্ধারকরা র্যাব-এর সাত কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞাকে ঢাকা-ওয়াশিংটন সম্পর্কের নয়া চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছেন। মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে গত ১০ ডিসেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি ও পররাষ্ট্র বিভাগ থেকে এই নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়।
অতিসম্প্রতি তারা এক বৈঠকে মিলিত হয়ে সার্বিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করেছেন। এতে বলা হয়, সম্প্রতি র্যাবের বর্তমান ও সাবেক কয়েকজন কর্মকর্তার ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা দুই দেশের সম্পর্কের মধ্যে বড় চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করেছে।
বৈঠকে নীতিনির্ধারকরা দু'দেশের সম্পর্কের নানাদিক পর্যালোচনা করেন। এতে বলা হয়- বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী মানবাধিকার লঙ্ঘন নয়, বরং মানবাধিকার রক্ষার জন্য কাজ করছে। যুক্তরাষ্ট্রের এই নিষেধাজ্ঞাটি যথাযথ হয়নি। বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতের মাধ্যমে এ নিষেধাজ্ঞার ব্যাপারে দেশটির অসন্তোষের কথা যুক্তরাষ্ট্র সরকারকে জানানো হয়েছে।
এছাড়া বর্তমানে বাংলাদেশ সরকার এ নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের জন্য কাজ করছে। এ লক্ষ্যে যুক্তরাষ্ট্রে আইনজীবী নিয়োগের প্রক্রিয়া চলছে। বৈঠকের কার্যপত্র থেকে এই তথ্য জানা গেছে। গত ১৪ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত বৈঠকে এই কার্যপত্র অনুমোদিত হয়।
সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ফারুক খানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত বৈঠকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন, প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম, নুরুল ইসলাম নাহিদ এমপি, গোলাম ফারুক খন্দকার প্রিন্স এমপি, আব্দুল মজিদ খান এমপি ছাড়াও অন্যান্য কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
উল্লেখ্য যে, ১৯৭২ সালের ৪ এপ্রিল যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। ২০১২ সাল থেকে চারটি বিষয়ে নিয়মিত সংলাপ হচ্ছে দু’দেশের মধ্যে। এগুলো হচ্ছে- অংশীদারিত্ব সংলাপ, নিরাপত্তা সংলাপ, প্রতিরক্ষা সংলাপ এবং টিকফা নিয়ে সংলাপ। এছাড়া ২০২১ সাল থেকে দু’দেশের মধ্যে অর্থনৈতিক বিষয়ে সংলাপ অনুষ্ঠিত হচ্ছে।
বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের বিভিন্ন দিক আলোচনা করে বৈঠকে বলা হয়, দেশটি বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ বাণিজ্য অংশীদার। দু’দেশের মধ্যকার দ্বিপাক্ষিক বার্ষিক বাণিজ্য ৭ বিলিয়ন ডলারের বেশি। ২০০৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্যের মোট পরিমাণ ছিল ৪ হাজার ১৩৩ দশমিক ৬ মিলিয়ন ডলার। ২০১৯ সালে এটা বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে ৯ হাজার ২০ দশমিক ৫ মিলিয়ন ডলার।
বাংলাদেশের মোট রপ্তানির ১৮-১৯ শতাংশের গন্তব্য হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বিনিয়োগকারী দেশ। এখন পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের মোট বিনিয়োগ ১ বিলিয়ন ডলারের বেশি। জ্বালানি খাতে আরো ১ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ প্রায় চূড়ান্ত।
বৈঠকে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্রে বর্তমানে ৫ লাখেরও বেশি বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত নাগরিক রয়েছেন। বাংলাদেশ থেকে বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থী প্রতিবছর যুক্তরাষ্ট্রে যান।
২০১৯-২০২০ শিক্ষাবর্ষে ৮ হাজার ৮৩৮ জন বাংলাদেশি শিক্ষার্থী যুক্তরাষ্ট্রে গিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রে স্নাতক পর্যায়ে অধ্যায়নরত শিক্ষার্থী প্রেরণে বাংলাদেশ বিশ্বে বর্তমানে অষ্টম স্থানে রয়েছে।
এই বৈঠকে রোহিঙ্গা শরনার্থীদের প্রসঙ্গ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। বলা হয়, রোহিঙ্গা শরনার্থীদের মানবিক সহায়তা প্রদানে যুক্তরাষ্ট্র একক দেশ হিসেবে শীর্ষে রয়েছে। এই সংকট সমাধানে ২০১৭ থেকে ২০২১ সন পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র ৭৯৯ মিলিয়ন ডলারের বেশি অর্থ সহায়তা দিয়েছে । আন্তর্জাতিক ফোরামেও রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে বাংলাদেশকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। চলমান কোভিড–১৯ মহামারি মোকাবিলায় শুরু থেকেই যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের পাশে দাঁড়িয়েছে। এ পর্যন্ত বাংলাদেশকে ৪ কোটি ৫০ লাখ ডোজ টিকা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। মহামারির প্রথম দিকে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রকে দ্রুততম সময়ের মধ্যে জরুরিভিত্তিতে ৬ দশমিক ৫ মিলিয়ন পিপিই পাঠিয়েছে।
শ্রম আইন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ও মানবাধিকার বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে ক্রমাগত চাপ দিচ্ছে বলে বৈঠকে উল্লেখ করা হয়।
এছাড়া যুক্তরাষ্ট্র জিএসপি সুবিধা বাতিল করার পর বাংলাদেশ একাধিক পদক্ষেপ গ্রহণ করলেও দেশটি তাদের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেনি। গত ২০ বছরে বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে প্রেসিডেন্ট কিংবা প্রধানমন্ত্রী পর্যায়ে কোনো দ্বিপাক্ষিক সফর হয়নি। এ বছর বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের ৫০ বছর পূর্তি হচ্ছে। এ সময় সম্পর্কোন্নয়নে ব্যাপক কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে।