অ্যাকসেসিবিলিটি লিংক

ইউক্রেনে রাশিয়ার আক্রমণ : ড. সাঈদ ইফতেখার আহমেদের বিশ্লেষণ


ইউক্রেনের কিয়েভের অদূরে একটি এলাকায় শনিবার একটি আবাসিক বিল্ডিং এ সকালে যে জায়গায় আঘাত হেনেছিল সেখানে অগ্নিনির্বাপক কর্মীরা কাজ করছেন। ২৫ ফেব্রুয়ারী, ২০২২, ছবি-ভিওএ
ইউক্রেনের কিয়েভের অদূরে একটি এলাকায় শনিবার একটি আবাসিক বিল্ডিং এ সকালে যে জায়গায় আঘাত হেনেছিল সেখানে অগ্নিনির্বাপক কর্মীরা কাজ করছেন। ২৫ ফেব্রুয়ারী, ২০২২, ছবি-ভিওএ

রাশিয়া বৃহস্পতিবার দিনের শুরুর দিকে ইউক্রেনে আক্রমণ আরম্ভ করে। প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন অন্যান্য দেশকে সতর্ক করেছেন যাতে তারা হস্তক্ষেপ না করে। অপরদিকে, ইউক্রেনের পশ্চিমা মিত্ররা রাশিয়ার আক্রমণের নিন্দা জানিয়ে, ইউক্রেনের প্রতি তাদের সমর্থন ও নতুন দফায় কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপের অঙ্গীকার করেছে। ঘটনার এই দ্রুত বিবর্তনের প্রেক্ষাপটে ভয়েস অফ আমেরিকার বাংলা বিভাগের পক্ষে আনিস আহমেদ কথা বলেছেন আমেরিকান পাবলিক ইউনিভার্সিটি সিস্টেমের ফ্যাকাল্টি সদস্য এবং রাজনীতি ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক বিশ্লেষক ড. সাঈদ ইফতেখার আহমেদের সঙ্গে ।

প্রশ্ন: রাশিয়া যে ইউক্রেন আক্রমণ করবে এই প্রায় নিশ্চিত ভবিষদ্ববাণীর কথা আমরা সাম্প্রতিক সময়ে শুনে আসছিলাম যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা শক্তির কাছ থেকে এবং এই বৃহস্পতিবার স্থানীয় সময় ভোরে সব জল্পনা কল্পনার অবসান ঘটিয়ে রাশিয়া আক্রমণ চালালো ইউক্রেনের উপর । তা হ’লে এতদিন প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ইউক্রেন আক্রমণ না করার মিথ্যে আশ্বাস দিয়ে আসছিলেন কেন ?

ড. আহমেদ : এটা ঠিক যে পুতিন বলে আসছিলেন যে ইউক্রেন আক্রমণ রাশিয়ার লক্ষ্য নয় কিন্তু অপর দিকে যুক্তরাষ্ট্র ক্রমাগত বলে আসছিল যে রাশিয়ার যে সমরসজ্জা , সামরিক যে মহড়া সেটার মূল লক্ষ্য কিন্তু ইউক্রেন আক্রমণ করা। তবে যে জিনিষটা আমাদের কাছে মনে হয়েছে, সেটা হলো ইউক্রেন আক্রমণের লক্ষ্য নিয়েই রাশিয়া শুরু থেকেই একটা ব্যাপক সামরিক মহড়া শুরু করেছিল। ইউক্রেনের উপর রাশিয়ার যে আক্রমণ সেটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপের ভূখন্ডে সব চেয়ে বড় সামরিক আক্রমণ । একটা জিনিষ কিন্তু স্পষ্ট ছিল যে রাশিয়া কোন ভাবেই চাইছিল না যে ইউক্রেন নেটোর সদস্য হোক। সুতরাং অফিসিয়ালি রাশিয়া যাই-ই বলে থাকুক না কেন , যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যদের কাছে এটাই প্রতীয়মান হয় যে মূলত ইউক্রেনকে আক্রমণের লক্ষ্য নিয়েই রাশিয়া সামরিক প্রস্তুতি নিচ্ছিল। কৌশলের অংশ হিসেবেই হয়ত পুতিন বলে আসছিলেন যে তিনি ইউক্রেন আক্রমণ করবেন না।

প্রশ্ন: সামনের দিনগুলোতে কি রকমের আশংকা দেখছেন ? শেষ অবধি কি ইউক্রেন অধিগ্রহণ করতে পারবে রাশিয়া, নাকি আগেরবারের মতো কিছু অংশ দখল করে থেমে যাবে ? এই যুদ্ধের পরিণতিটা ঠিক কি হবে ?

