পরিবেশবাদী সংগঠনগুলোর দাবির প্রেক্ষিতে বাংলাদেশের কক্সবাজার জেলার টেকনাফ উপজেলার সেন্টমার্টিন দ্বীপের পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় ওই দ্বীপ থেকে অতিরিক্ত কুকুর অন্যত্র পুনর্বাসনের উদ্যোগ নিয়েছিল টেকনাফ উপজেলা প্রশাসন। অন্যদিকে এর বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে প্রাণীবান্ধব একটি সংগঠন।
ফলে এই সংগঠনের বাধার মুখে সেন্ট মার্টিন থেকে বেওয়ারিশ কুকুর পুনর্বাসনের উদ্যোগ সোমবার (২৮ মার্চ) বন্ধ করে দিয়েছে উপজেলা প্রশাসন। এর আগে গত রবিবার বিকেল ৪টার দিকে সেন্ট মার্টিন জেটিঘাট এলাকা দিয়ে বেওয়ারিশ কুকুর পুনর্বাসন প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল।
জানা গেছে, পুনর্বাসন কার্যক্রমের প্রথম দিনে ৩৬টি কুকুর পুনর্বাসনের জন্য খাঁচায় রাখা হয়। প্রতিবাদের মুখে এই ৩৬টি কুকুরকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন টেকনাফের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) পারভেজ চৌধুরী।
তিনি জানান, সেন্টমার্টিন দ্বীপের জীববৈচিত্র্য সুরক্ষায় অতিরিক্ত কিছু কুকুর সেন্টমার্টিন থেকে অন্যত্র পুনর্বাসনের দাবি জানান বিভিন্ন পরিবেশবাদী সংগঠন। তা ছাড়া সামনে বর্ষা মৌসুমে সেন্টমার্টিনে কুকুরের জন্য পর্যাপ্ত খাবার থাকবে না। তাই খাদ্য সংকটে পড়ে যেন কোনো কুকুরের মৃত্যু না হয় সেজন্য কিছু কুকুর অন্যত্র পুনর্বাসনের উদ্যোগ নেওয়া হয়।
কক্সবাজার বন ও পরিবেশ সংরক্ষণ পরিষদের সভাপতি দীপক শর্মা দীপু এক বিবৃতিতে জানান, পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় যেকোনো ভূখণ্ডে সকল প্রাণীর অবস্থান প্রয়োজন আছে। আবার কোনো প্রাণীর সংখ্যা অতিরিক্ত হয়ে গেলে, তা পরিবেশের ভারসাম্যের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। ঠিক তেমনি অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে সেন্টমার্টিন দ্বীপে। এই দ্বীপে রয়েছে প্রায় দেড় হাজার পরিবার। আর কুকুর রয়েছে সাড়ে চার হাজারের বেশি। সামুদ্রিক প্রাণীকুলের অভয়াশ্রম সেন্টমার্টিনে প্রয়োজনের অতিরিক্ত কুকুর অবস্থানের কারণে পরিবেশের ভারসাম্যের ওপর মারাত্মক প্রভাব পড়েছে। দ্বীপে খাবার সংকটের কারণে এসব কুকুর খাবারের প্রয়োজনে হিংস্র হয়ে উঠেছে। সৈকতে ডিম ছাড়তে আসা কচ্ছপ মারছে, খাচ্ছে কচ্ছপের ডিম, লাল কাঁকড়াসহ ২৮ প্রজাতির কাঁকড়া খাচ্ছে কুকুরগুলো।
দ্বীপে থাকা নানা জীববৈচিত্র্যর প্রাণীগুলো কুকুরের হানায় হারিয়ে যাচ্ছে। একসঙ্গে ৩০ থেকে ৫০টি কুকুর দলবেঁধে বিচরণ করে। যার কারণে দ্বীপের স্থানীয় শিশু থেকে বৃদ্ধ পর্যন্ত সব মানুষ আতঙ্কে থাকেন। খাবারের প্রয়োজনে এসব কুকুর মানুষকে আক্রমণ করছে। দ্বীপের জীব প্রাণীকুল এবং মানুষের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে খাবার সংকটে পড়া এসব কুকুর।
বিবৃতিতে আরও বলা হয়, খাবারের প্রয়োজনে পর্যটকদের পেছনে পেছনে ঘুরে বেড়ায় এসব কুকুর। তাই সেন্টমার্টিনের পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় এবং কুকুরগুলোকে খাদ্য সংকট থেকে বাঁচাতে বর্তমানে সেন্টমার্টিনে অবস্থান করা অতিরিক্ত কুকুর অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া প্রয়োজন। তবে প্রয়োজনীয় কিছু কুকুর সেন্টমার্টিন রাখতে হবে এ জন্য যে, দ্বীপের পঁচা বাসি খাবার এবং মৃত, পঁচা প্রাণি, পঁচা মাছ, মাছের নাড়িভুঁড়ি খেয়ে দ্বীপের পরিবেশ সংরক্ষণ করতে পারে।
অন্যদিকে পিপল ফর ই পেপার অ্যানিমেল ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান স্থপতি রাকিবুল হক বলেন, “প্রাণীকল্যাণ আইন ২০১৯-এর ৭ নম্বর ধারা অনুযায়ী কোনো মালিকবিহীন প্রাণী হত্যা বা অপসারণ করা আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। সেহেতু রাষ্ট্রের কোনো নাগরিক তো বটেই, সরকারের প্রশাসনও কুকুর নিধন বা অপসারণ করতে পারবে না”
কক্সবাজার পরিবেশ অধিদপ্তরের উপপরিচালক শেখ নাজমুল হুদা জানান, সেন্টমার্টিনে প্রয়োজনের অতিরিক্ত কুকুর বেড়ে গেছে। অতিরিক্ত হওয়ার কারণে এখানকার পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যর ক্ষতি হচ্ছে। তাই অতিরিক্ত কিছু কুকুর অন্যত্র পুনর্বাসন করা হলে সেন্টমার্টিনের পরিবেশের যেমন ভারসাম্য রক্ষা হবে তেমনি কুকুরগুলোও ভালোভাবে বাঁচবে।
ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মুজিবুল হক বলেন, “এই দ্বীপে প্রায় ৫ হাজারের মতো কুকুর রয়েছে। বেওয়ারিশ কুকুরের অবাধ বিচরণের কারণে কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলার সেন্ট মার্টিনে ভ্রমণে আসা পর্যটকেরা প্রায় সময় আতঙ্ক থাকেন। এ ছাড়া সৈকতের বালুচরে ডিম ছাড়তে আসা মা কচ্ছপ কুকুরের আক্রমণের শিকার হয়ে মারা যাচ্ছিল। এ জন্য কুকুর পুনর্বাসনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়”।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মামুনুর রশীদ বলেন, “বেওয়ারিশ কুকুর নিধনের বিষয়ে উচ্চ আদালতে পরিবেশবাদী সংগঠনের করা একটি রিট রয়েছে। এখন কুকুরগুলোকে পুনর্বাসন করার উদ্যোগ নেওয়া হলে নতুন করে পরিবেশবাদীরা বাধা দেন। এ কারণে উদ্যোগটি আপাতত বন্ধ করা হয়েছে”।