সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক, ইউটিউবসহ অনলাইন মাধ্যম নিয়ন্ত্রণে খসড়া নীতিমালা তৈরি করেছে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন-বিটিআরসি। ‘দ্য বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন রেগুলেটরি কমিশন রেগুলেশন ফর ডিজিটাল, সোশ্যাল মিডিয়া এবং ওটিটি প্ল্যাটফর্মস’ শীর্ষক এই নীতিমালা চূড়ান্ত করার পথে এগোচ্ছে সংস্থাটি। ইতিমধ্যে অনলাইনের মাধ্যমে নীতিমালার ওপর মতামত নেয়া হয়েছে। দ্বিতীয় দফা সময় বাড়ানোর পর ৫ই মার্চ ছিল মতামত দেয়ার শেষ সময়। মতামত পর্যালোচনা করে নীতিমালাটি চূড়ান্ত করা হবে বলে জানিয়েছেন বিটিআরসি’র কর্মকর্তারা। খসড়া নীতিমালাটি নিয়ে এরইমধ্যে বিতর্ক দেখা দিয়েছে।
প্রস্তাবিত নীতিমালাটি চূড়ান্ত হওয়ার আগে তা প্রত্যাহারের জন্য বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসির প্রতি আহ্বান জানিয়েছে সাংবাদিকদের অধিকার বিষয়ক ৪৩টি মুক্ত সংবাদমাধ্যম, ডিজিটাল অধিকার এবং নাগরিক সমাজের গ্রুপ। কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টস-সিপিজেসহ সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে পাঠানো এক চিঠিতে এই আহ্বান জানানো হয়। চিঠিতে বলা হয়েছে, প্রস্তাবিত প্রবিধানগুলি ডিজিটাল নিরাপত্তা এবং বাকস্বাধীনতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। বিভিন্ন বিষয়বস্তুর উপর নিষেধাজ্ঞা চাপিয়ে মিডিয়ার জন্য যেভাবে বাধ্যতামূলক নিয়ম সেট করার কথা বলা হচ্ছে তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানো হয়েছে চিঠিতে।
কী বলা হয়েছে চিঠিতে
বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের চেয়ারম্যানকে লেখা চিঠিতে জনগণের অধিকার ও স্বাধীনতা রক্ষা করার জন্য এবং বাংলাদেশে একটি উন্মুক্ত, বিনামূল্যে এবং নিরাপদ ইন্টারনেট ব্যবস্থা চালু করার আহ্বান জানানো হয়েছে।
খসড়া প্রবিধানগুলি বিবেচনা করার আগে পর্যাপ্ত বিচার বিভাগীয় তত্ত্বাবধান, স্পষ্টতা এবং মানবাধিকারের ওপর জোর দেয়া হয়েছে ।
সিপিজে’র মতে, খসড়া প্রবিধানগুলি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার কাঠামোর সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ। এই ধরনের খসড়া আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংক্রান্ত ম্যানিলা নীতিমালা এবং বিষয়বস্তু পরিমার্জনে স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতা সংক্রান্ত সান্তা ক্লারা নীতিগুলিকে সমর্থন করে না। শুধু তাই নয় , ‘ওভার-দ্য-টপ’ (ওটিটি) পরিষেবা সংক্রান্ত উদ্বেগগুলির মোকাবিলায় টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রকদের প্রবিধান পরিবর্তন করার প্রচেষ্টা মানবাধিকারের পাশাপাশি নেটওয়ার্ক নিরপেক্ষতার মতো বিস্তৃত নীতিগুলির উপর উল্লেখযোগ্য নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
খসড়া প্রবিধানগুলি ভারতের তথ্য প্রযুক্তি বিধিমালা, ২০২১-এর অনেকগুলি বিধানকে প্রতিফলিত করে বলে মনে করা হচ্ছে। ভারতীয় বিধিগুলি এমন একটি কাঠামোর উদাহরণ যা গণতন্ত্রকে আঘাত করে এবং যাকে অনুকরণ করা উচিত নয়।
