অ্যাকসেসিবিলিটি লিংক

বাংলাদেশের শোবিজে নারী-পুরুষ অভিনয়শিল্পীদের পারিশ্রমিকের বৈষম্য কতটা?


বাংলাদেশের শোবিজ অঙ্গনের তারকারা।
বাংলাদেশের শোবিজ অঙ্গনের তারকারা।

বাংলাদেশে নাটক ও চলচ্চিত্র নির্মাণ বাড়ছে। আগে চলচ্চিত্র সিনেমা হল কেন্দ্রিক হলেও এখন ওটটি প্ল্যাটফর্মের জন্যও নির্মিত হচ্ছে। অন্যদিকে নাটক একসময় শুধু টেলিভিশনের জন্য নির্মিত হলেও এখন ইউটিউবের জন্যও তৈরি হচ্ছে। এতে যেমন নতুন অভিনয়শিল্পীরা সুযোগ পাচ্ছেন, তেমনই প্রতিষ্ঠিত শিল্পীরাও কাজ করছেন। নারী ও পুরুষ শিল্পীরা সমানতালে কাজ করে যাচ্ছেন মাধ্যমগুলোতে, কিন্তু পারিশ্রমিক কে কেমন পাচ্ছে- নারী-পুরুষ ভেদে কি পারিশ্রমিকের তারতম্য বা বৈষম্য রয়েছে? ভয়েস অফ আমেরিকা এসব বিষয় নিয়েই কথা বলেছেন এ সময়ের কয়েকজন অভিনেত্রী ও নির্মাতার সঙ্গে।

শবনম ফারিয়া

শবনম ফারিয়া টেলিভিশন বিজ্ঞাপনে কাজের মধ্য দিয়ে দেশের শোবিজে পা রাখেন। ২০১৩ সালে তিনি 'অল টাইম দৌড়ের উপর' নাটকে অভিনয়ের মাধ্যমে অভিনয়শিল্পী তকমা নামের সঙ্গে যুক্ত করেন। ২০১৮ সালে 'দেবী' চলচ্চিত্রের মাধ্যমে চলচ্চিত্রে অভিষেক ঘটে শবনম ফারিয়ার। এই চলচ্চিত্রে তিনি শ্রেষ্ঠ পার্শ্ব অভিনেত্রী বিভাগে বাচসাস পুরস্কার এবং শ্রেষ্ঠ নবীন অভিনয়শিল্পী বিভাগে মেরিল-প্রথম আলো পুরস্কার অর্জন করেন। সম্প্রতি ফ্যামিলি ক্রাইসিস নামের একটি ধারাবাহিকে অভিনয়ের জন্য আলোচনায় রয়েছেন।

শবনম ফারিয়া।
শবনম ফারিয়া।

শবনম ফারিয়া মনে করেন না বাংলাদেশের টেলিভিশন নাটক বা চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রিতে লিঙ্গভেদে পারিশ্রমিক নির্ধারণ হয়ে থাকে। তিনি মনে করেন এখানে পারিশ্রমিক অনেকটাই নির্ধারিত হয় শিল্পীর জনপ্রিয়তার নিরিখে। ভয়েস অফ আমেরিকাকে শবনম ফারিয়া বলেন, “আমি মনে করি না বাংলাদেশে যে টেলিভিশন নাটক বা চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রি গড়ে উঠেছে সেখানে জেন্ডার বেইজড পারিশ্রমিক নির্ধারণ হয়। এই সময় নাটকে সবচেয়ে পপুলার কারা? অপুর্ব ভাই, নিশো ভাই, মেহজাবীন আপু। আমি যতদূর জানি তাদের তিনজনের পারিশ্রমিকই একদমই কাছকাছি। বিস্তর পার্থক্য রয়েছে এমন নয়।"

শবনম ফারিয়া বিষয়টিকে আরো পরিস্কার করে বোঝানোর জন্য নিজের পারিশ্রমিকের প্রসঙ্গও টেনে আনেন। বললেন, “আমি যদি আমার কথা বলি, ধরেন আমার বিপরীতে অভিনয় করছেন ইরফান সাজ্জাদ। তার এবং আমার পারিশ্রমিকে কিন্তু প্রায় সমান। এখানে একজন আর্টিস্টের জনপ্রিয়তার বিপরীতে পারিশ্রমিক নির্ধারিত হয়। এমনও হতে পারে... মেহজাবীন আপুকে নেওয়া হয়েছে আর বিপরীতে একজন পুরুষ আর্টিস্টকে নেওয়া হয়েছে যে কিনা তুলনামূলক কম জনপ্রিয়, তাহলে এখানে মেহজাবীন আপুর পারিশ্রমিকটাই বেশি হবে বলে আমি জানি।"

