সেলিনা হোসেনের জন্ম ১৯৪৭ সালে, রাজশাহীতে। বাংলাদেশের একজন খ্যাতনামা কথাসহিত্যিক। তার লেখায় ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের প্রসঙ্গ নতুন মাত্রা যোগ করেছে। লেখালেখির জন্য তিনি পেয়েছেন বাংলাদেশের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পুরস্কার 'স্বাধীনতা পদক', দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পুরস্কার 'একুশে পদক' এবং 'বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার'সহ আরও বেশকিছু পুরস্কার ও সম্মাননা। রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডি. লিট উপাধি পেয়েছেন। তার প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা শতাধিক। ঐতিহাসিক ৭ মার্চ নিয়ে তিনি রচনা করেছেন উপন্যাস “সাতই মার্চের বিকেল”। এ উপন্যাস রচনা এবং প্রাসঙ্গিক বিষয়াবলি নিয়ে তিনি কথা বলেছেন ভয়েস অফ আমেরিকার সঙ্গে। ভয়েস অফ আমেরিকার পক্ষে সাক্ষাতকারটি নিয়েছেন এহসান মাহমুদ।
ভয়েস অফ আমেরিকা: ৭ মার্চ বাংলাদেশের একটি ঐতিহাসিক দিন। “সাতই মার্চের বিকেল” নামে আপনার একটি উপন্যাস রয়েছে। এই উপন্যাস লেখার প্রেক্ষাপট সম্পর্কে বলুন।
সেলিনা হোসেন : ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে উপন্যাসে আমার গল্পটি বলতে চেয়েছি। তাই আমার উপন্যাসের নামের মধ্য দিয়েই ইতিহাসের বিষয়টাকে ধরতে চেয়েছি। ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ঘটনা নিয়ে 'সাতই মার্চের বিকেল'। এই উপন্যাসের নায়ক-নায়িকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। তারা দুজনেই একাত্তরে রমনার রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনেছে। ইতিহাসের সেই অগ্নিঝরা বিকেলে বঙ্গবন্ধুর ভাষণে তারা উদ্বুদ্ধ হয়ে যুদ্ধে যোগ দিয়েছে। আমি উপন্যাসে দেখিয়েছি, নায়ক-নায়িকা যুদ্ধের পরে আবারও রমনার রেসকোর্স ময়দানে চলে আসে। মেয়েটি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল, পাশাপাশি পাকিস্তানি সেনাদের দ্বারা নির্যাতিত হয়ে গর্ভবতী হয়েছে। ছেলেটি মেয়েটিকে দেখে বলল, যুদ্ধের আগে আমাদের প্রেম ছিল। আমিতো তোমাকে এখনো একইভাবে চাই। তখন মেয়েটি বলে, আমার এই অবস্থাতেও তুমি আমাকে গ্রহণ করতে সম্মত আছো? ছেলেটি জানায়, গর্ভের সন্তানের দায়িত্ব নিতেও সে রাজি। গর্ভের সন্তানটি যেহেতু কোনো কিছুর জন্য দায়ী নয়, তাই তাকে গ্রহণ করতে তার আপত্তি নেই। তখন তারা দুজনে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাড়িতে যায়। বঙ্গবন্ধু