বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার শাহবাগ থেকে দোয়েল চত্বর। মাঝখানে বাংলা একাডেমি, সোহারাওয়ার্দী উদ্যান আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যারয়ের টিএসসি।
ছুটির দিন শুক্রবার (১৮ ফেব্রুয়ারি) দুপুর থেকেই এই এলাকায় বাড়ছিল লোক সমাগম। রাজধানীর নানা প্রান্ত থেকে আসছিলেন নানা বয়সী নগরবাসী। তাদের সবার অভিমুখ অমর একুশের বইমেলা। বেলা গড়ানোর আগেই পুরো এলাকা প্রায় জনসমুদ্র। আক্ষরিক অর্থেই মেলায় ছিল উপচে পড়া ভিড়।
গতকাল বৃহস্পতিবারের ঘোষণা অনুসারে মেলা শুরু হয়েছিল বেলা ১১টায়। তবে এবার মেলায় সকালে শিশু প্রহর ছিল না। সকালে লোকসমাগম একটু কম ছিল। যারা ভিড়ভাট্টা পছন্দ করেন না তারা প্রথম ভাগে এসে নিরিবিলি বই কেনার সুযোগটি নিয়েছেন।
বিকেলে বই কেনার পাশাপাশি অনেক দিন করেনায় ঘরবন্দী থাকার বিষাদ কাটাতে মেলার খোলামেলা পরিবেশে বেড়ানোর আনন্দে মেলায় মানুষের ঢল নামে।
মেলায় লোকসমাগম বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে কাল নতুন বই আসার সংখ্যাও বেড়েছিল। তথ্যকেন্দ্রে নতুন বইয়ের নাম জমা পড়েছে ১৭৭টি। বেড়েছে বিক্রিও।
সময় প্রকাশনের প্রকাশক ও বাংলাদেশ জ্ঞান ও সৃজনশীল প্রকাশক সমিতির সভাপতি ফরিদ আহমেদ বললেন, তাদের প্রতশ্যাশা মতোই প্রথম ছুটির দিনে বিপুল জনসমাগম হয়েছে। এবার অবশ্য প্রথম দিন থেকেই মেলায় পাঠক উপস্থিতি ভালো। কাল শনিবারও ছুটির দিন সকাল থেকে মেলা খুলবে। মাঝে ২০ তারিখ এবং তারপর একুশের দিনে সকাল আটটা থেকেই মোলা শুরু হবে। সবমিলিয়ে এই চার দিনে বেশ ভালো বিক্রির আশা করছেন তারা।
সময় প্রকাশন থেকে এবার মেলায় এসেছে দেশের জনপ্রিয় লেখক মুহম্মদ জাফর ইকবালের বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী “আমি পরামানব”।
একই রকম প্রতিক্রিয়া জানালেন অনুপম প্রকাশনী প্রকাশক মিলন নাথ। তাদের প্যাভিলিয়নটি মেলার পূর্ব পাশে। মেলা মাঠের অপরিচ্ছন্নতা নিয়ে একটু অসন্তোষ প্রকাশ করলেও বিক্রি বেশ ভালো বলে জানালেন তিনি।
বাংলা মোটর থেকে সস্ত্রীক মেলায় এসেছিলেন তরুণ ব্যবাসায়ী শাহিন মাহমুদ। তিনি হুমায়ুন আহমেদের ভক্ত। প্রয়াত লেখকের উপন্যাস “দীপ” কিনেছেন তিনি। মেলার উৎসবমুখর পরিবেশ খুব উপভোগ করছেন। তবে টিএসসি ও দোয়েল চত্বর এলাকায় যানবাহনের বিশৃঙ্খলায় লোকজনের খুব ভোগান্তি হচ্ছে। ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ সুবিধেমতো হচ্ছে না বলে তিনি অভিযোগ করলেন।
কাল শনিবারও মেলা শুরু হবে বেলা ১১টায়। এদিনও জনসমাগম হবে প্রচুর। সামনের সড়ক যানজট মুক্ত রাখতে ব্যবস্থা নেওয়া দারকার বলে গ্রন্থানুরাগী ও দর্শনার্থীদের মন্তব্য।
আলোচনা অনুষ্ঠান
