অ্যাকসেসিবিলিটি লিংক

বাংলাদেশের ৮ জেলা সামলাচ্ছেন নারী ডিসিরা


বাংলাদেশের একটি ধান ক্ষেতের দৃশ্য। (ছবি: অ্যাডোবি স্টক)
বাংলাদেশের একটি ধান ক্ষেতের দৃশ্য। (ছবি: অ্যাডোবি স্টক)

বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ দুই রাজনৈতিক দল, আওয়ামী লীগ ও বিএনপির প্রধান নারী। এর পাশাপাশি সংসদের স্পিকার ও বিরোধীদলীয় নেতা নারী। রাজনীতির মতোই রাষ্ট্র পরিচালনায়ও নারীদের উপস্থিতি বাড়ছে উল্লেখযোগ্যভাবে। প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীতেও বিভিন্ন পদে নারীর অংশগ্রহণ দিনদিন বাড়ছে।

প্রশাসনের কেন্দ্র, সচিবালয় থেকে শুরু করে মাঠ পর্যায়ের জেলা-উপজেলা পর্যায়ের নির্বাহী পদে বাড়ছে নারীর অংশগ্রহণ। দেশে বর্তমানে জেলা প্রশাসক (ডিসি) পদে ৮ ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) পদে ১৩৮ জন নারী কর্মরত রয়েছেন। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব কে এম আলী আজম ভয়েস অফ আমেরিকাকে (৮ মার্চ ২০২২) এই তথ্য নিশ্চিত করেছেন।

৮ জেলা সামলাচ্ছেন ৮ জন নারী ডিসি

বাংলাদেশে বর্তমানে ৮টি জেলায় জেলা প্রশাসক (ডিসি) হিসেবে কর্মরত আছেন ৮ জন নারী। তারা হলেন- গোপালগঞ্জে শাহিদা সুলতানা, মাদারীপুরে ড. রহিমা খাতুন, মুন্সিগঞ্জে কাজী নাহিদ রসুল, ঝিনাইদহে মনিরা বেগম, চাঁদপুরে অঞ্জনা খান মজলিশ, জামালপুরে মুর্শেদা জামান, হবিগঞ্জে ইশরাত জাহান ও বান্দরবানে ইয়াছমিন পারভীন তিবরীজি।

একজন জেলা প্রশাসকের দায়িত্ব ও সুযোগ সুবিধা

বাংলাদেশে জেলা প্রশাসকগণ ‘ডিসি’ হিসেবেই পরিচিত। একটি জেলার প্রধান নির্বাহী তিনি। জেলার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হিসাবে কেন্দ্রের পক্ষ থেকে তিনি জেলা পর্যায়ের সকল বিভাগের সাথে সমন্বয় করেন। জেলার আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতিসহ সকল উন্নয়ন ও প্রশাসনিক কর্মকান্ডের দেখভালের দায়িত্বও তার উপর বর্তায়।

জেলার প্রধান নির্বাহী ও সমন্বয়ক হিসাবে দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি জেলা পর্যায়ের এই কর্মকর্তা একাধারে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট, জেলা রেভিনিউ কালেক্টর এবং বিভাগীয় কমিশনারের ডেপুটি (ডেপুটি কমিশনার) হিসাবেও কাজ করে থাকেন।

