গাজীপুরের শ্রীপুরে অবস্থিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্কে গত জানুয়ারি মাসে ১১টি জেব্রা মৃত্যুর ঘটনায় দায়ীদের বিরুদ্ধে মামলা হচ্ছে। এ ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে উল্লেখিত মতামত অনুযায়ী দায়ীদের সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়ার লক্ষ্যে ফৌজদারী মামলা দায়েরের এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়।
একই সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বিভাগীয় মামলাও করা হবে। এছাড়াও, তদন্ত কমিটির করা ২৪ টি সুপারিশ পর্যায়ক্রমে বাস্তবায়ন করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
মঙ্গলবার পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিনের সভাপতিত্বে মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে অনুষ্ঠিত তদন্ত প্রতিবেদন পর্যালোচনা সভায় এ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। সভায় অন্যদের মধ্যে উপ-মন্ত্রী হাবিবুন নাহার, সচিব মো. মোস্তফা কামাল, অতিরিক্ত সচিব(প্রশাসন) ইকবাল আব্দুল্লাহ হারুন, অতিরিক্ত সচিব (জলবায়ু পরিবর্তন) মো. মিজানুল হক চৌধুরী, অতিরিক্ত সচিব (উন্নয়ন) ও তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক সঞ্জয় কুমার ভৌমিক, অতিরিক্ত সচিব (পরিবেশ দূষণ নিয়ন্ত্রণ) কেয়া খান এবং উপসচিব ও তদন্ত কমিটির সদস্য সচিব মোহাম্মদ আব্দুল ওয়াদুদ চৌধুরী উপস্থিত ছিলেন।
গত রবিবার মন্ত্রণালয়ে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়া হয়। ওই প্রতিবেদনের ওপর পর্যালোচনায় বলা হয়, ঘাসে অতিরিক্ত নাইট্রেটের প্রভাব ও মিশ্র ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণে সকল জেব্রার মৃত্যু হয়েছে।
তবে, প্রথম দিকের তিনটি জেব্রার (২ ও ৩ জানুয়ারি) মৃত্যু ধামাচাপা দেয়া এবং আঘাত জনিত কারণ প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে ওই মৃত তিনটি জেব্রার পেট ধারালো কিছু দিয়ে কাটা হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। কে বা কারা ওই মৃত তিনটি জেব্রার পেট কেটেছে তা উদঘাটন করার জন্য নিবিড় তদন্তের প্রয়োজন বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, কর্তব্যরত ভেটেরিনারি অফিসারের চাহিদা মোতাবেক ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, সাফারি পার্ক মেডিকেল বোর্ডের সভা ডাকার কথা থাকা সত্ত্বেও এতগুলো জেব্রার অস্বাভাবিক মৃত্যুর পরও জরুরিভিত্তিতে মেডিকেল বোর্ডের সভা ডাকা হয়নি, যা সংশ্লিষ্ট দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের দায়িত্বহীনতার শামিল। কোন প্রাণীর অস্বাভাবিক মৃত্যুর ঘটনায় জিডি করার প্রচলন থাকলেও এক্ষেত্রে থানায় কোন জিডি করা হয়নি, যা রহস্যজনক। পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের সচিব গত ২২ জানুয়ারি সাফারি পার্ক পরিদর্শন করেন। ওই দিন পর্যন্ত আটটি জেব্রা মারা গেলেও প্রকল্প পরিচালক, ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, ভেটেরিনারি কর্মকর্তা বা কর্মরত অন্য কেউ জেব্রার মৃত্যুর ঘটনাটি সচিবকে অবহিত করেননি। এতে প্রতীয়মান হয় প্রথম থেকেই জেব্রা মৃত্যুর ঘটনাটি ধামাচাপা দেয়ার অপচেষ্টা করা হয়েছে। বিষয়টি অস্বাভাবিক, অগ্রহণযোগ্য ও সরকারি কর্মচারী আচরণের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়, যা দায়িত্ব অবহেলার শামিল। তদন্ত কমিটির এ সকল মতামত বিবেচনায় নিয়ে প্রকৃত দোষীদের চিহ্নিত করে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে ফৌজদারী মামলা ও বিভাগীয় মামলা দায়ের করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে মন্ত্রণালয়।
এছাড়াও, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্ক, গাজীপুরের প্রাণী মৃত্যুরোধ ও ব্যবস্থাপনা উন্নয়নের জন্য করণীয় বিষয়ে তদন্ত কমিটির সুপারিশকৃত ১১ টি স্বল্পমেয়াদী, চারটি মধ্য-মেয়াদী এবং ৯টি দীর্ঘ মেয়াদী সুপারিশ পর্যায়ক্রমে বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নিয়েছে মন্ত্রণালয়।
উল্লেখ্য, জেব্রা মৃত্যুর ঘটনার কারণ উদ্ঘাটন, দায়-দায়িত্ব নিরুপণ ও ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে সুপারিশের জন্য পরিবেশ, বন পরিবর্তন জলবায়ু মন্ত্রণালয় ২৬ জানুয়ারি পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট কমিটি গঠন করে। কমিটিকে ১০ কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিলের জন্য দায়িত্ব দেয়া হয়। পাঁচ সদস্য বিশিষ্ট কমিটি ৩০ জানুয়ারি ঘটনাস্থল সরেজমিন পরিদর্শন করেন। সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে পরবর্তীতে কমিটিতে আরও দুজন বিশেষজ্ঞ সদস্য এবং যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমোদনক্রমে জেলা প্রশাসক, গাজীপুরের প্রতিনিধি হিসেবে একজন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসককে কো-অপ্ট করা হয়। তাছাড়া পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় থেকে গঠিত তদন্ত কমিটিকে কাজের সহায়তা এবং চিকিৎসা সংক্রান্ত বিষয়ে পরামর্শ দেয়ার জন্য তিনজন কর্মকর্তাকে মনোনয়ন দেয়া হয়। আট সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি এবং তিন সদস্য বিশিষ্ট সহায়ক প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে ৯ ফেব্রুয়ারি ও ১২ ফেব্রুয়ারি সরেজমিন তদন্ত করে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়। সর্বশেষ ১৯ ফেব্রুয়ারি কমিটির সভা ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয়।
উল্লেখ্য যে তদন্ত কমিটির আবেদনের প্রেক্ষিতে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের মেয়াদ ১০ ফেব্রুয়ারি থেকে আরও সাত কার্যদিবস বৃদ্ধি করা হয়। সার্বিক তদন্ত শেষে ২০ ফেব্রুয়ারি নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই তদন্ত কমিটি তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করে।