সে সময় বাড়িতে ছিলেন না। উপন্যাসের নায়ক-নায়িকা তখন বঙ্গমাতাকে জানায়, তারা দুজনে বিয়ে করতে আগ্রহী। যুদ্ধের আগেও তারা ৩২ নম্বরের বাড়িতে যেত, তাই বঙ্গমাতা তাদের সম্পর্কের কথা জানতেন। তিনি এই নতুন পরিবর্তিত অবস্থায় দুজনের বিয়ে করার বিষয়ে সম্মত হওয়ার খবর জেনে কাজী ডেকে বিয়ে দিয়ে দেন। বঙ্গমাতা তার গলার সোনার চেইন খুলে মেয়েটির গলায় পরিয়ে দিয়ে তাদের আশীর্বাদ করেন। উপন্যাসে আমি এটাই দেখাতে চেয়েছি যে, এসবই আমাদের সাতই মার্চের অর্জন।
ভয়েস অফ আমেরিকা: একাত্তরের ৭ মার্চ আপনি রেসকোর্স ময়দানে উপস্থিত ছিলেন। সেই দিনের স্মৃতির কথা জানতে চাই।
সেলিনা হোসেন: ১৯৭১ সালের মার্চ মাস। সাত তারিখ। সেদিন বিকেলে তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে বসে যখন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অসাধারণ ভাষণটি শুনেছিলাম, সে সময় ভাবিনি 'সাতই মার্চের বিকেল' নামে কোনো উপন্যাস আমি লিখতে পারব। আমার সঙ্গে ছিল নমিতা স্যান্যাল, আমাদের বন্ধু। আমাদের সবারই সেদিন মনে হয়েছিল, পিছু হটার দিন আর নেই। ওই ভাষণটি মাথায় নিয়ে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করেছি মাঠে। ভেবেছি ভিড় কমলে বের হব। মেয়েদের জন্য বাঁশ দিয়ে ঘেরাও করা একটি জায়গা ছিল মঞ্চের কাছে। কবি সুফিয়া কামাল ছিলেন সেখানে, আমি ছিলাম তার কাছাকাছি। খালাম্মার সঙ্গে কথা বলে বের হই একটু পরে। সামনে পড়ে একজন বাদাম বিক্রেতা। বলল, “আপা, বাদাম কেনেন”। “ঠিক আছে, দেন” বলে আমি দাঁড়াই লোকটির সামনে। আমার হাতে বাদাম দিয়ে লোকটি বলল, “মুইছা গেছে, মুইছা গেছে পূর্ব পাকিস্তান”। বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে লোকটির দিকে তাকাই আমি! নিজেও তো জানি, বঙ্গবন্ধু তার ভাষণে একবারও পূর্ব পাকিস্তান বলেননি। বাংলা, পূর্ব বাংলা, বাংলাদেশ বলেছেন। তিনি বলেছেন, “আজ বাংলার মানুষ মুক্তি চায়, বাংলার মানুষ বাঁচতে চায়, বাংলার মানুষ তার অধিকার চায়”। বাদাম বিক্রেতার দিকে তাকালে দেখতে পাই তার উজ্জ্বল হাসিমুখ। আমি ও নমিতা দুজনে হেঁটে বাংলা একাডেমির সামনে এলাম। এটি আমার প্রিয় প্রতিষ্ঠান, আমার কর্মক্ষেত্র। ১৯৭০-এর জুলাই মাসে এখানে যোগদান করেছি আমি। ১৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৭১ যেসব বিদেশি বাংলা শিখেছেন, তাদের সনদ দিতে বঙ্গবন্ধু এসেছিলেন বাংলা একাডেমিতে। সেদিনই প্রথম আমি তাকে স্বচক্ষে দেখি। তার ভাষণ শুনি।
ভয়েস অফ আমেরিকা: উপন্যাস লেখার চিন্তাটা প্রথম কীভাবে এলো?
