যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেন মঙ্গলবার (২২ ফেব্রুয়ারি) একদিকে রাশিয়ার বিরুদ্ধে অতিরিক্ত নিষেধাজ্ঞা আরোপে প্রস্তুত হয়েছে, অন্যদিকে ইওরোপীয় ইউনিয়নের মিত্র দেশগুলোও তাদের নিজস্ব উপায়ে ব্যবস্থা নিতে প্রস্তুতি নিচ্ছে। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের পূর্ব ইউক্রেনের দোনেৎস্ক এবং লুহানস্কের রাশিয়া-অধিকৃত অঞ্চলগুলোকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার পদক্ষেপের পরে নিষেধাজ্ঞার সিদ্ধান্ত নেয় পশ্চিমা দেশগুলো।
সোমবার ফোনে এক সংবাদ সম্মেলনে যুক্তরাষ্ট্রের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র পরবর্তী পদক্ষেপে “ইউক্রেনের সার্বভৌমত্ব ও আঞ্চলিক অখণ্ডতা এবং আন্তর্জাতিক আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘনের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি রাশিয়ার নিজস্ব অঙ্গীকার লঙ্ঘনের জন্য দেশটিকে দায়ী করা হবে।” যদিও ওই কর্মকর্তা সুস্পষ্টভাবে বিস্তারিত কোনো তথ্য তুলে ধরেননি।
ব্রিটিশ পররাষ্ট্রসচিব লিজ ট্রাস তার সরকারের গৃহীত পদক্ষেপ নিয়ে একই ধরনের মন্তব্য করেছেন। অন্যদিকে ফরাসি ও জার্মান প্রতিনিধিরা সোমবার জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের এক বৈঠকে ভাষণ দেওয়ার সময় দৃঢ় পদক্ষেপের প্রস্তুতির বিষয়ে সতর্ক করেছেন।
রাশিয়া ইউক্রেনের সীমান্তে সামরিক সরঞ্জামসহ ১ লাখ ৫০ হাজার সেনা মোতায়েন রাখায়, কয়েক সপ্তাহ ধরে যুক্তরাষ্ট্র ও ইওরোপীয় মিত্ররা রাশিয়া ইউক্রেনে হামলা করতে পারে বলে আশঙ্কা করছিল এবং হামলা হলে রাশিয়াকে চরম মুল্য দিতে হবে বলেও সতর্ক করেছিল।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন সোমবার ইউক্রেনের বিচ্ছিন্ন অঞ্চলগুলোকে পুতিনের স্বীকৃতি এবং ওই সব অঞ্চলে পুতিনের ভাষায় রুশ শান্তিরক্ষা বাহিনী মোতায়েন করার আদেশের প্রতিক্রিয়া হিসেবে একটি প্রাথমিক নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন।
বাইডেন প্রশাসনের একজন উর্ধতন কর্মকর্তা সাংবাদিকদের বলেন যে, প্রথম দফা নিষেধাজ্ঞাগুলো বিশেষভাবে তাৎক্ষণিক কার্যকলাপের জবাবে প্রস্তুত করা এবং “রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ করলে আমরা মিত্র ও অংশীদারদের সঙ্গে সমন্বয় করে যে দ্রুত এবং গুরুতর অর্থনৈতিক পদক্ষেপগুলো প্রস্তুত করছি তার সঙ্গে সম্পর্কিত নয়”।
বাইডেনের এই আদেশ নিষিদ্ধ অঞ্চলগুলোতে আমেরিকানদের নতুন বিনিয়োগ, বাণিজ্য এবং অর্থায়ন স্থগিত করবে। “পুতিনের ভাষণটি শুধুমাত্র রাশিয়ার নিরাপত্তা সম্পর্কে কোনো বক্তৃতা ছিল না”, প্রশাসনের একজন সিনিয়র কর্মকর্তা বলেন।“এটি ইউক্রেনের সার্বভৌমত্ব এবং স্বাধীনতার ওপর আক্রমণ ছিল। তিনি (পুতিন) স্পষ্ট করেছেন যে, তিনি ইউক্রেনকে ঐতিহাসিকভাবে রাশিয়ার অংশ হিসেবে দেখেন। এবং তিনি ইউক্রেনের বিরোধ সম্পর্কে অনেকগুলো মিথ্যা দাবি করেছেন, যা সম্ভাব্য সামরিক পদক্ষেপের অজুহাত হিসেবে নকশা করা হয়েছে বলে মনে হচ্ছে। এটি ছিল যুদ্ধের ন্যায্যতা দেওয়ার জন্য রুশ জনগণের উদ্দেশে একটি ভাষণ”।
এই সপ্তাহের শেষের দিকে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিংকেন রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভের সঙ্গে পূর্ব নির্ধারিত বৈঠকে যোগ দেবেন কি না তা বলতে পারেননি এই কর্মকর্তা। পুতিন ও বাইডেনের মধ্যে একটি সম্ভাব্য শীর্ষ বৈঠকের ব্যবস্থা করাই এই বৈঠকের উদ্দেশ্য ছিল। যুক্তরাষ্ট্র বলেছিল যে, উভয়ই রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ না করার বিষয়ে পূর্বাভাস দিয়েছে।
