অ্যাকসেসিবিলিটি লিংক

বাংলাদেশে সাংবাদিকতা পেশায় আদিবাসীর সংখ্যা এত কম কেন


ক্যামেরা ও নোটবুক হাতে সাংবাদিক। (ছবি- অ্যাডোবি স্টক)
ক্যামেরা ও নোটবুক হাতে সাংবাদিক। (ছবি- অ্যাডোবি স্টক)

বাংলাদেশে অন্য পেশায় আদিবাসীর সংখ্যা গত কয়েক বছরে তুলনামূলক বাড়লেও সাংবাদিকতায় সেভাবে বাড়ছে না। দেশটির বিভিন্ন গণমাধ্যমে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানে তাদের প্রতিনিধিত্ব নেই, কয়েকটিতে হাতেগোনা।

তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ।
তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ।

পেশাটিতে আদিবাসী সদস্যদের উদ্বুদ্ধ করতে বাংলাদেশ সরকারের পরিকল্পনার কথা জানতে চাইলে সংবিধানের তৃতীয় ভাগের মৌলিক অধিকার অংশের কথা উল্লেখ করে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেছেন, "পেশা বা বৃত্তির স্বাধীনতার ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট কোনো জাতিগোষ্ঠীর জন্য নির্দিষ্ট একটি পেশায় আসতে উদ্বুদ্ধ করার সুযোগ নেই। এক্ষেত্রে সবার জন্যই সমান অধিকার।"

সমস্যা যেখানে

বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় বাংলা পত্রিকা ‘দৈনিক প্রথম আলো’য় প্রতিবেদক হিসেবে কাজ করছেন ড্রিঞ্জা চাম্বুগং। পত্রিকাটির সংবাদ বিভাগে তিনিসহ মোট দুজন আদিবাসী সদস্য। ২৯ বছর বয়সী এই গারো তরুণ পেশা হিসেবে সাংবাদিকতাকে বেছে নিলেও এমন কিছু প্রতিবন্ধকতার কথা বলছেন যার কারণে আদিবাসী বা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষদের পেশাটিতে আসা ‘কঠিন’।

‘দৈনিক প্রথম আলো’য় প্রতিবেদক ড্রিঞ্জা চাম্বুগং।
‘দৈনিক প্রথম আলো’য় প্রতিবেদক ড্রিঞ্জা চাম্বুগং।

ভয়েস অফ আমেরিকাকে তিনি বলেন, "ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় চাকরির আবেদন করার সময় আমরা উচ্চারণ নিয়ে চিন্তায় থাকি। এক্ষেত্রে নিজেদের মধ্যেই সংকোচবোধ কাজ করে। আবার যারা আমাকে কাজটা দেবেন, তারাও যাচাই-বাছাই করেন। সুতারং কাজ পাওয়া কঠিন।"

"আরেকটা সমস্যা হলো আমাদের শিশুরা ছোটবেলা থেকে লেখালেখির সঙ্গে অতটা যুক্ত থাকে না। প্রিন্ট মিডিয়ার ক্ষেত্রে এটি খুব দরকারি। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সমস্যাও আছে। এই রিলেটেড পড়ালেখার সুযোগ আমাদের খুব কম হয়। সরকারি ডিগ্রি কলেজ কিংবা স্নাতক পর্যায়ের যে কলেজগুলো আছে সেখানে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিষয়ক সাবজেক্ট নেই। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সামর্থ্য যাদের আছে, তারা আবার অন্য বিষয়ে পড়াশোনা করেন।"

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিস্থিতির কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, "যারা পাবলিক ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়, তাদের এসব বিষয়ে ভর্তি হতে হলে বাংলা-ইংরেজিতে ন্যূনতম কিছু নম্বর তুলতে হয়, সেটা অনেকের পক্ষে সম্ভব হয় না। এ কারণে সাংবাদিকতা বিষয়ে পড়ালেখা করা হয় না এবং এই পেশায় আসাও হয় না।"

