জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে ইউক্রেনে আক্রমণের নিন্দা ও হামলা প্রতিহত করতে একটি প্রস্তাব রাশিয়া শুক্রবার (২৫ ফেব্রুয়ারি) রুখে দিয়েছে। তবে বেশ কয়েকটি দেশ বলেছে যে, তারা জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে পূর্ণ সদস্যপদ থেকে জবাবদিহিতা চাইবে।
“আমি স্পষ্টভাবে বলতে চাই, আপনি যদি জাতিসংঘের সনদ বহাল রাখায় আস্থা রাখেন, তবে হ্যাঁ ভোট দিন। আপনি যদি ইউক্রেনের—বা অন্য কোনো রাষ্ট্রের—সার্বভৌমত্ব ও আঞ্চলিক অখণ্ডতার অধিকার সমর্থন করেন তবে হ্যাঁ ভোট দিন৷ যদি আপনি বিশ্বাস করেন যে, রাশিয়াকে তার কর্মের জন্য জবাবদিহি করতে হবে, তাহলে হ্যাঁ ভোট দিন”, যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত লিন্ডা থমাস-গ্রিনফিল্ড পরিষদকে বলেন। “যদি এই সনদে বিশ্বাস না রাখেন এবং রাশিয়ার আক্রমনাত্মক ও উস্কানিবিহীন হামলার সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করার ইচ্ছা পোষণ করে থাকলে না ভোট দিন, বা ভোটদানে বিরত থাকুন।”
যুক্তরাষ্ট্র ও আলবেনিয়ার প্রস্তুতকৃত খসড়া প্রস্তাবটি নিরাপত্তা পরিষদের ১৫ সদস্যের মধ্যে ১১ সদস্য সমর্থন করে। চীন, ভারত ও সংযুক্ত আরব আমিরাত ভোটদানে বিরত থাকে। একটি প্রস্তাব পাশের জন্যে পক্ষে নয়টি ভোট প্রয়োজন হয়, তবে কোনো ভেটোও থাকতে পারবে না।
নরওয়ের রাষ্ট্রদূত রুশ রাষ্ট্রদূতকে ভোট দেওয়ার অনুমতি দেওয়া উচিত ছিল কি না তা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন।
“আক্রমণকারীর দ্বারা একটি ভেটো কাউন্সিলের উদ্দেশ্যকে ক্ষুণ্ন করে। এটি জাতিসংঘের সনদের ভিত্তির লঙ্ঘন”, মোনা জুল বলেন। “তাছাড়া, সনদের চেতনায়, একটি সদস্য হিসেবে রাশিয়ার এই রেজুলেশনে ভোট দেওয়া থেকে বিরত থাকা উচিত ছিল।”
রাশিয়ার জবাব
রুশ রাষ্ট্রদূত ভ্যাসিলি নেবেনজিয়া এই মাসে নিরাপত্তা পরিষদের সভাপতি হতে চলেছেন, তিনি এই বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন, যেখানে তার সরকারকে ব্যাপকভাবে সমালোচনা করা হয়। মস্কোকে র্ভৎসনা করতে চাওয়া প্রস্তাবে যোগদানকারী কয়েক ডজন দেশের নামও পড়ে শোনানোর দায়িত্ব ছিল তার ওপর।
বৈঠক শেষে ৮০টিরও বেশি দেশ সেই তালিকায় যোগ দিয়েছে।
নেবেনজিয়া দাবি করেন, খসড়া প্রস্তাবটিকে শুধুমাত্র “রুশ-বিরোধী” হওয়ার কারণে খারিজ করেননি তিনি, বরং ইউক্রেন বিরোধী হিসেবেও খারিজ করেছেন, কারণ তিনি বলেন, এটি ইউক্রেনীয় জনগণের স্বার্থের পরিপন্থী।
“আজকের খসড়া প্রস্তাবটি ইউক্রেনের সমকালীন দৃশ্যপটে আরেকটি নৃশংস, অমানবিক পদক্ষেপ ছাড়া আর কিছুই নয়”, তিনি বলেন।
মস্কো ইউক্রেনের জনগণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালাচ্ছে এই অভিযোগ অস্বীকার করে তিনি বলেন, রাশিয়া পূর্ব ইউক্রেনের বাসিন্দাদের রক্ষা করার জন্য জাতীয়তাবাদীদের বিরুদ্ধে একটি “বিশেষ অভিযান” চালাচ্ছে।
বিচ্ছিন্ন রাশিয়া