ড. আহমেদ : রাশিয়া ইউক্রেনের কাছে দু’টি দাবি করেছে এবং বলছে যে ইউক্রেন যদি দাবি দু’টি মেনে নেয় তা হ’লে রাশিয়া ইউক্রেনের সঙ্গে আলোচনায় বসবে। এই দু’টি দাবির একটি হচ্ছে যে ইউক্রেনকে গ্যারান্টি দিতে হবে যে ইউক্রেনে নেটো জোটে যোগ দেবে না আর দ্বিতীয় দাবি হচ্ছে, ইউক্রনের সমস্ত সামরিক স্থাপনা বিলুপ্ত করে ফেলতে হবে অর্থাত্ ইউক্রেন কোন সেনাবাহিনী রাখতে পারবে না। একই সাথে রাশিয়া বলছে তারা যে লক্ষ্য নিয়ে রাশিয়ার ভাষায় এই অভিযান শুরু করেছে, সেই অভিযান তারা অব্যাহত রাখবে। আসলে রাশিয়া যা বলছে আর যা করছে তার মধ্যে একটা ফারাক আমরা দেখে আসছি । সুতরাং ইউক্রেন যদি আলোচনায় রাজিও হয় রাশিয়া এই আক্রমণ বন্ধ করবে কী না সেটা প্রশ্ন সাপেক্ষ । রাশিয়ার এই মূহুর্তের লক্ষ্য হচ্ছে ইউক্রেনের সেনাবাহিনীকে, বিশেষত কিয়েভকে ঘিরে ফেলা এবং তাই তারা করছে। রাশিয়া যে ভাবে চারদিক থেকে ইউক্রেনকে আক্রমণ করছে তাতে অনুমানে বলা যায় রাশিয়ার হয়ত লক্ষ্য হচ্ছে কিয়েভের বর্তমান সরকারকে উত্খাত করা এবং সেখানে একটি রুশপন্থি সরকার স্থাপন করা।

প্রশ্ন: এই যে রাশিয়ার দাবি যে ইউক্রেন কোন সেনাবাহিনী রাখতে পারবে না, তাতেতো পুরোপুরি ভাবে ইউক্রেনের সার্বভৌমত্ব নষ্ট হচ্ছে !

ড. আহমেদ : অবশ্যই । কেবল যে সৈন্য রাখার বিষয় তাই-ই নয়, ইউক্রেন কোন জোটে যাবে কী যাবেনা সেটার গ্যারান্টিও রাশিয়াকে দিতে হবে। তার পরেও ইউক্রেনের যে মূলভূখন্ড সেটা অখন্ড থাকবে কী থাকবে না সে বিষয়গুলোও পরিস্কার নয়।কতদূর তারা যাবে সেটা এই মুহুর্তে বলা মুশকিল তবে রাশিয়ার মিডিয়া বলছে, যে লক্ষ্য নিয়ে তারা এই সামরিক অভিযান শুরু করেছে সেই লক্ষ্য অর্জিত না হওয়া অবধি তারা এটা চালিয়ে যাবে। তবে এই লক্ষ্যটা যে কী সেটা তারা এখনও বিশ্বের কাছে পরিস্কার করেনি।

প্রশ্ন: এই যে ইউক্রেনকে নেটোর সদস্য হতে দেবে না, বলছে রাশিয়া এটাতো যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিমি বিশ্বের কাছে একটা বড় রকমের চ্যালেঞ্জ। পশ্চিম কি ভাবে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করবে ?