বিউটি হাজং- দৈনিক দেশ রূপান্তরের সহসম্পাদক।
বিউটি হাজং- দৈনিক দেশ রূপান্তরের সহসম্পাদক।

"বাংলাদেশে সাংবাদিকতার সামগ্রিক যে প্রেক্ষাপট, যে বেতন কাঠামো তাতে আমাদের জন্য এই পেশা বেছে নেয়া খুব কঠিন", মন্তব্য করে দৈনিক দেশ রূপান্তরের সহসম্পাদক বিউটি হাজং বলেন, "আদিবাসী শিক্ষার্থীরা যে পরিবার থেকে উঠে আসেন, সেখানে পড়ালেখা শেষ করেই পরিবারের হাল ধরার তাগিদ থাকে। কিন্তু বাংলাদেশে সাংবাদিকতা অনিশ্চিত একটা জায়গা। তাই অনেকেই এই পেশায় আসতে চান না।"

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করা এই তরুণী জানান, তার বিভাগে দুইজন আদিবাসী শিক্ষার্থী ছিলেন। অন্য বিভাগে এই সংখ্যা বেশি থাকলেও সাংবাদিকতা বিভাগের পরিস্থিতি ছিল এমন।

"আদিবাসী হওয়ার কারণে আমি কখনো নেতিবাচক পরিস্থিতির মুখে পড়িনি। তবে নারী হিসেবে কিছু সমস্যায় পড়েছি। আমরা বেশি সময় দিতে পারব কি না-শুরুতে এই প্রশ্ন তোলা হয়। এরপর আসে লেটনাইটের প্রসঙ্গ। সব মিলিয়ে সুযোগ-সুবিধা আরও বাড়লে, আর্থিক নিশ্চয়তা পেলে হয়তো আমাদের আরও ছেলেমেয়ে এই পেশায় আসতে আগ্রহী হবে।"

নেই পরিসংখ্যান

ফরিদা ইয়াসমিন- সভাপতি - জাতীয় প্রেসক্লাব
ফরিদা ইয়াসমিন- সভাপতি - জাতীয় প্রেসক্লাব

বাংলাদেশি গণমাধ্যমে ঠিক কতজন আদিবাসী সাংবাদিক আছেন সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য নেই কারো কাছে। জাতীয় প্রেসক্লাবের সভাপতি ফরিদা ইয়াসমিন বললেন, এ বিষয়ে গবেষণা হওয়া দরকার। তিনি বলেন, "গণমাধ্যমে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর কতজন আছেন এ বিষয়ে আমার কোনো গবেষণা নেই। বাহ্যিকভাবে যতটুকু দেখি বা আমার যেটা পর্যবেক্ষণ তাতে মনে হয় খুবই কম। এর কারণ জানতেও গবেষণা প্রয়োজন। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সংখ্যা কত, কতজন পড়াশোনা করছেন, কতজন শিক্ষিত হচ্ছেন, কতজন এই পেশায় আসতে আগ্রহী এই বিষয়গুলো এখানে কাজ করে।"

সঞ্জীব দ্রং- আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক।
সঞ্জীব দ্রং- আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক।

"ইদানীং বিভিন্ন গণমাধ্যমে দেখছি তাদের পলিসিতে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষদের জন্য সুযোগ রাখছে। আমরা সব প্রতিষ্ঠানকে এই সুযোগ বাড়ানোর আহ্বান জানাই," মন্তব্য করে প্রেসক্লাবের প্রথম এই নারী সভাপতি বলেন, "আমাদের সদস্যপদের যে প্রক্রিয়া চলছে, সেখানে বাছাই করেছি। আমরা বলেছি এ ধরনের যদি কেউ থাকে অগ্রাধিকার দেব।"

আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং আনুমানিক একটা হিসাব দিয়েছেন। এই কলাম লেখক ও অধিকার কর্মী বলেন, "আমার জানা মতে ১০ থেকে ১২ জন জাতীয় পর্যায়ে অর্থাৎ ঢাকায় সাংবাদিকতার সঙ্গে যুক্ত।"