সিপিজে’র পক্ষ থেকে জানানো হয়, অনেক মহল থেকে প্রত্যাহারের দাবিসহ মানবাধিকার বিপন্ন করার জন্য ভারতীয় বিধিগুলি সমালোচিত হয়েছে। ভারতীয় বিধিগুলি বর্তমানে একাধিক আইনি চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছে, শুধু তাই নয় বিধিগুলির উল্লেখযোগ্য অংশগুলি কার্যকর না করার জন্য ভারত সরকারের বিরুদ্ধে অন্তর্বর্তী আদেশ জারি করেছে আদালত।
এই পরিস্থিতিতে বিটিআরসিকে খসড়া প্রবিধানগুলি প্রত্যাহার এবং পুনর্বিবেচনার আহ্বান জানানো হয়েছে সাংবাদিকদের সুরক্ষা কমিটিসহ একাধিক মানবাধিকার সংস্থার তরফে।
চিঠিতে স্বাক্ষরকারীদের মধ্যে আছে এশিয়ান ফোরাম ফর হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট ( ফোরাম-এশিয়া), এসোসিয়েশন ফর প্রগ্রেসিভ কমিউনিকেশন্স (এপিসি), আর্টিক্যাল ১৯, বিজনেস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস রিসোর্স সেন্টার, সেন্টার ফর মিডিয়া রিসার্স-নেপাল, কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টস, ডিজিটাল ডেমোক্রেটিক কোলাবোরেশন, ডিজিটাল এমপাওয়ারমেন্ট ফাউন্ডেশন- ইন্ডিয়া, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, ইন্টারন্যাশনাল কাউন্সিল অব ইন্ডিয়ান মুসলিমস, ইন্টারনেট ফ্রিডম ফাউন্ডেশন-ভারত, উইকিমিডিয়া ফাউন্ডেশন।
এর আগে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে সাংবাদিকদের হয়রানি বন্ধ করার জন্য বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষকে তাগিদ দিয়ে এই আইনটিকে বাতিলের দাবি জানায় সিপিজে।
ওদিকে, ২০২১ সালের জুলাই মাসে যুক্তরাষ্ট্র পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র নেড প্রাইস সাংবাদিকদের বলেন, "বাংলাদেশ সরকার আগ্রাসীভাবে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন প্রয়োগ করেছেI সরকারের করোনা মহামারী ব্যবস্থাপনা নিয়ে মন্তব্য করার জন্য কয়েক ডজন লোককে গ্রেফতার করা হয়েছে, যাদের মধ্যে প্রথমবারের মত শিক্ষাবিদরাও রয়েছেন।"
নেড প্রাইস বলেন, "আমরা বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহবান জানাচ্ছি তারা যেন সাংবাদিকসহ সবার মত প্রকাশের স্বাধীনতা রক্ষা করে। যাদেরকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের আওতায় আটক করা হয়েছে, তাদের ন্যায্য বিচার প্রক্রিয়া যেন নিশ্চিত করা হয়।"
নীতিমালায় কী আছে
খসড়া নীতিমালায় নানা ধরনের বিধি-নিষেধের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এর মধ্যে আছে কোনো ধর্মের অনুসারীদের আহত করে বা আঘাত দেয়- এমন কোনো মন্তব্য বা বিষয় প্রচার করা যাবে না। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করে, এমন কিছু করা যাবে না। বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে হেয় করে মন্তব্য বা কটূক্তি করা যাবে না। দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে ফেসবুক এবং ইউটিউবসহ সামাজিক মাধ্যমে কোনো মন্তব্য এবং খবর প্রচার বা পোস্ট করলে তা অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। সামাজিক মাধ্যম ব্যবহারকারী কেউ এসব পোস্ট বা প্রচার করলে তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে।