জুনিয়র শিল্পীদের ক্ষেত্রেও কি একই রকম পারিশ্রমিক থাকে। এক্ষেত্রে শবনম ফারিয়ার অবজার্ভেশন বলছে পারিশ্রমিকটা কোনোভাবেই লিঙ্গভেদে হচ্ছে না। তবে লিঙ্গবৈষম্য রয়েছে গল্পে। 'দেবী' চলচ্চিত্রে অভিনয় করে বাচসাস পুরস্কার জেতা অভিনেত্রী বলেন, “আমাদের দেশের নাটকের গল্পে নারী পুরুষের বৈষম্য দেখা যায়। পুরুষপ্রধান গল্পই এখানে প্রচলিত। নারীপ্রধান গল্প হয়তো দর্শক গ্রহণ করবে না। যে কারণে এমনটা হয় না। শুধু আমরা কেন উপমহাদেশজুড়েই এমন অবস্থা। এই বৈষম্য দূর করার উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন।"

আজমেরি হক বাঁধন

এই সময়ে বাংলাদেশে অন্যতম আলোচিত অভিনেত্রী বাঁধন। কান চলচ্চিত্র উৎসবে তার অভিনীত 'রেহানা মরিয়ম নূর' চলচ্চিত্রটি অংশ নেয় এবং অভিনয়শিল্পী হিসেবে তিনি প্রশংসিত হন। বিশ্বের অন্যান্য দেশের গণমাধ্যমেও তার অভিনয়ের প্রশংসা করা হয়। ২০০৬ সালে লাক্স চ্যানেল আই সুপার স্টার প্রতিযোগিতায় দ্বিতীয় রানার আপ হয়ে বাঁধন আলোচনায় আসেন। পেশাগত জীবনে তিনি একজন দন্ত চিকিৎসক।

আজমেরি হক বাঁধন মনে করেন বাংলাদেশের শোবিজে নারী-পুরুষের পারিশ্রমিকের মধ্যে বৈষম্য রয়েছে। তিনি কাজের অভিজ্ঞতা থেকে এমনটাই মনে করেন।

আজমেরি হক বাঁধন।
আজমেরি হক বাঁধন।

আজমেরি হক বাঁধন ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন, "ডেফিনেটলি মেয়ে অভিনয় শিল্পী ও পুরুষ অভিনয়শিল্পীদের কাজের ক্ষেত্রে পারিশ্রমিকের তারতম্য রয়েছে। আমি শুরু থেকে এখন পর্যন্ত যে কাজ করে এসেছি সেখানে দেখেছি, বলতে গেলে আমার ক্ষেত্রে এটা হয়েছে। আমি পারিশ্রমিক কম পেয়েছি, আমার পুরুষ সহকর্মী বেশি পারিশ্রমিক বেশি পেয়েছে। হয়তো অনেকেই সমান পারিশ্রমিক পান সেক্ষেত্রে তাদের গল্পটা আলাদা। আমার মনে হয় অনেকেই এসব বিষয় নিয়ে কথা নিয়ে কথা বলতে চান না এই কারনে যে, তারা হয়তো ভাবেন এসব বিষয় নিয়ে কথা বললেই তাদের নারীবাদী বলা হবে। কিন্তু এটা নারীবাদী ইস্যু নয়, যেটা ফ্যাক্ট সেটা বলতেই হবে।"

জনপ্রিয়তার নিরিখে পারিশ্রমিক নির্ধারণ হয় এটাও বাঁধন মনে করেন। তিনি বলেন, "অবশ্যই জনপ্রিয়তা একটা বিষয়। যারা জনপ্রিয় তারা হয়তো পারিশ্রমিক বেশি পাচ্ছেন। জনপ্রিয় ও অভিজ্ঞরা পারিশ্রমিক বেশি পাবেন এটা যেমন সত্য আমার ক্ষেত্রে সম পর্যায়ের যারা কাজ করেছেন আমি সেসব ক্ষেত্রেও বৈষম্য দেখেছি। আমি অন্যদের কথা বলতে পারবো না, আমার সঙ্গে যা হয়েছে সেটাই আমাকে বলতে হচ্ছে।"