প্রেসক্লাবের মাত্র একজন সদস্য

নিখিল মানখিন- জাতীয় প্রেসক্লাবের একমাত্র আদিবাসী সাংবাদিক সদস্য।
নিখিল মানখিন- জাতীয় প্রেসক্লাবের একমাত্র আদিবাসী সাংবাদিক সদস্য।

ফরিদা ইয়াসমিনের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, জাতীয় প্রেসক্লাবে এখন পর্যন্ত একজন আদিবাসী সাংবাদিক সদস্য হিসেবে আছেন- নিখিল মানখিন। ৪৪ বছর বয়সী এই সিনিয়র সাংবাদিক জানিয়েছেন, বাংলাদেশি সাংবাদিকদের ‘সেকেন্ড হোম’ খ্যাত এই সংগঠনের ইতিহাসে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী থেকে তিনিই প্রথম এবং একমাত্র সদস্য। জাতীয় রাজনীতির প্রভাবের কারণে দেটির প্রেসক্লাবের সদস্যপদ পাওয়া এমনিতে কঠিন। সেখানে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের জন্য বিষয়টি আরও কঠিন বলে মনে করেন দৈনিক ভোরের আকাশের বিশেষ প্রতিনিধি নিখিল মানখিন।

তার ধারণা সমগ্র বাংলাদেশে সর্বসাকুল্যে ‘৩০-৩৫ জন্য’ ক্ষুদ্র আদিবাসী সাংবাদিক থাকতে পারেন। ঢাকায় সংখ্যাটা ‘দশের মতো’।

মিডিয়া ব্যক্তিত্বদের অভিজ্ঞতা

ডেইলি স্টারের সম্পাদক মাহফুজ আনাম।
ডেইলি স্টারের সম্পাদক মাহফুজ আনাম।

বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টারের সম্পাদক মাহফুজ আনাম জানান আদিবাসীদের ব্যাপারে তারা একটা পলিসি অনুসরণ করেন। তবে তাদের প্রতিনিধিত্ব বাড়াতে সবাইকে আরও কার্যকরী পদক্ষেপ নেয়ার আহ্বান তার, "এ কথা সত্য যে বাংলাদেশে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী থেকে সাংবাদিকতায় অনেক কম মানুষ আসছেন। এ ব্যাপারে আমি মনে করি আমাদের আরও প্রো-অ্যাকটিভ হতে হবে। ডেইলি স্টারে আমরা একজন ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সাংবাদিক নিয়োগ করেছি। আমরা সব সময় এ ব্যাপারে সচেতন দৃষ্টি রাখতে চেষ্টা করি।"

"তাদের মধ্যে যারা মেধাবী তাদের জন্য সহযোগিতা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন বলে আমি মনে করি। তবে সাংবাদিকতা করতে হলে নিজের একটা আগ্রহ থাকতে হবে। দক্ষতার ব্যাপার আছে। পেশাটাকে গ্রহণ করার বিষয়ে উৎসাহ-উদ্দীপনা থাকতে হবে। আমরা আরেকটু প্রো-অ্যাকটিভ হলে তাদের আমাদের মধ্যে নিবিড়ভাবে আনতে পারি। এই পলিসি আমরা ডেইলি স্টারে ফলো করি।"

ইমদাদুল হক মিলন- কথাশিল্পী ও ইস্ট ওয়েস্ট মিডিয়া গ্রুপের পরিচালক।
ইমদাদুল হক মিলন- কথাশিল্পী ও ইস্ট ওয়েস্ট মিডিয়া গ্রুপের পরিচালক।