একজন দক্ষ জেলা প্রশাসক একটি জেলার প্রশাসনিক কাজ এবং সরকার ও জনগণের মধ্যে সংযোগ সেতু হিসেবে কাজ করেন। জেলার সমস্ত রাজস্ব, কর, জলকর, ভূমিকর সবই তার তত্ত্বাবধানে আদায় করা হয়ে থাকে। তিনি একজন প্রথম শ্রেণীর বিচারক হিসেবে বিচারকার্য পরিচালনা করেন, জেলার আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার সভাপতিও তিনি। তাকে জেলার পুলিশ সুপার, এডিসিরা সাহায্য করে থাকেন। তিনি জেলার সকল কর্মকর্তার ও দপ্তরগুলোর মধ্যে সমন্বয় রক্ষা করেন; তিনি নির্বাহী প্রকৌশলী, সিভিল সার্জন, কৃষি কর্মকর্তা, পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা, কারা পরিদর্শকের কাজ ও বিভিন্ন সরকারি বেসরকারি স্কুল কলেজের কর্মকান্ড তদারক করেন ও প্রশাসনিক কাজের তত্ত্বাবধান করেন; জেলার সমস্ত রকম প্রয়োজনীয় বিষয়গুলোর উন্নয়নমূলক কার্যাবলী ও পদক্ষেপ তিনি গ্রহণ করেন; তিনি দুর্ভিক্ষ, মহামারী, বন্যাসহ অন্যান্য সকল বিপর্যয়ে সহায়তা প্রদান করেন। তিনি স্হানীয় শাসন ব্যবস্হার কাজ তত্ত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রণ করেন। পদাধিকার বলে জেলা পরিষদেরও সভাপতি। এছাড়া জেলার সংবাদ ও প্রকাশনা নিয়ন্ত্রণ, অস্ত্রের লাইসেন্স প্রদান, মদ, স্পিরিটের লাইসেন্স, তথ্য সংগ্রহ ইত্যাদি তার তত্ত্বাবধানে হয়ে থাকে। অপঘাতে মৃত্যুর পর পোস্ট মর্টেম কেউ না করাতে চাইলে ডিসির অনুমতি নিতে হবে। নিয়ম অনুযায়ী একজন জেলা প্রশাসক জেলার বিভিন্ন দপ্তর সম্পর্কিত ১২০ টি কমিটির সভাপতি।

অষ্টম জাতীয় বেতন কাঠামো অনুযায়ী, বাংলাদেশে সরকারি কর্মচারীদের সর্বোচ্চ মূল বা ‘বেসিক’ বেতন ৭৮ হাজার টাকা এবং সর্বনিম্ন ৮ হাজার ২৫০ টাকা। ২০১৫ সালে এই বেতন কাঠামো অনুমোদন করে বাংলাদেশ সরকার। একজন জেলা প্রশাসকের দায়িত্ব পালনকালে সরকারের বেতন স্কেলের সাধারণত ৫ম গ্রেডে বেতন পেয়ে থাকেন। এই গ্রেডে তিনি ৪৩,০০০ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ৬৯,৮৫০ টাকা পর্যন্ত মূল বেতন পেয়ে থাকেন। এর সাথে বাড়ি ভাড়া, চিকিৎসা ভাতা, ভ্রমণ ভাতা, বিনোদনভাতা, মালি, ধোপা খরচসহ অন্যান্য সুযোগ সুবিধা রয়েছে।

জেলা প্রশাসকরা যা বলছেন

ড. রহিমা খাতুন
ড. রহিমা খাতুন

মাদারীপুর জেলা প্রশাসক ড. রহিমা খাতুন ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন, "পুরুষ আর নারী একে অপরের পরিপূরক। আমরা সমানভাবেই কাজ করছি। বর্তমান সরকার নারীর ক্ষমতায়ন করছে। ডিসিসহ মাঠ পর্যায়ে অনেক নারী কাজ করছেন। আগে এসব পদে নারীরা কম এলেও এখন তাদের অংশগ্রহণ অনেক বেড়েছে।"

চাঁদপুরের জেলা প্রশাসক অঞ্জনা খান মজলিস সম্প্রতি সাহসী ভূমিকার জন্য বেশ আলোচিত হয়েছেন। সরকারি অর্থে জমি ক্রয় করার ক্ষেত্রে তার রিপোর্ট খুবই প্রশংসিত হয়েছে। তিনি বলেন, “নিজেকে নারী হিসেবে চিন্তা করিনি, সবসময় চিন্তা করেছি একজন সরকারি ও প্রশাসনের কর্মকর্তা হিসেবে।” একজন দক্ষ কর্মকর্তাকে কর্মকর্তা হিসেবেই দেখা উচিৎ বলে মনে করে তিনি বলেন, “আমার কাছে মনে হয় একজন অফিসারকে অফিসার হিসেবেই দেখা উচিত। পুরুষ কিংবা নারী, সেটা দেখার বিষয় নয়। তিনি কেমন কাজ করছেন, সেটিই দেখার বিষয়।”

