অ্যাকসেসিবিলিটি লিংক

বাংলাদেশের চলচ্চিত্র জগতের ১৮ সংগঠন কতটা সক্রিয়?


বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন কর্পোরেশন, বিএফডিসি'র প্রধান ফটক।
বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন কর্পোরেশন, বিএফডিসি'র প্রধান ফটক।

সদ্য অনুষ্ঠিত শিল্পী সমিতির নির্বাচনে বিএফডিসিতে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা ছিল চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্ট ১৭টি সংগঠনের। চলচ্চিত্রের বিভিন্ন সংকট ও পদক্ষেপ নেওয়ার কারণে আলোচনায় চলে আসে শিল্পী সমিতিসহ ১৮টি সংগঠন। সম্প্রতি চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতি ব্যতীত ১৭ সংগঠন প্রধান নির্বাচন কমিশনার পীরজাদা শহীদুল হারুনকে আজীবনের জন্য নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।

ওদিকে শনিবার (৫মার্চ) এই ১৮ সংগঠনের ব্যানারে শিল্পী সমিতির সাধারণ সম্পাদক জায়েদ খানকে বয়কট করা হয়েছে।

চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্ট সকল সংগঠন মিলে ২০১৭ সালে গঠন করেছিল 'চলচ্চিত্র পরিবার।' আহবায়কের দায়িত্ব পালন করেছিলেন চিত্রনায়ক ফারুক। যৌথ প্রযোজনার চলচ্চিত্র মুক্তি দেওয়ার নামে 'প্রতারণা' করা হচ্ছিল বলে চলচ্চিত্র পরিবার যখন অভিযোগ তুলেছিল তখন শীর্ষ অভিনেতা শাকিব এর বিরোধীতা করছিলেন, এমন অভিযোগে শাকিব খানকে নিষিদ্ধও করা হয়েছিল সেসময়।

২০২০ সালের ১৫ জুলাই তৎকালীন চলচ্চিত্র সমিতির সভাপতি মিশা সওদাগর ও সাধারণ সম্পাদক জায়েদকে ১৮টি সংগঠন নিষিদ্ধ করেছিল। এ নিয়ে মানববন্ধনও হয়েছিল। সেসময় মাসুদ পারভেজ সোহেল রানা এই নিষিদ্ধের বিরোধীতা করেছিলেন। চলচ্চিত্র সংগঠনের জোটবদ্ধভাবে নিষিদ্ধের তালিকা থেকে বাদ যাননি স্বয়ং রাজ রাজ্জাকও। তিনিও একবার নিষিদ্ধ হয়েছিলেন বলে জানিয়েছিলেন জ্যেষ্ঠ পরিচালক সি বি জামান। পরে নিষিদ্ধ হয়েছেন সালমান শাহ, পপিও।

চলচ্চিত্রের বর্তমান সংকট সমাধানে এবং এ অঙ্গনে যে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে, তা সমাধানে ফের একজোট হয় চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্ট ১৮টি সংগঠন। সংগঠনগুলোর প্রধান করা হয় বরেণ্য চিত্রনায়ক আলমগীরকে। তবে শনিবার (৫ মার্চ) ১৮ সংগঠনের পক্ষ থেকে জায়েদ খানকে বয়কটের যে সিদ্ধান্ত যে প্যাডে জানানো হয় সেখানে আহবায়ক হিসেবে সোহানুর রহমান সোহানের নাম রয়েছে। সোহান পরিচালক সমিতির সভাপতির দায়িত্বও পালন করছেন। ১৮ সংগঠনের সকল কার্যক্রম পরিচালক সমিতি থেকেই নিয়ন্ত্রিত হয়।

চলচ্চিত্রের ১৮ সংগঠন কারা?

১. চলচ্চিত্র প্রযোজক সমিতি, ২. চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতি, ৩. চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতি ৪. চলচ্চিত্র গ্রাহক সমিতি, ৫. চলচ্চিত্র সহকারী পরিচালক সমিতি, ৬. ফিল্ম এডিটর’স গিল্ড, ৭. চলচ্চিত্র উৎপাদন ব্যবস্থাপক সমিতি, ৮. চলচ্চিত্র নৃত্য পরিচালক সমিতি, ৯ চলচ্চিত্র লেখক সমিতি, ১০.স্থিরচিত্র গ্রাহক সমিতি, ১১ চলচ্চিত্র রূপসজ্জাকর সমিতি. ১২. চলচ্চিত্র অঙ্গসজ্জাকর সমিতি, ১৩.চলচ্চিত্র উৎপাদন সহকারী ব্যবস্থাপক সমিতি, ১৪. মারপিট সমিতি, ১৫.চলচ্চিত্র শিল্প নির্দেশক সমিতি, ১৬.চলচ্চিত্র লাইট সরবরাহ মালিক সমিতি, ১৭. চলচ্চিত্র সহকারী চিত্রগ্রাহক সমিতি ১৮.ফিল্ম ক্লাব।

