ঢাকা-ওয়াশিংটন অষ্টম অংশীদারি সংলাপের একটা বড় অংশ জুড়ে ছিল র্যাবের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি। গেল সপ্তাহে ঢাকায় অনুষ্ঠিত এই সংলাপে বাংলাদেশ কেন র্যাবের প্রয়োজন তা তুলে ধরেছে ১৪ পৃষ্ঠার এক বিশেষ প্রতিবেদনে। এই প্রতিবেদনটি আমাদের হাতে এসেছে। এতে বলা হয়েছে, আইনপ্রয়োগকারী এই সংস্থাটি বাংলাদেশের নিরাপত্তা ও মানবাধিকার রক্ষার্থে নিরলস কাজ করে যাচ্ছে। গত ১০ই ডিসেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি ও পররাষ্ট্র দপ্তরের তরফে র্যাব এবং এর বর্তমান ও সাবেক ৭ কর্মকর্তার ওপর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। এ নিয়ে বাংলাদেশে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া হয়।
কী আছে এই প্রতিবেদনে
নন-পেপার হিসেবে গণ্য এই প্রতিবেদনের শুরুতেই র্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞায় হতাশা প্রকাশ করা হয়। বলা হয়, এই নিষেধাজ্ঞা একতরফা। এতে করে সন্ত্রাসবাদ, সহিংসতা, চরমপন্থা ও মানব পাচারের মতো সংঘটিত অপরাধ মোকাবিলায় একটি উচ্চ পেশাদার আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার দুর্দান্ত কর্মক্ষমতাকে ক্ষুণ্ণ করে বলেই মনে করে সরকার। র্যাব গঠনের পটভূমি ব্যাখ্যা করে প্রতিবেদনে বলা হয়, ৯/১১-এর মর্মান্তিক হামলার পর বিশ্বব্যাপী দেশগুলো সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে একতাবদ্ধ হয়। আর এর নেতৃত্ব দেয় যুক্তরাষ্ট্র। ২০০৪ সনে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের এক প্রতিবেদনেও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী যুদ্ধে বাংলাদেশের সমর্থনের কথা উল্লেখ করা হয়। সেই সাথে বলা হয়, বাংলাদেশের দুর্বল প্রতিষ্ঠান এবং আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার ক্ষমতার সীমাবদ্ধতায় সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলায় সক্ষমতার অভাব রয়েছে। এর পর পরই পুলিশের একটি এলিট ফোর্স হিসেবে ২০০৪ সনের ২৬ মার্চ র্যাব যাত্রা শুরু করে। এতে পুলিশ, সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমানবাহিনী ও বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের চৌকস সদস্যরা অংশ নেন। র্যাবকে একটি ভারসাম্যপূর্ণ বহুমাত্রিক এবং অত্যন্ত পেশাদার বাহিনী হিসেবে গড়ে তোলার জন্য দেশি-বিদেশি প্রশিক্ষকরা প্রশিক্ষণ দেন। এরই ধারাবাহিকতায় যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, কানাডা, সুইজারল্যান্ড ও স্পেনের প্রশিক্ষকরা র্যাবকে আরও আধুনিক করার জন্য প্রশিক্ষণ দেন। ২০১৪ থেকে ২০১৯ সন পর্যন্ত ২৪৬ জন র্যাব সদস্যকে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। শুধু তাই নয়, র্যাব কর্মকর্তারা ইউএস ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল ইনভেস্টিগেশন প্রোগ্রামের অধীনে ২০১১ সন থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে আসছেন।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, র্যাব কঠোরভাবে প্রশিক্ষিত এবং পর্যাপ্তভাবে সজ্জিত একটি বাহিনী। দেশের ভেতরে সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলায় অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছে। ২০১৬ সনে হলি আর্টিজানের ঘটনাটি র্যাব-এর দক্ষ এবং যুগান্তকারী পদক্ষেপের একটি সর্বোত্তম উদাহরণ। যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্ট অনুমোদিত কান্ট্রি রিপোর্টেও তা উল্লেখ করা হয়েছে। এটা সবার জানা, ২০০৫-২০০৮ সন পর্যন্ত বাংলাদেশে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল। যার মধ্যে ছিল সিরিজ বোমা হামলা, আত্মঘাতী হামলা ও বিরোধী রাজনৈতিক নেতাদের হত্যার ঘটনা। জঙ্গিবাদ দমনেও র্যাব অত্যন্ত কার্যকর ভূমিকা পালন করছে। শুধুমাত্র ২০১৯ সনে র্যাব ১৪৪টি জঙ্গিবাদবিরোধী অভিযান পরিচালনা করে। সংস্থাটির কর্মকাণ্ডের বিস্তারিত উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে বসবাসকারী জনগণের জন্য শান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষায় এই বাহিনীর অবদান অনস্বীকার্য। তাই সরকার মনে করে যে, র্যাব এবং এর কিছু বর্তমান ও সাবেক কর্মকর্তাদের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা বিপরীতমুখী প্রভাব ফেলতে পারে। কারণ এ ধরনের পদক্ষেপ সন্ত্রাসবাদ, চরমপন্থা, মানব ও মাদক পাচারের মতো আন্তর্জাতিক অপরাধ, সামাজিক সহিংসতা, নারীদের প্রতি অবমাননা রুখতে বাংলাদেশের প্রচেষ্টাকে দুর্বল করবে। এটি শেষ পর্যন্ত আঞ্চলিক শান্তি, নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতাকে ব্যাহত করতে পারে বলে রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়।
ওদিকে ঢাকা-ওয়াশিংটন অংশীদারি সংলাপ শেষে বাংলাদেশ সফররত যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের রাজনীতি বিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি ভিক্টোরিয়া নুল্যান্ড সাংবাদিকদের বলেন, "র্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি জটিল।" সহসাই এ নিষেধাজ্ঞা উঠছে না বলেও ইঙ্গিত দেন।
র্যাবের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার পর ১০৬ দিনে কোনো ক্রসফায়ারের ঘটনা ঘটেনি।