অঞ্জনা খান মজলিস
অঞ্জনা খান মজলিস

একজন নারী জেলা প্রশাসক হিসেবে কর্মক্ষেত্রে কোনো সমস্যা হয়েছে কিনা জানতে চাইলে বান্দরবানের জেলা প্রশাসক ইয়াছমিন পারভীন তিবরীজি বলেন, “প্রধানমন্ত্রী নারীদের ক্ষমতায়নকে অনেক গুরুত্ব দিচ্ছেন। মাঠপর্যায়ের সব নারী সাহস ও দক্ষতার সঙ্গে কাজ করতে পারছে। এক সময় নারী সম্পর্কে মানুষের মনে যে নেতিবাচক ধারণা ছিল, আমার কাছে মনে হয় না এখন সেই ধারণা আছে। তাই কর্মক্ষেত্রে আমার কোনো সমস্যা হয়নি।” বান্দরবানের মতো দুর্গম জেলায় দায়িত্বপালনে কোনো ঝুঁকি ও সমস্যা মনে করেন কিনা, এমন প্রশ্নের জবাবে বান্দরবানের প্রথম নারী জেলা প্রশাসক ইয়াছমিন পারভীন তিবরীজি ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন, “বান্দরবান একজন পুরুষ জেলা প্রশাসকের জন্য যতোখানি চ্যালেঞ্জের, আমিও ততোখানিই মনে করি। নারী হিসেবে বিশেষ কোনো চ্যালেঞ্জ দেখছি না। আর এই দুর্গম এলাকায় চ্যালেঞ্জ নিয়ে কাজ করাটা আমি উপভোগ করছি। এখানে সরকারের নীতি পালন, অর্পিত দায়িত্ব পালন এবং এলাকার জনসাধারনের জীবনমান উন্নয়নে কাজ করছি।”

ইয়াছমিন পারভীন তিবরীজি
ইয়াছমিন পারভীন তিবরীজি

গোপালগঞ্জের জেলা প্রশাসক শাহিদা সুলতানা জাতীয় পর্যায়ে জনপ্রশাসন পদক লাভ করেছেন। জাতীয় পাবলিক সার্ভিস দিবস উদযাপন এবং জনপ্রশাসন পদক ২০২১ অর্জন করেন এই জেলা প্রশাসক। গোপালগঞ্জের জেলা প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে জনসেবা প্রদানে উল্লেখযোগ্য ও প্রশংসনীয় অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ জাতীয় পর্যায়ে ব্যক্তিগত ক্যাটাগরিতে তিনি জনপ্রশাসন পদক ২০২১ এর জন্য চূড়ান্তভাবে মনোনীত হয়েছিলেন।

জেলা প্রশাসক হিসেবে গোপালগঞ্জে যোগদানের পর শাহিদা সুলতানা জেলার উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা রাখেন। মুজিববর্ষ উপলক্ষে গৃহহীনদের ঘর প্রদান কর্মসূচি সফলতার সঙ্গে বাস্তবায়নের পাশাপাশি করোনা মহামারী পরিস্থিতি মোকাবিলা এবং নিম্নআয়ের প্রান্তিক মানুষদের সহযোগিতা প্রদানের মাধ্যমে নিজেকে একজন দক্ষ জেলা প্রশাসক হিসেবে হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হন এবং সুনাম অর্জন করেন।