রাশিয়ার আগ্রাসন আত্মরক্ষার জন্য এবং রুশ-সমর্থিত বিচ্ছিন্নতাবাদী এলাকায় বসবাসকারী জনগণকে রক্ষা করার জন্য, এমন দাবির বিপরিতে ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূত বলেন, “এটা অযৌক্তিক। রাশিয়া শুধুমাত্র আত্মরক্ষার্থে যে কাজটি করেছে তা হলো এই প্রস্তাবের বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছে”, ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূত বারবারা উডওয়ার্ড বলেন। “জেনে রাখুন রাশিয়া বিচ্ছিন্ন। ইউক্রেনে আগ্রাসনের পক্ষে দেশটি কারও সমর্থন পাবে না।”
ইউক্রেনের রাষ্ট্রদূত বলেছেন, তার দেশ প্রায় সব দিক থেকে অবরোধের মধ্যে রয়েছে।
“গত রাতটি কিয়েভের জন্য সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ছিল, ১৯৪১ সালে যখন এটি নাৎসিদের দ্বারা আক্রান্ত হয়েছিল তখনকার কথা ভাবুন একবার”, সের্গি কিসলিয়্যাস বলেছেন৷
তিনি পরিষদে বলেন, তার দেশ সামনে আরও কঠিন রাতের মুখোমুখি হবে, এবং তিনি কূটনীতিকদের শান্তির জন্য প্রার্থনা বা ধ্যান করার জন্য এক মিনিট নীরব থাকতে অনুরোধ করেন।
“যারা ইতিমধ্যে নিহত হয়েছেন তাদের আত্মার জন্য প্রার্থনা করা, যারা নিহত হতে পারেন তাদের আত্মার জন্য”, তিনি বলেন। “এবং আমি রাশিয়ান রাষ্ট্রদূতকে পরিত্রাণের জন্য প্রার্থনা করার জন্য আমন্ত্রণ জানাই।”
গত আট বছরে পূর্ব ইউক্রেনে যারা নিহত হয়েছেন তাদেরও অন্তর্ভুক্ত করা উচিত বলে রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত মন্তব্য করেন। জাতিসংঘ বলছে, সংঘর্ষে এখন পর্যন্ত ১৪ হাজার মানুষ মারা গেছেন।
“সমস্ত মানুষের জীবন মূল্যবান”, নেবেনজিয়া বলেছিলেন।
পরবর্তী পদক্ষেপ
ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের প্রেসিডেন্ট কমফোর্ট ইরো বলেছেন, “রাশিয়া যে নিরাপত্তা পরিষদে ইউক্রেনের বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে বাধা দেবে সেটা অনিবার্য ছিল।” “কিন্তু এটি গুরুত্বপূর্ণ যে, জাতিসংঘের সকল সদস্য রাষ্ট্রগুলো, যারা মস্কোর সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য জাতিসংঘকে ব্যবহার করে, জানিয়ে দিচ্ছে এই যুদ্ধটি রাশিয়ার বৈশ্বিক ভাবমূর্তিকে কতটা ক্ষতিগ্রস্ত করবে।”
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের নির্বাহী পরিচালক কেনেথ রথ বলেছেন যে, রাশিয়ার ভেটো আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি তার উদাসীনতার পরিচায়ক। নিরাপত্তা পরিষদের এই ঘাটতি পূরণের জন্য তিনি সাধারণ পরিষদকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান।
“বৃহৎ পরিসরে আন্তর্জাতিক মানবিক আইনের সম্ভাব্য লঙ্ঘন থেকে বেসামরিক নাগরিকদের রক্ষা করার জন্য আন্তর্জাতিক তদন্ত প্রয়োজন”, বলে মন্তব্য করেন তিনি।
থমাস-গ্রিনফিল্ড সাংবাদিকদের বলেন, “আমরা এই বিষয়টিকে সাধারণ পরিষদে নিয়ে যাব, যেখানে রাশিয়ার ভেটো প্রযোজ্য হবে না এবং বিশ্বের দেশগুলো রাশিয়ার কাছে জবাবদিহিতা চাইবে।”
খসড়াটি ১৯৩ সদস্যের একটি বৃহৎ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে আগামী দিনে গৃহীত হতে পারে। এর মাধ্যমে মস্কোকে একটি শক্তিশালী প্রতীকী বার্তা পাঠানো যে, এই আগ্রাসনের কারণে দেশটি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় থেকে ব্যাপকভাবে বিচ্ছিন্ন।