নীতিমালায় বলা হয়েছে- বাংলাদেশের সঙ্গে বন্ধু দেশগুলোর সম্পর্কের ক্ষতি করতে পারে- এ ধরনের মন্তব্য, খবর বা কনটেন্ট সামাজিক মাধ্যমে বা বিনোদন প্ল্যাটফর্মে প্রচার করা যাবে না। সামাজিক মাধ্যম ব্যবহারকারী কেউ এটি না মানলে তা অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে।
গত ৬ ফেব্রুয়ারি বিটিআরসি তাদের ওয়েবসাইটে ১৬ পৃষ্ঠার খসড়া নীতিমালাটি ইংরেজিতে প্রকাশ করে। প্রথম দফায় ১৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ওই খসড়া নীতিমালার ওপর মতামত চাওয়া হয়। পরে ৫ মার্চ পর্যন্ত ওই সময় বাড়ানো হয়।
বিটিআরসি’র কর্মকর্তারা বলছেন, ফেসবুক ও ইউটিউবসহ সামাজিক মাধ্যম এবং নেটফ্লিক্সের মতো ওভার দ্যা টপ বা ওটিটি প্ল্যাটফর্মের কর্মকাণ্ডে শৃঙ্খলা আনার লক্ষ্যে তারা নীতিমালা প্রণয়নের এই উদ্যোগ নিয়েছেন। এই নীতিমালা তৈরির জন্য হাইকোর্টেরও নির্দেশ রয়েছে।
বিটিআরসি’র ভাইস চেয়ারম্যান সুব্রত রায় মৈত্র সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন, কুমিল্লাসহ বিভিন্ন জায়গায় সহিংসতার ঘটনাগুলোর পর ওটিটি প্ল্যাটফর্ম এবং সামাজিক মাধ্যমে শৃঙ্খলার বিষয়ে একজন আইনজীবী রিট করেছিলেন। সেই রিট মামলার প্রেক্ষাপটে হাইকোর্ট বিটিআরসিকে নীতিমালা তৈরির নির্দেশ দিয়েছিলেন।
সামাজিক মাধ্যমকে ঘিরে সমালোচনা
মাত্র দুই দশক আগেও সোশ্যাল মিডিয়া বা সামাজিক মাধ্যম কথাটির সাথে প্রায় কেউই পরিচিত ছিলেন না বললেই চলে। তারপর থেকে খুবই স্বল্প সময়ে পৃথিবীর প্রায় সকলেই সামাজিক মাধ্যম কথাটির সাথে শুধু পরিচিতই হননি, বরং অনেকেই সেটির নিয়মিত ব্যবহারকারী হয়ে উঠেছেন। বর্তমানে তথ্য ও সংবাদ প্রচারের জন্য চিরাচরিত মাধ্যমগুলোকে ছাপিয়ে, সামাজিক মাধ্যমই সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং মূল চালিকাশক্তিটি হয়ে উঠেছে।
অনেক বিশ্লেষকের মতে, বর্তমানে পৃথিবীর অর্ধেকেরও বেশি মানুষ সামাজিক মাধ্যমের নিয়মিত ব্যবহারকারী। পরিসংখ্যানভিত্তিক ওয়েবসাইট স্ট্যাটিস্টার মতে, ২০২২ এর জানুয়ারিতে পৃথিবীর সবচেয়ে জনপ্রিয় সামাজিক মাধ্যম ফেসবুকের প্রতি মাসে ব্যবহারকারীর সংখ্যা ২৯০ কোটির বেশি। এছাড়া অন্যান্য প্ল্যাটফর্মের মধ্যে ইউটিউব, হোয়াটসঅ্যাপ, ইন্সটাগ্রাম – প্রত্যেকেরই মাসিক ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১০০ কোটিরও বেশি। টুইটার এবং পিন্টারেস্ট এর প্রতি মাসে ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৪০ কোটির বেশি।