সরেজমিনে এফডিসি ঘুরে চারটি সংগঠনের সাইনবোর্ড চোখে পড়েছে। এখান থেকে কার্যক্রম চললেও টেকনিক্যালি সাইনবোর্ডে স্টাডিরুম বলা হয়।

বর্তমানে এফডিসিতে স্টাডিরুম রয়েছে ৪ টি

চলচ্চিত্র প্রযোজক সমিতি, চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতি, চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতি ও বাংলাদেশ চলচ্চিত্রগ্রাহক সমিতির স্টাডিরুম বা কার্যালয় রয়েছে।

এছাড়াও এফডিসির অভ্যন্তরে চলচ্চিত্র উৎপাদন ব্যবস্থাপক সমিতি একটি কক্ষ নিয়ে তাদের কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে।

নিবন্ধিত সংগঠনের সংখ্যা ৬ টি

নিবন্ধিত সংগঠনগুলো হলো, চলচ্চিত্র প্রযোজক সমিতি, চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতি, চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতি, চলচ্চিত্র গ্রাহক সমিতি, চলচ্চিত্র সহকারী পরিচালক সমিতি ও ফিল্ম ক্লাব লিমিটেড।

নিবন্ধিত সংগঠন চলচ্চিত্র সহকারী পরিচালক সমিতির কোনো কার্যালয় বা স্ট্যাডি রুম নেই। এফডিসির একটি কক্ষে মালামাল রাখা হয়েছে। সদস্যরা এসে বসেন পরিচালক সমিতিতে। নিবন্ধিত এই সংগঠনের ৩ নম্বর ফ্লোরের সঙ্গে একটি স্ট্যাডি রুম ও পাঠাগার ছিল। সেটি ভেঙে ফেলায় এখন ঠিকানাহীন সংগঠনটি।

ফিল্ম লিমিটেডের কার্যালয় রয়েছে রাজধানীর নিকেতনে।

সব সংগঠনের স্টাডিরুম ছিল এফডিসিতে

এক সময় ১৮ সংগঠনের প্রায় সবগুলোরই কার্যালয় বা স্টাডিরুম এফডিসির অভ্যন্তরে ছিল। সাদাকালো ল্যাব ভেঙে ফেলে ডিজিটাল কালার ল্যাব নির্মাণের সময় বেশ কয়েকটি সংগঠনের কার্যালয় বিলুপ্ত হয়। বাকি সংগঠনগুলোর কার্যালয় বা স্টাডিরুম ছিল ৩ ও ৪ নম্বর ফ্লোরের বিভিন্ন কক্ষে। করোনা মহামারীর মধ্যে এ দুটি ফ্লোর বহুতল ভবন নির্মাণের জন্য ভেঙে ফেলা হলে বাকি সংগঠনগুলো ঠিকানাহীন হয়ে পরে।

চলচ্চিত্র সম্পাদনাকারীদের সংগঠনের নাম ফিল্ম এডিটর’স গিল্ড। এই সংগঠনের সভাপতি আবু মুসা দেবু। তিনি বলেন, “আমাদের স্টাডিরুম ছিল ৪ নম্বর ফ্লোরের সঙ্গে। সেটি ভেঙে ফেলায় এখন আমাদের সে অর্থে ঠিকানা নেই।”

এডিটর গিল্ডস-এর সদস্য সংখ্যা পূর্বে অনেক থাকলেও ৩৫ মিলিমিটার থেকে ডিজিটাল ফরম্যাটে সিনেমা চলে আসায় সদস্য সংখ্যা এখন ৩০ থেকে ৩২ জনে নেমে এসেছে। এখন সক্রিয়ভাবে কাজ করেন ৪-৫ জন।

কাহিনী সংলাপ ও চিত্রনাট্য যারা লিখেন তাদের সংগঠনের নাম চলচ্চিত্র লেখক সমিতি। এক সময় এই সংগঠনে দাপুটে সদস্য থাকলেও সেটা একেবারে কমে এসেছে বলে জানালেন সংঠনের মহাসচিব সানি আলম। মান্না ডিজিটাল কালার ল্যাব নির্মাণের সময় সংগঠনের কার্যালয় ভাঙা পড়ে।