ফারিয়া শাহরিন

এই সময়ের আলোচিত অভিনেত্রী ফারিয়া শাহরিন। তিনি 'ব্যাচেলর পয়েন্ট' নামক একটি ধারবাহিক নাটকে অভিনয় করছেন। এই নাটকে তার চরিত্রের নাম অন্তরা। ইদানীং নাটকের যেসব চরিত্রের কথা মানুষের মুখে মুখে ফেরে তাদের মধ্যে একটি এই “অন্তরা।“

ফারিয়া শাহরিন ২০০৭ সালে ‘লাক্স-চ্যানেল আই সুপারস্টার’ প্রতিযোগিতায় প্রথম রানারআপ হয়েছিলেন। বাংলালিংকের ‘কথা দিলাম’ প্যাকেজের বিজ্ঞাপনচিত্র তার পরিচিতি বাড়িয়ে দেয়। চলচ্চিত্রেও অভিনয় করেছেন।

দেশের টেলিভিশন নাটকে পারিশ্রমিক নিয়ে কোনো বৈষম্য নেই বলে মনের করছেন তিনি।

ফারিয়া শাহরিন।
ফারিয়া শাহরিন।

ভয়েস আমেরিকাকে ফারিয়া বললেন, “আমি মনে করি বাংলাদেশের নাটকে নারী পুরুষ অনুযায়ী পারিশ্রমিক নির্ধারণ হয় না। এখানে যোগ্যতা অনুযায়ী পারিশ্রমিক পায়। আমার সঙ্গে একজন পুরুষ অভিনেতা অভিনয় করছেন তিনি যদি আমার চেয়ে জেষ্ঠ্য ও অভিজ্ঞ হন তাহলে তার পারিশ্রমিক অবশ্যই আমার চেয়ে বেশি হবে। আবার আমার সময়ের বা একই সময়ের অভিনয়শিল্পীদের পারিশ্রমিক আমার সমানই হয়। যেমন ধরেন অভিনেতা মনোজ ও আমি একটি নাটকে যদি অভিনয় করি তাহলে আমরা দুজনই সমান পারিশ্রমিক পাই। আমি মেয়ে বলে কম কিংবা মনোজ পুরুষ বলে বেশি এমন সুযোগ নেই।"

সময়ের আলোচিত নাটক ব্যাচেলর পয়েন্ট এর পারিশ্রমিকের প্রসঙ্গও টেনে আনলেও এই অভিনেত্রী। বললেন, “ ব্যাচেলর পয়েন্টে আমি সিজন থ্রিতে এসেছি। এখানে আমি নতুন। যারা পূর্ব থেকে কাজ করছেন তাদের পারিশ্রমিকটা একটু বেশিই হবে। কিন্তু তারপরেও এখানে সমতা রয়েছে। আমি মেয়ে বলে আমাকে কম পারিশ্রমিক দেওয়া হচ্ছে এমনটা নয়।"

শানারেই দেবী শানু

শানারেই দেবী শানু সুন্দরী প্রতিযোগিতা লাক্স-চ্যানেল আই সুপারস্টারের প্রথম মুকুট বিজয়ী হন। সুন্দরী প্রতিযোগিতা বিজয়ের পর তিনি টেলিভিশন নাটকে অভিনয় শুরু করেন। তার অভিনীত উল্লেখযোগ্য টেলিভিশন নাটকগুলো হলো- বৈরাগী, পলাশ ফুলের গন্ধ, কবি, সাকিন সারিসুরি, আহ ফুটবল বাহ্ ফুটবল, আরমান ভাই বিরাট টেনশনে, চোরকাব্য, আপনঘর, কবিরাজ গোলাপ শাহ ও কর্তাকাহিনী। ২০১৮ সালে 'মিস্টার বাংলাদেশ' চলচ্চিত্রে অভিনয়ের মাধ্যমে তার চলচ্চিত্র শিল্পে অভিষেক ঘটে। শানারেই, মণিপুরী শব্দ- অর্থ গাঁদা ফুল। শৈশবেই মণিপুরী নৃত্যে হাতেখড়ি, মা চন্দ্রা দেবীর হাত ধরে।