সেলিনা হোসেন: আমি “ললনা” পত্রিকায় 'সংবর্ত' শিরোনামে নিয়মিত কলাম লিখতাম। একাত্তরের ১৯ মার্চ তাতে লিখলাম, “...কেউ তো বোঝেনি শাসিত মানুষের হৃদয়ে এত শপথ প্রদীপ্ত হয়ে আছে। জীবনের সবখানে আজ জিয়নকাঠির ছোঁয়া লেগেছে। ঘুম ভাঙা মানুষের দল পথে-প্রান্তরে, মাঠে-ঘাটে জড়তা বদ্ধতা ছুড়ে ফেলে দিয়ে জাগরণে কণ্ঠ দিয়েছে।...প্রতিটি বাঙালির শপথে দীপ্ত আগুনঝরা হৃদয় আজ একটি হাতিয়ার। বাংলাদেশ সংগ্রামের ভূমি। এ দেশের ইতিহাসের পৃষ্ঠায় আজ আমরা আর একটি নবতর অধ্যায়ের সূচনা করেছি।”
এভাবে স্মৃতির পাতায় আমি গেঁথে রেখেছি সাত মার্চের বিকেলবেলা। কিন্তু উপন্যাসটি লেখার জন্য নিজেকে তৈরি করতে সময় নিয়েছি। কাহিনির গঠন, গল্প তৈরি করা নিয়ে ভেবেছি। এর মধ্যে একটি গবেষণা-প্রবন্ধ হাতে এল, মুক্তিযুদ্ধে নারীদের সরাসরি অংশগ্রহণ বিষয়ে। প্রবন্ধটি পড়ার পর মনে হলো, এই সব বীর নারীকে রমনা রেসকোর্স ময়দান থেকে যুদ্ধক্ষেত্রে আনব। নারী শুধু সম্ভ্রম হারানোর কারণে যুদ্ধের ইতিহাসে চিহ্নিত হবে না। বঙ্গবন্ধু তাদের বীরাঙ্গনা খেতাব দিয়ে বীর নারী হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন। সমাজের অপরিশীলিত চিন্তার কারণে তারা সমাজে প্রকৃত জায়গাটি পাননি।
একসময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার লেখা থেকে জানতে পারি বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা ৭ মার্চের বিকেলে রেসকোর্স ময়দানে যাওয়ার আগে বঙ্গবন্ধুকে বলেছিলেন, "তুমি ১৫ মিনিট শুয়ে থেকে ভেবে নাও তুমি কী বলবে।" এই সব উপাদান হাতে পেয়ে অবশেষে আমি উপন্যাসটি লেখার প্রস্তুতি নিলাম ২০১৫ সালে। যুদ্ধের নানা দিক বর্ণনার জন্য আমার স্বামী আনোয়ারের কাছ থেকে সহযোগিতা নিলাম। আনোয়ার ৯ নম্বর সেক্টরে যুদ্ধ করেছিল।
ভয়েস অফ আমেরিকা: “সাতই মার্চের বিকেল” উপন্যাসে বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী এবং তার ছোট বোনের চরিত্রটি তাদের নিজ নামেই রয়েছে। জীবিত এবং সত্যিকারের চরিত্রদের নিয়ে উপন্যাস লেখার চ্যালেঞ্জ কেমন?
সেলিনা হোসেন : শুরুতেই বলতে চাই, এটি কিন্তু উপন্যাস হিসেবে লিখিত হয়েছে। তাই যাদের নাম বললে, তারাও নিশ্চয় বুঝবেন এটি উপন্যাস, কোনো জীবনীগ্রন্থ নয়। তারাও পড়ার সময়ে উপন্যাস হিসেবে ধরে নিয়ে পড়বেন। তাই আমার কাছে বাড়তি কোনো চাপ মনে হয়নি। চরিত্র এবং আবহ নির্মাণে লেখকের স্বাধীনতা থাকতে হবে। লেখককে এই স্বাধীনতা দিতে হবে। তবে, লেখক এমন বিতর্কিত কিছু করবেন না, যেটি সত্যিকারের চরিত্রকে ভুল বা মিথ্যাভাবে উপস্থাপন করবে। এসবের বাইরে চরিত্র নির্মাণে লেখক সব করতে পারে। ঐতিহাসিক চরিত্র নিয়ে উপন্যাস অবশ্যই লেখা যাবে। তবে তার সঙ্গে প্রয়োজনীয় আনুষঙ্গিক বিষয়গুলো লেখক নিজের মতো নির্মাণ করতে পারবেন। আমি মনে করি, এই করতে পারাটাই সাহিত্য।