আদিবাসীদের মধ্য থেকে যতজন সাংবাদিকতা পেশায় আসা উচিত ছিল, ততজন আসছেন না বলে মনে করেন কালের কণ্ঠের সাবেক সম্পাদক এবং বর্তমানে ইস্ট ওয়েস্ট মিডিয়া গ্রুপের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করা নন্দিত কথাশিল্পী ইমদাদুল হক মিলনও। এর পেছনে আগ্রহের অভাবকে ‘প্রধান কারণ’ বলছেন তিনি, "ইস্ট ওয়েস্ট মিডিয়া গ্রুপের পক্ষ থেকে আমরা দেখেছি আমাদের হাউজে কেউ কেউ কাজ করেন। যদি সার্বিক ক্ষেত্রে বলি তাহলে যতটা আগ্রহ নিয়ে তাদের অংশগ্রহণ করা উচিত ছিল, তেমন আমরা লক্ষ্য করি না। আমার মনে হয় তাদের লেখাপড়ার হার কম। এটা একটা বিষয়।"

সম্পাদক হিসেবে সাড়ে দশ বছরের অভিজ্ঞতা থেকে তিনি বলেন, "বিশেষ করে সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে তাদের আগ্রহের জায়গাটা কম। আমি মনে করি এটাই প্রধান কারণ। তাদের শিক্ষিত মানুষেরা অন্য পেশায় যুক্ত হয়ে যান।"

"আমাদের 'বাংলাদেশ প্রতিদিনে' দুই-একজনকে পেয়েছি। তবে লোকাল করোসপন্ডেন্ট যারা, তাদের অনেককে আমি যুক্ত করেছি।"

ইমদাদুল হক মিলন মনে করেন, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের মধ্যে অনেক মেধাবী মানুষ আছেন যাদের এই পেশায় যুক্ত করতে পারলে দেশের লাভ হবে। এ জন্য তাদের আগ্রহ বাড়াতে হবে বলে মত তার।

বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের চিত্র

আবুল মনসুর আহাম্মদ- চেয়ারম্যান - গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
আবুল মনসুর আহাম্মদ- চেয়ারম্যান - গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে পড়ার আগ্রহ আছে আদিবাসী শিক্ষার্থীদের। বিভাগের চেয়ারম্যান আবুল মনসুর আহাম্মদ ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন, "ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা সব সময় ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর শিক্ষার্থীদের পেয়ে আসছি। তারা ভালো করছে। আমাদের বিভাগে পড়াশোনা করে অনেকে গণমাধ্যমে কাজ করছে, সরকারি চাকরি করছে। আমরা প্রতি বছরই শিক্ষার্থী পাচ্ছি।"

তাদের সংখ্যা কেমন- এমন প্রশ্নের জবাবে আবুল মনসুর আহাম্মদ বলেন, "সংখ্যা বেশি না। হয়তো একজন-দুজন।"

"এ বিষয়ে আমাদের কোনো গবেষণা না থাকলেও বিভাগের একজন চেয়ারম্যান হিসেবে বলতে পারি তারা আসছে এবং এ বিষয়ে পড়াশোনা করছে।"

শেখ আদনান ফাহাদ- চেয়ারপারসন - সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগ- জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
শেখ আদনান ফাহাদ- চেয়ারপারসন - সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগ- জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেল, সেখানকার সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগে প্রতি বছর ৩৫ থেকে ৫০ জন শিক্ষার্থী ভর্তি হন। এরমধ্যে আদিবাসী থাকেন গড়ে তিন থেকে চার জন। বিভাগটির চেয়ারপারসন শেখ আদনান ফাহাদ বলেন, "আমাদের এখানে চাকমা, মারমা, হাজংসহ বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর শিক্ষার্থীরা আসেন। বিভাগের শিক্ষক হিসেবে দেখছি তারা নিয়মিতভাবে পড়াশোনা করেন। বিভিন্ন জায়গায় চাকরিও করছেন। তবে সবাই গণমাধ্যমে চাকরি করেন না। অনেকেরই আগ্রহ থাকে বিসিএসের প্রতি। অনেকে গণমাধ্যমের চাকরি ছেড়ে ব্যাংকে চাকরি করছেন-এমন ঘটনাও আছে।"