শানারেই দেবী শানু।
শানারেই দেবী শানু।

শানুও মনে করেন বাংলাদেশের শোবিজে পারিশ্রমিকের ক্ষেত্রে বৈষম্য রয়েছে। তিনি বলেন, “বিশ্বজুড়েই শোবিজ মিডিয়ায় নারী পুরুষের পারিশ্রমিকের ক্ষেত্রে বৈষম্য রয়েছে। অভিনয়ের ক্ষেত্রে মূখ্য চরিত্রগুলোতে এ বৈষম্য বেশি দেখা যায়। পার্শ্বচরিত্রগুলোতে তেমন একটা বৈষম্য নেই বলে মনে করি। বিশেষ করে যে সকল পুরুষেরা রাতারাতি তারকা বনে যায়, তাদের পারিশ্রমিক তো মুহূর্তেই বেড়ে যায়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে যারা জনপ্রিয় হয়ে উঠছেন, বা যাদের নাটক অথবা সিনেমার ‘ভিউ’ বেশি তাদের কদর বেড়ে যাচ্ছে।"

"আর শ্রেণীকক্ষের যেমন রোল হয় পারফর্ম্যান্স অনুযায়ী তেমনই এখানেও এমনই একটি বিষয় রয়েছে। যারা আগে আসবে তাদের পারিশ্রমিক বেশি, যারা পরে আসবে তাদের কম।"

শানুকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল এসব কি শুধু পুরুষদের ক্ষেত্রেই ঘটছে, যেসকল নারীরা জনপ্রিয় হয়ে যাচ্ছে ‘রাতারাতি তারকা’ বনে যাচ্ছেন তাদের পারিশ্রমিক পুরুষের তুলনায় কি কমই থেকে যাচ্ছে। এ প্রসঙ্গেও শানু মনে করেন নারী হলেও তাদের পারিশ্রমিক তুলনামূলক কম থাকে। তিনি বলেন, “মিডিয়ায় এখনো পুরুষতান্ত্রিক চিন্তা চেতনার ফলাফল রয়েছে। এটা সহসা চলে যাবে না। সম্মিলিতভাবে চেষ্টা করলে হয়তো একটা সমাধান হতে পারে।"

চয়নিকা চৌধুরী

বর্তমান সময়ের একজন আলোচিত নির্মাতা চয়নিকা চৌধুরী। সম্প্রতি তার হাতে বানানো 'বিশ্বসুন্দরী' চলচ্চিত্রটি শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রসহ মোট ৮ টি ক্যাটাগরিতে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার জিতে নিয়েছে।

চয়নিকা চৌধুরী।
চয়নিকা চৌধুরী।

চয়নিকা চৌধুরী মনে করেন বাংলাদেশের নাটক, চলচ্চিত্রে নারী পুরুষ ভিত্তি করে পারিশ্রমিক দেওয়া হয় না। এখানে মেধা ও গ্রহণযোগ্যতাকে ভিত্তি করেই পারিশ্রমিক নির্ধারণ করা হয়। ভয়েস অফ আমেরিকাকে চয়নিকা চৌধুরী বলেন, “আমি কখনো কখনো পারিশ্রমিক অনেক পুরুষ নির্মাতাদের চেয়েও বেশি পাই। এটা আসলে নারী পুরুষের ওপর ভিত্তি করে হয় না। আমার কাজ যদি ভালো হয়, তাহলে আমি ভালো পারিশ্রমিক পাবো। আমার কাজ যদি গ্রহণযোগ্যতা না পায় সে ক্ষেত্রে আমার পারিশ্রমিকও কম হবে। তার মানে এই নয় যে একজন পুরুষ আমার চেয়ে অযোগ্য হয়েও বেশি পেয়ে যাবে।"

চয়নিকা চৌধুরীর নাটক বা চলচ্চিত্রের অভিনয়শিল্পীদের পারিশ্রমিকও ঠিক একইভাবে নির্ধারণ হয় বলে জানালেন। তিনি বললেন, “ আসলে কখনো কখনো এমনও হয় একজন অভিনেত্রীর পারিশ্রমিকের এক তৃতীয়াংশও পান না তার সঙ্গে অভিনয় করা পুরুষ সহশিল্পীটি। পারিশ্রমিক সম্পূর্ণ নির্ভর করে কাজ, মেধা ও দর্শকের গ্রহণযোগ্যতার ওপরে। নারী হয়েছে বলে পারিশ্রমিক কম আবার পুরুষ হয়েছে বলে পারিশ্রমিক বেশি- অন্তত আমার নির্মিত কাজে এমনটা হয় না।"

XS
SM
MD
LG