শাহিদা সুলতানা
শাহিদা সুলতানা

ভয়েস অফ আমেরিকার সঙ্গে আলাপচারিতায় গোপালগঞ্জের জেলা প্রশাসক শাহিদা সুলতানা বলেন, “আমার জন্ম ও বেড়ে ওঠা ঝিনাইদহে। পড়াশোনা করেছি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। এরপরে বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের মধ্য দিয়ে সরকারি চাকরিতে যোগদান করি। চাকরিজীবনে নারী হিসেবে আমাকে খুব বেশি ভোগান্তির মুখে পড়তে হয়নি। আবার নারী হিসেবে কোনো সুবিধাও নিতে চাইনি। একজন প্রশাসনিক লোক হিসেবেই নিজেকে পরিচয় দিতে পছন্দ করি। আমার মনে হয় কাজ করতে চাইলে মানসিকতা যথেষ্ঠ। এজন্য নারী বা পুরুষ- এই বিভেদ রাখা উচিৎ নয়।” আগামীতে কোনো নারী প্রশাসনে আসতে চাইলে তাদের জন্য কোনো পরামর্শ দিতে চান কিনা, এমন প্রশ্নের জবাবে এই নারী জেলা প্রশাসক বলেন, “অবশ্যই, আমার মনে হয় এজন্য নারীদের ইচ্ছা শক্তিটাই আসল। আর নিজেকে দক্ষ হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। দক্ষ হিসেবে গড়ে উঠলে নারী হিসেবে পিছিয়ে রাখা যাবে না।”


জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্তরা যা বলছেন


জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব কে এম আলী আজম ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন, “প্রশাসনে নারীরা খুবই ভালো করছেন। বিশেষকরে, জেলা পর্যায়ে তাদের কাজ প্রশংসনীয়। আমি যখন বিভাগীয় কমিশনার ছিলাম, তখন থেকেই এটা দেখে আসছি। বিভাগীয় কমিশনার হিসেবে কাজ করার সময়ে জেলা প্রশাসকদের সাথে কাজের সুবাদে নিয়মিত যেগাযোগ রাখতে হতো, তখনই দেখেছি তারা দায়িত্বপালনে সক্ষম। কোন কোন ক্ষেত্রে দেখা যায় নারী ডিসিরা দায়িত্বপালনে তুলনামূলকভাবে ভালো করছেন। এখন জনপ্রশাসনে এই পর্যায়ে কাজ করতে এসেও প্রশাসনের বিভিন্ন পর্যায়ের নারী অফিসারদের সাথে কাজ করতে হয়। কখনো মনে হয়নি যে, এই দায়িত্বটি একজন নারীকে না দিয়ে পুরুষকে দিলে ভালো হতো। অর্থাৎ, আমি বলতে চাইছি, নারীরা পুরুষদের পাশে দাঁড়িয়ে একইরকম দায়িত্ব সমান পারদর্শীতার সঙ্গে পালন করতে পারেন”।


বিশেষজ্ঞরা যা বলছেন

সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার। কর্মজীবনে তিনি সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ের সচিবসহ সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেছেন। এই জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞর কাছে জানতে চাওয়া হয়, প্রশাসনে নারী-পুরুষের মধ্যে দায়িত্ব পালনে কারা এগিয়ে। তিনি বলেন, “এই সমাজ সংসার জগৎ নারী-পুরুষ মিলেই চলে। নারী-পুরুষের সমান অংশগ্রহণেই সবকিছু সার্থক ও সুন্দর। সেখানে প্রশাসনে যারা নারী রয়েছেন, তাদের মধ্যে অনেকেই বেশ ভালোভাবে দায়িত্ব পালন করছেন। আবার পুরুষরাও ভালোভাবে কাজ করছেন। আবার অনেক নারী কর্মকর্তাও যেমন অগ্রহণযোগ্য কাজ করেন, তেমনি পুরুষ কর্মকর্তারাও করে থাকেন। দায়িত্বপালনে পুরুষের চেয়ে নারী এগিয়ে কিংবা নারীর চেয়ে পুরুষ এগিয়ে এমন তুলনা করার পক্ষে আমি নই।”

নিজের অভিজ্ঞতার কথা জানিয়ে ভয়েস অফ আমেরিকাকে আলী ইমাম মজুমদার বলেন,

“আমি সরকারি চাকরিতে যোগদান করেছি ১৯৭৭ সালে। সেই সময়ে নারীদের নেওয়ার ব্যপারে আগ্রহী হতে দেখা যায়নি। প্রশাসনে নারীদের নেওয়া শুরু হয় ১৯৮৩ থেকে। এখন নারী এবং পুরুষ সমানতালেই কাজ করছে।”

XS
SM
MD
LG