ড. আহমেদ : এটি পশ্চিমের কাছে শীতল যুদ্ধোত্তর কালে সব চেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্ব যে বিষয়টি নিয়ে সব চেয়ে বেশি উদ্বিগ্ন যে কারণে সেটি হচ্ছে ইউক্রেনে যুক্তরাষ্ট্রের এবং পশ্চিমা শক্তির যে নীতি সেই নীতি বাস্তবায়নে তারা যদি ব্যর্থ হয় এবং রাশিয়া যদি ইউক্রেনে জয়লাভ করে তা হলে শীতল যুদ্ধোত্তর যে বিশ্ব ব্যবস্থা বা যুক্তরাষ্ট্র কেন্দ্রীক যে বিশ্বব্যবস্থার উদ্ভব হয়েছে সেই বিশ্ব ব্যবস্থায় একটা আমূল পরিবর্তন চলে আসতে পারে এবং বিশ্বের ব্যালেন্স অফ পাওয়ারে পরিবর্তন ঘটতে পারে। এই বিষয়টাই কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্বকে উদ্বিগ্ন করে তুলছে।

প্রশ্ন: রাজনৈতিক বলুন কিংবা অর্থনৈতিকই বলুন গোটা বিশ্বে এই যুদ্ধের কি প্রভাব পড়তে পারে ?

ড. আহমেদ : অর্থনৈতিক প্রভাবতো এরই মধ্যে দেখছি। জ্বালানি তেলের দাম ব্যারেল প্রতি ১০০ ডলার ছাড়িয়ে গেছে। ২০১৪ সালে পর ইউরোপে জ্বালানি তেলের দাম দ্বিগুণ হয়ে গেছে, বিভিন্ন দেশে স্টক মার্কটের পতন আমরা দেখতে পাচ্ছি এবং যুদ্ধ যত দীর্ঘস্থায়ী হবে , বিভিন্ন পণ্যের দাম ততটাই বাড়তে থাকবে এবং বিশেষত উন্নয়নশীল বিশ্ব নানা ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে মনে করা হচ্ছে। আর রাজনৈতিক ভাবে যে বিষয়টি দাড়াতে পারে সেটি হচ্ছে , বিশ্বে রাশিয়া ও চীন আরও প্রভাবশালী হয়ে উঠবে এবং রাশিয়া -চীন কেন্দ্রিক একটা বিশ্ব ব্যবস্থার উত্থান ঘটতে পারে বলে অনেকে মনে করছেন। সুতরাং এই যুদ্ধের ফলে বিশ্বে শক্তির যে ভারসাম্য এতদিন থেকে চলে আসছে, যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমি বিশ্বের সমন্বয়ে তাতে একটা মৌলিক পরিবর্তন আসতে পারে বলে অনেক বিশ্লেষকই মনে করেন।

প্রশ্ন: যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যান্য দেশ ও জোটের পক্ষ থেকে যে সব নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে রাশিয়ার বিরুদ্ধে তার প্রভাব কতখানি পড়বে রাশিয়ার উপর ?

ড. আহমেদ : প্রতিকুল প্রভাব অবশ্যই পড়বে কিন্তু লক্ষ্য করার বিষয় হলো এ যাবত্ আরোপিত নিষেধাজ্ঞাগুলি সবটাই অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা। আসলে নিষেধাজ্ঞা আরোপের খুব বেশি বিকল্পও নেই পশ্চিমা শক্তির কাছে। আর সমস্যাটা সেখানেই যে বিকল্প ফুরিয়ে গেলে কি হবে । আর এটাও মাথায় রাখতে হবে যে রাশিয়ার মতো অর্থনৈতিক ভাবে একটি শক্তিশালী দেশ , চীনের সঙ্গে যার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে তাকে শুধুমাত্র অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা দিয়ে কাবু করা কিন্তু বেশ কঠিন।

---ড. সাঈদ ইফতেখার আহমেদ আপনাকে ভয়েস অফ আমেরিকার পক্ষ থেকে অনেক ধন্যবাদ।

ড. আহমেদ : ধন্যবাদ আপনাকেও।

XS
SM
MD
LG