আরশি চাকমা- জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতার শিক্ষার্থী।
আরশি চাকমা- জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতার শিক্ষার্থী।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী আরশি চাকমা সাংবাদিকতা বিষয়ে পড়ালেখা করলেও পেশা হিসেবে তার পছন্দ অন্যকিছু, "সাংবাদিকতা নিয়ে পড়ছি কারণ ভর্তি পরীক্ষা দেয়ার সময় এটা চয়েজ ছিল। আমার মনে হয়েছিল অন্যান্য বিষয়ের তুলনায় সাংবাদিকতা নিয়ে পড়লে নতুন নতুন বিষয়ে জানা যাবে, সবকিছুর প্রতি ধারণা পাওয়া হবে। আর সাধারণ সাবজেক্ট নিয়ে পড়লে সেটা শুধু ওই বিষয় কেন্দ্রিক শিক্ষা বেশি হবে।তবে আমি সাংবাদিক হতে চাই না।‘

ঠিক কী কারণে সাংবাদিক হতে চান না সেই প্রশ্নের উত্তর দিতে না চাইলেও বলেন, "সাধারণ সাংবাদিকদের ওপর যে চাপ থাকে তার তুলনায় আদিবাসী সাংবাদিকদের চাপ আরেকটু বেশি থাকে।"

নিউজ ট্রিটমেন্ট নিয়ে অসন্তুষ্টি

আদিবাসী সম্প্রদায়গুলোর দাবির কথা বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় গণমাধ্যমে যেভাবে এবং যতটা প্রকাশ করা হয়, তা পর্যাপ্ত নয় বলে মনে করেন এই প্রজন্মের শিক্ষিত প্রতিনিধিরা। তরুণ সাংবাদিক ড্রিঞ্জা চাম্বুগং বলেন, "সাংবিধানিকভাবে আমি আদিবাসী পরিচয়টাই ব্যবহার করতে পারছি না। তার মানে আমি প্রথম অধিকার থেকেই বঞ্চিত। পত্রপত্রিকায় যখন আমাদের কথা লেখা হয়, তখন ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী বা নৃতাত্ত্বিক বলে সম্বোধন করা হয়। অর্থাৎ শুরুতেই আমি বঞ্চিত হলাম।"

"আর অন্যায়-অনিয়মের সঙ্গে তো সবসময় বড় কোনো স্বার্থসংশ্লিষ্ট গোষ্ঠী থাকে। বাংলাদেশের অধিকাংশ গণমাধ্যম এখন কোনো না কোনো গোষ্ঠী অথবা প্রভাবশালী ব্যক্তিরা পরিচালনা করেন, এই স্বার্থের জায়গা থেকে আমাদের সংবাদ পরিবেশন করা, আমাদের দাবির কথা লেখা অনেকটা পিছিয়ে যায়; অথবা ধামাচাপা পড়ে যায়।"

এই অভিযোগের বিষয়ে সাংবাদিক-নেতা ফরিদা ইয়াসমিনের ব্যাখ্যা এমন, ‘নারীদের ক্ষেত্রে যেমন হয়, তাদের সংবাদ যতটা আসার কথা আসছে না। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ক্ষেত্রেও এমন হচ্ছে। তারা প্রান্তিক জনগোষ্ঠী। আমাদের গণমাধ্যমে পলিটিকাল কনফ্লিক্ট সারাদিন প্রাধান্য দেয়া হয়। অপরাধের খবরকে গুরুত্ব দেয়া হয়। সেখানে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীকে প্রাধান্য দিয়ে সংবাদ করার বিষয়টি হয়তো তারা চিন্তাই করছেন না। যেহেতু তারা পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর মানুষ, তাই সবক্ষেত্রে তাদের প্রাধান্য দেয়া দরকার।"