শুক্রবার মেলার মূলমঞ্চে ছিল দুটি আলোচনা। বিকেল তিনটায় প্রথম আলোচনার বিষয় ছিল “আত্মর্জাতিক বলয়ে একুশে ফেব্রুয়ারি উদযাপন”। প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বিশ্বজিত সাহা। আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন ইকবাল হাসান, তাজুল ইমাম ও ইউসুফ রেজা। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব অসীম কুমার দে। অনুষ্ঠানের শুরুতে “জাতিসংঘের সামনে একুশ উদযাপন” শীর্ষক তথ্যচিত্র প্রদর্শিত হয়।
প্রাবন্ধিক বলেন, একুশে ফেব্রুয়ারি বাঙালি জাতিসত্তার শেকড়ের অনুপ্রেরণার দিন। এই দিনটি ঐতিহ্যের পরিচয়কে দৃঢ় করেছে। ১৯৯৯ সালে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালনের মধ্য দিয়ে আজ সেটি সকল ভাষার প্রতীক হয়ে উঠেছে। ইউনেসকো কর্তৃক অমর একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি প্রদান আজ বাংলাদেশ রাষ্ট্র ও বাঙালির বিশাল অহঙ্কারের বিষয়।
আলোচকেরা বলেন, বাংলাদেশের বাইরে বায়ান্নোর ভাষা আন্দোলনের চেতনাসমৃদ্ধ একুশে ফেব্রম্নয়ারি উদযাপন সত্যিই আমাদের জন্য গর্বের বিষয়। তবে শুধু রাষ্ট্রীয়ভাবে উদযাপন করাই নয়, প্রবাসী বাঙালিদের এই উদযাপনে আরও বেশি সম্পৃক্ত করতে হবে। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস বিশ্বজুড়ে যে সচেতনতা সৃষ্টি করেছে তাতে শুধু বাঙালিরাই উপকৃত হয়নি, বিশ্বের সকল ভাষাভাষী মানুষই ভাষার অধিকার রক্ষায় সুদৃঢ় ভিত্তি পেয়েছে।
দ্বিতীয় পর্বের আলোচনার বিষয় ছিল “মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বাংলাদেশের সাহিত্য ও সংস্কৃতি”। প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন জাহীদ রেজা নূর ও শহীদ ইকবাল। আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন আমিনুর রহমান সুলতান ও প্রশান্ত মৃধা। সভাপতিত্ব করেন অধ্যাপক ভীষ্মদেব চৌধুরী।
“বাংলা সাহিত্যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা” শীর্ষক প্রবন্ধ উপস্থাপন করে জাহীদ রেজা নূর বলেন, “একটি রক্তাক্ত জনযুদ্ধের ভেতর দিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে। এই জনযুদ্ধের একটি সাহিত্যিক মাত্রা আছে। এটি যথার্থ অনুধাবন করতে না পারলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বাংলাদেশের সাহিত্যিক ভূগোল বিনির্মাণ সম্ভব নয়।”
“মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বাংলাদেশের সংস্কৃতি” শীর্ষক প্রবন্ধ উপস্থাপন করে শহীদ ইকবাল বলেন, “বাংলাদেশের সংস্কৃতিতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতিফলন মানেই এ দেশের আপামর জনতার সার্বিক মুক্তির সংগ্রামকে ধারণ ও বেগবান করা।
সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান
সন্ধ্যায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে স্বরচিত কবিতা আবৃত্তি করেন কবি রবীন্দ্র গোপ, হারিসুল হক, ওবায়েদ আকাশ ও রনজু রাইম। আবৃত্তি করেন আবৃত্তিশিল্পী গোলাম সারোয়ার, বেলায়েত হোসেন ও রেজিনা ওয়ালী। জাহান বশিরের পরিচালনায় সাংস্কৃতিক সংগঠন বিশ্বভরা প্রাণের শিল্পীরা সংগীত পরিবেশন করেন।
লেখক বলছি অনুষ্ঠানে নিজেদের বই নিয়ে আলোচনা করেন আসলাম সানী ও সাধনা আহমেদ।