সানি আলম বলেন, “আমাদের কোনো কার্যালয় নেই। আমরা এফডিসির ব্যবস্থাপনা পরিচালকের কাছে আবেদন করেছি। দেখা যাক সেটা হয় কি না।" আজীবন সদস্যসহ সংগঠনের বর্তমান সদস্যসংখ্যা ৩২জন। তরুণ ও নতুন প্রজন্মের সদস্যদের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে বলে জানালেন সানি আলম।

চলচ্চিত্রের নৃত্য শিল্পীদের সংগঠন চলচ্চিত্র নৃত্য পরিচালক সমিতি। এই সংগঠনের কার্যালয় ছিল সাদাকালো ল্যাবের স্থানে। সেটা ভেঙে ফেলায় সংগঠনটি এখন নির্দিষ্ট ঠিকানা নেই।

ঠিকানাহীন সংগঠনগুলোর মধ্যে নিবন্ধিত সংগঠন হলো- সহকারী চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতি।

সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক আবুল বাশার খন্দকার বলেন, “আমরা সক্রিয় একটি সংগঠন। একটি চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য আমাদের প্রচুর পড়াশোনার প্রয়োজন আমাদের একটি লাইব্রেরিও ছিল। কিন্তু ফ্লোর ভেঙে ফেলায় আমরা খুব বিপদে পড়েছি। আমাদের প্রচুর বই, জিনিসপত্র গুলো এফডিসির একটি কক্ষে রেখেছি।"

১৮ সংগঠনগুলোর মধ্য ক’টি সংগঠন সক্রিয়?

এ বিষয়ে সাম্প্রতিক সময়ে চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির নির্বাচনে প্রধান কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করে নিষিদ্ধ হওয়া অভিনয়শিল্পী পীরজাদা হারুন বলেন, “আমাকে নাকি ১৮ সংগঠন নিষিদ্ধ করেছে। কোথায়? আমি শুনেছি এটা, কিন্তু এরমধ্যেই তো আমি তো অরুণা বিশ্বাসের ‘অসম্ভব’ চলচ্চিত্রে অভিনয় করলাম। এতে কী হলো আমার? কদিন পরপর এতো নিষিদ্ধ করলে কার্যকারিতা থাকে কিভাবে?”

১৮ সংগঠনের অন্তর্ভুক্ত অধিকাংশ সংগঠনের কার্যক্রম অনেকটাই নিষ্ক্রিয় বলে জানালেন পরিচালক সমিতির সাধারণ সম্পাদক শাহীন সুমন। আর এই নিষিদ্ধ ও বয়কটের সিদ্ধান্তে তিনি বিরক্ত তিনি। ভয়েস অফ আমেরিকাকে শাহীন শাহীন সুমন বলছেন, “চলচ্চিত্রের এই দুঃসময়ে চলচ্চিত্রের উন্নতির দিকেই মনোযোগ দেওয়া উচিত, এসব বিভাজন ঢাকাই চলচ্চিত্রের জন্য মঙ্গলজনক নয়।"

“প্রেমের তাজমহল” সিনেমা নির্মাণ করে জনপ্রিয় হয়েছিলেন পরিচালক গাজী মাহবুব। তিনি বললেন, “এতো গুলো সংগঠন থাকতে কিভাবে এফডিসির দুটো ঐতিহাসিক স্মারক সম্বলিত ফ্লোর ভেঙে ফেলা হলো?” তিনি মনে করেন চলচ্চিত্রের সুদিন না ফিরলে সংগঠন শুধু নামেই থাকবে। তাই চলচ্চিত্রের উন্নতি কিভাবে ঘটানো যায় সে বিষয়ে চিন্তা করা দরকার।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে আরেকজন চিত্রপরিচালক জানান, চার থেকে পাঁচটি সংগঠন যাদের স্টাডিরুম এফডিসির অভ্যন্তরে রয়েছে তারাই সক্রিয়। মূলত চলচ্চিত্রের সকল ক্ষেত্রে এ সংগঠনগুলোই উদ্যোগ নেয়। এর বাইরে অনেকগুলো সংগঠনই মূলত সহযোগী সংগঠন।

চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্ট অনেকেই মনে করছেন, চলচ্চিত্রের সোনালি দিনগুলোতে নিবন্ধনহীন সংগঠনগুলোর প্রয়োজনীয়তা ছিল। নিবন্ধন না থাকলেও সমষ্টিগত তারা সক্রিয় ছিল। কিন্তু চলচ্চিত্রের মন্দা দিনে এসব সংগঠনের নাম ও কাগজে কলমে কমিটি থাকলেও অনেকটাই নিষ্ক্রিয়। চলচ্চিত্রের সুদিন ফিরলে হয়তো এসব সংগঠন ফের সক্রিয় হয়ে উঠবে।

XS
SM
MD
LG