আদিবাসী ফোরামের সঞ্জীব দ্রং স্মরণ করিয়ে দিলেন পুরোনো অভিমানের কথা, "আমাদের প্রতি রাষ্ট্র এবং নাগরিক সমাজের যে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি তারই প্রতিফলন ঘটছে মিডিয়াতে। বাংলাদেশে যে বাঙালি জাতির বাইরে ৫০টি জাতি আছে, মুক্তিযুদ্ধে তাদের যে সংগ্রামের অবদান আছে এর তেমন কোনো স্বীকৃতি নেই। সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য বলতে যা বোঝায়, আমাদের দেশে সেটি হয়নি। আমাদের ব্যাপারে দৃষ্টিভঙ্গি হলো দেখতে 'থাই'দের মতো, 'কোরিয়ান'দের মতো। চেহারা এরকম, পোশাক পরে এরকম। এই নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিই দায়ী।"

যোগসূত্রের অভাব

জাতীয় গণমাধ্যমে আদিবাসীদের কথা সেভাবে না আসার পেছনে যোগসূত্রের অভাবকে দায়ী করেছেন অভিজ্ঞ সাংবাদিক নিখিল মানখিন। নিখিল মানখিন নিজের দুই দশকের ক্যারিয়ারের অভিজ্ঞতা থেকে বললেন, "আদিবাসীদের কথা গণমাধ্যমে প্রচারের প্রবণতা আছে বলে আমি মনে করি। প্রায়ই নিউজ হয়। ওইভাবে ফেলে রাখা হয় না। কিন্তু অতটা প্রচার হয় না যোগসূত্রের অভাবে। এখানে কমিউনিটির নেতাদের ভূমিকা রাখতে হবে। গুরুত্বপূর্ণ নিউজ হলে মিডিয়ার পক্ষ থেকে আমরা নিজেরাই চলে যাই। অনেক সময় অনেক খবর আমরা পাই না। ওই খবরগুলো আমাদের নেতৃবৃন্দ কীভাবে মিডিয়ায় পৌঁছে দেবে, তার ওপর বিষয়টি নির্ভর করে।"

এখনই পদক্ষেপ নেয়ার আহ্বান

গণমাধ্যমে আদিবাসীদের প্রতিনিধিত্ব বাড়ানোর জন্য পদক্ষেপ নেয়ার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছেন সংশ্লিষ্ট সবাই। ফরিদা ইয়াসমিন ‘উৎসাহমূলক কার্যক্রমের’ মাধ্যমে কাজটি করতে চান, "একটা মোটিভেশনাল প্রোগ্রাম করা যায়। এই পেশায় কেন তারা আসতে পারে, সে বিষয়ে আগ্রহী করে তোলা দরকার। পাশাপাশি পলিসি লেভেলেও গুরুত্ব দেয়া উচিত।"

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের চেয়ারম্যান আবুল মনসুর আহাম্মদের মতামতও এমন, "তাদের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতার মতো বিষয়ে এই কমিউনিটির মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করলে দেখা যাবে আরও অনেক শিক্ষার্থী পড়তে আসছে।"

সঞ্জীব দ্রং মনে করেন, "আমাদের ছেলেমেয়েদের প্রমোট করা হয় না। গত কয়েক বছরে অন্য পেশায় আমাদের অংশগ্রহণ বেড়েছে, কিন্তু সাংবাদিকতা পেশায় নেই বললেই চলে। এই পেশায় আদিবাসীদের আগ্রহী করতে সুযোগ বাড়াতে হবে।"

সরকার যা বলছে

সব জাতিগোষ্ঠীর জন্য বাংলাদেশ সরকার সমান অধিকার নিশ্চিত করছে উল্লেখ করে সংবিধানের উদ্ধৃতি দিয়ে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ জানান, "আইনের দ্বারা আরোপিত বাধানিষেধ-সাপেক্ষে কোন পেশা বা বৃত্তি-গ্রহণের কিংবা কারবার বা ব্যবসায়-পরিচালনার জন্য আইনের দ্বারা কোন যোগ্যতা নির্ধারিত হইয়া থাকিলে অনুরূপ যোগ্যতাসম্পন্ন প্রত্যেক নাগরিকের যে কোন আইনসংগত পেশা বা বৃত্তি-গ্রহণের এবং যে কোন আইনসংগত কারবার বা ব্যবসায়-পরিচালনার অধিকার থাকবে।"

XS
SM
MD
LG