প্রথাগত মাধ্যমগুলোর মত সেন্সরশিপ বা অধিক নিয়মনীতি না থাকার কারণে শুরু থেকেই ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেতে থাকে সামাজিক মাধ্যমগুলো। তবে, ক্রমেই সেগুলো এমন নানা কাজে ব্যবহার হতে থাকে যা কিনা অনেকের মতেই সমাজব্যবস্থার জন্য হুমকি হয়ে দাড়িয়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সামাজিক মাধ্যম ব্যবহার করে মাদক সহ নানা অবৈধ ব্যবসা পরিচালনার সংবাদ বেরিয়ে এসেছে। তাছাড়া, সহিংস আন্দোলন আয়োজন থেকে শুরু করে মিথ্যা তথ্য প্রকাশ, এমনকি নির্বাচনকে প্রভাবিত বা সেটির ফলাফলকে নস্যাৎ করার চেষ্টার মত উদ্যোগও সাধিত হয়েছে সামাজিক মাধ্যমের সহায়তাতেই। তবে, বহুলাংশেই প্রচলিত আইন ও নীতি কাঠামোর বাইরে থাকায় সামাজিক মাধ্যম প্রতিষ্ঠানগুলোর বিষয়ে এসবের জন্য কোন পদক্ষেপ নেওয়া অনেক ক্ষেত্রেই সম্ভব হয়নি।
আবার কিছু ক্ষেত্রে অভিযোগ উঠেছে যে, এই প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেরাও সামাজিক ব্যবস্থার সুরক্ষার চেয়ে নিজেদের ব্যবসায়িক মুনাফাকেই বেশি প্রাধান্য দিয়ে থাকে। গত বছর ফেসবুকের ফাঁস হওয়া নথি থেকে দেখা যায় যে, অনেকক্ষেত্রেই প্রতিষ্ঠানটি অধিক লাভের জন্য মিথ্যা, বিদ্বেষমূলক ও উস্কানিমূলক তথ্য প্রচার থামাতে চেষ্টা করে না। এর পরিপ্রেক্ষিতে গত বছর, ইউরোপীয় ইউনিয়নের নির্বাহী ভাইস প্রেসিডেন্ট মার্গরেথ ভেস্টাজের গণমাধ্যমকে বলেন যে, “ফেসবুকের যে ধরণের ক্ষমতা রয়েছে সেটির সাথে অবশ্যই দায়িত্বও জড়িয়ে রয়েছে”। কোম্পানীটি সম্পর্কে আরও “কঠোর” আইনের প্রয়োজনীয়তাটি তুলে ধরে জানিয়ে তিনি বলেন, “আমরা এমন একজনের সাথে মোকাবেলা করছি যিনি মানুষের মানসিক স্বাস্থ্য ছাড়াও কিভাবে আমাদের গণতন্ত্র অগ্রসর হবে – সে বিষয়ের উপরও ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করতে পারে”। তবে শুধু ইউরোপীয় ইউনিয়ন নয়, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশই সামাজিক মাধ্যমগুলোকে আইন ও আরও কঠোর নিয়মনীতির আওতায় আনার বিষয়টি সক্রিয়ভাবে বিবেচনা করছে।
ফেসবুকের সাবেক এক গবেষক, ফ্র্যান্সেস হাউগেন গত অক্টোবরে যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসে এক স্বাক্ষ্য প্রদানের সময়ে ফেসবুকের বিরুদ্ধে এই অভিযোগগুলোর সত্যতা নিশ্চিত করে বলেন, “আমি আজকে এখানে এসেছি কারণ আমি বিশ্বাস করি যে ফেসবুকের পণ্যগুলো শিশুদের ক্ষতি করে, বিভক্তি সৃষ্টিতে ইন্ধন যোগায় এবং আমাদের গণতন্ত্রকে দুর্বল করে”।
অপরদিকে, ইউনাইটেড নেশনস ইনডিপেনডেন্ট ইন্টারন্যাশনাল ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশন অন মিয়ানমার (আইআইএফএফএমএম) এর দাখিল করা ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরের প্রতিবেদনটিতে বলা হয় যে, মিয়ানমারে “বিদ্বেষ ছড়াতে ফেসবুক ব্যবহার করা হয়েছিল”। মিয়ানমারের রোহিঙ্গা গণহত্যা ও অন্যান্য অন্যায়ের অভিযোগের তদন্ত করতে জাতিসংঘের এই মিশনটি গঠন করা হয়েছিল। রোহিঙ্গা বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রসহ একাধিক দেশে করা মামলায় ফেসবুকের বিরুদ্ধে মোট ১৫,০০০ কোটি ডলারেরও বেশি ক্ষতিপূরণের দাবি রয়েছে বলে, দ্য গার্ডিয়ানে গত বছরের ডিসেম্বরে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে জানানো হয়।
(এই প্রতিবেদন তৈরিতে সাহায্য করেছেন আলী নাসিক আইমান।)