মঙ্গলবার রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রকের মুখপাত্র মারিয়া জাখারোভা বলেছেন যে, রাশিয়া এখনো “আলোচনার জন্য প্রস্তুত”।
ব্রুকিংস ইনস্টিটিউশনের বিশ্লেষক ও লেখক অ্যাঞ্জেলা স্টেন্ট সোমবার বলেছেন যে, বাইডেন ও পুতিনের মধ্যে একটি শীর্ষ বৈঠক এখন একটি বিশেষভাবে উদ্বেগজনক প্রস্তাব।
“এই মুহুর্তে, আমি মনে করি, রাশিয়ার জন্য কিছু শর্ত না রেখে, রাশিয়ার পক্ষ থেকে আলোচনায় কিছু সদিচ্ছা বা আন্তরিক আগ্রহ ছাড়া বা তাদের কিছু সিদ্ধান্তের পরিবর্তন ছাড়া প্রেসিডেন্ট বাইডেন এবং প্রেসিডেন্ট পুতিনের মধ্যে আরেকটি ব্যক্তিগত বৈঠকের কোনো মানে হয় না”। সাংবাদিক ও বিশ্লেষকদের তিনি বলেন। “কারণ, অন্যথায় ক্রেমলিন আমাদের নিয়ে খেলছে এবং মনে হচ্ছে তারা তাদের ইচ্ছামতোই এগোবে এবং এই আলোচনা নির্বিশেষে তারা যা করতে চায় তাই করবে”।
লেখক ও বিশ্লেষক স্টিভেন পিফার এই মন্তব্যের ব্যাপারে একমত পোষণ করেন। “আমি কূটনীতিকে ছোট করতে চাই না”, তিনি বলেন। “কিন্তু এই সময়ে, আমি মনে করি যে, হোয়াইট হাউসের কাছে কিছু ইঙ্গিত থাকতে হবে যে, পুতিনের সঙ্গে বৈঠকে আসলে কিছু অর্জনের সুযোগ থাকবে। এবং এই মুহূর্তে, ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁন ও জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ শোলজের অভিজ্ঞতার ওপর ভিত্তি করে, বলা যায়, অন্তত আমার মনে হচ্ছে, এই বৈঠকগুলো শুধু রুশ প্রেসিডেন্টের অহং বৃদ্ধি করছে। কিন্তু সংকট মোকাবিলায় পুতিনের সিদ্ধান্ত পরিবর্তনে কোনো প্রভাব ফেলতে পেরেছে বলে মনে হয় না”।
বাইডেন সোমবার জার্মান ও ফরাসি উভয় নেতার সঙ্গে এবং আলাদাভাবে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির সঙ্গে কথা বলেছেন। উভয় কলেই, হোয়াইট হাউস বলেছে, “নেতারা ইউক্রেনের তথাকথিত ডিএনআর এবং এলএনআর অঞ্চলকে “স্বাধীন” হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিনের সিদ্ধান্তের তীব্র নিন্দা করেছেন”।
ইইউ কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভন ডার লেইন এবং কাউন্সিলের সভাপতি চার্লস মিশেল এই বিচ্ছিন্নতাবাদী এলাকাগুলোকে পুতিনের স্বীকৃতি প্রদানকে “আন্তর্জাতিক আইনের স্পষ্ট লঙ্ঘন” বলে অভিহিত করে। ওয়াশিংটন সঙ্গে সঙ্গেই ইওরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে নিষেধাজ্ঞার ঘোষণায় যোগ দেয়।
ক্রেমলিন বলেছে যে, পুতিন সোমবার ফ্রান্স ও জার্মানির নেতাদের তার সিদ্ধান্ত সম্পর্কে অবহিত করেছেন এবং তারপরে অঞ্চলগুলোকে ইউক্রেনের অন্তর্ভুক্ত নয় বলে ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষর করেছেন।
পুতিন ক্রেমলিন থেকে রাশিয়ান জনগণের উদ্দেশে একটি দীর্ঘ টেলিভিশন ভাষণ দিয়েছেন। ভাষণে তিনি ইওরোপের জাতীয় সীমানার তার নিজস্ব সংস্করণ এবং ১৯৯০–এর দশকের সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার ইতিহাস উপস্থাপন করেন।
তিনি যুক্তি দেখান, ইউক্রেন “কখনই” একটি প্রকৃত দেশ ছিল না বরং ঐতিহাসিকভাবে রাশিয়ার একটি অংশ ছিল।
যুক্তরাষ্ট্র এবং তার নেটো মিত্ররা দাবি করেছে যে, রাশিয়া ইউক্রেনীয় বাহিনীকে একটি ক্রমবর্ধমান হুমকি হিসেবে দেখাতে দোনেৎস্ক ও লুহানস্কে মিথ্যা অভিযান পরিচালনা করছে। কিয়েভ বলেছে যে, এটি পূর্ব ইউক্রেনের অঞ্চলে পরিপূর্ণ কোনো হামলা চালাতে আগ্রহী নয় এবং পশ্চিমা দেশগুলোর দাবি রাশিয়া রাশিয়ার প্রতি সহানুভূতিশীলদের রক্ষা করার জন্য একটি আক্রমণের ন্যায্যতা দেওয়ার চেষ্টা করছে।
[এই প্রতিবেদনের কিছু তথ্য দ্য অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস, এজেন্সি ফ্রান্স-প্রেস এবং রয়টার্স থেকে নেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া ভয়েস অফ আমেরিকার ক্রিস হ্যানাস প্রতিবেদনে ভূমিকা রেখেছেন]