অ্যাকসেসিবিলিটি লিংক

বিরোধী দল নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্যের প্রতিক্রিয়া


বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে ‘শক্তিশালী’ বিরোধী দল না থাকায় সম্প্রতি হতাশা ব্যক্ত করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সোমবার (১১ এপ্রিল) নিজ কার্যালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী বলেন, ‘‘শক্তিশালী বিরোধী দল আমরা পাচ্ছি না। অপজিশন বলতে যারা আছে, তার মধ্যে দুটোই মিলিটারি ডিকটেটর। একেবারে সংবিধান লঙ্ঘন করে, আর্মি রুলস ভঙ্গ করে অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করেছিল, তাদের হাতে গড়া।’’

শেখ হাসিনা আরও বলেন, ‘‘কাজেই তাদের ঠিক ওই মাটি ও মানুষের সাথে যে সম্পর্ক, সেই সম্পর্কটা নেই। তাদের কাছে ক্ষমতা ছিল একটা ভোগের জায়গা। সেই ক্ষেত্রে আসলে অপজিশন তাহলে কোথায়? এখানে একটা পলিটিক্যাল সমস্যা কিন্তু আছে।’’

বাংলাদেশে আরেকটি নির্বাচন যখন এগিয়ে আসছে, তখন শেখ হাসিনার এমন পর্যবেক্ষণে দেশটির বিশিষ্টজন থেকে শুরু করে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের প্রতিক্রিয়া জানতে চেয়েছে ভয়েস অফ আমেরিকা।

আকবর আলী খান

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও সাবেক সচিব

আকবর আলী খান।
আকবর আলী খান।

"এই যে দেশে বিরোধী দল নেই, এতে গণতান্ত্রিক কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। এতে আমরা সবাই ক্ষতিগ্রস্ত। এই ব্যর্থতার জন্য আমি, আপনি আমরা সবাই রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সমভাবে দায়ী।"

প্রধানমন্ত্রীর সাহসী বক্তব্যের জন্য আমার অভিনন্দন। তিনি স্বীকার করেছেন নিয়মানুযায়ী সংসদে একটা বিরোধী দল থাকলেও প্রকৃতপক্ষে অকার্যকর। এখন প্রশ্ন হলো বাংলাদেশে কেন বিরোধী দল অনুপস্থিত। যদি সরকারপক্ষকে প্রশ্ন করেন, তাহলে তারা বিরোধী দলকে দোষ দেবে। আর বিরোধী দল দেয় সরকার পক্ষের দোষ। আসলে দোষ সবার। শুধু দলগুলোরই দোষ না। দেশের জনগণেরও দোষ। এই যে দেশে বিরোধী দল নেই, এতে গণতান্ত্রিক কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। এতে আমরা সবাই ক্ষতিগ্রস্ত। এই ব্যর্থতার জন্য আমি, আপনি আমরা সবাই রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সমভাবে দায়ী।

গয়েশ্বর চন্দ্র রায়

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য

গয়েশ্বর চন্দ্র রায়।
গয়েশ্বর চন্দ্র রায়।

"বিরোধী দল আছে কি নেই, তার প্রমাণ যদি করতে হয় তাহলে পদত্যাগ করে একটা সুষ্ঠু নির্বাচন দিন। তখন তিনি বলতে পারবেন, বিরোধী দল আছে কি নেই।"

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী গণতন্ত্রে বিশ্বাস করেন না। জনগণের প্রতিনিধিত্ব করেন না, জনগণের ভোটে নির্বাচিত না। তার আমলে সুষ্ঠু ভোটের মাধ্যমে যদি নির্বাচন হতো, তাহলে বিরোধী দল কাকে বলে বুঝতে পারতেন। তিনি বিরোধী দলের অস্তিত্বে বিশ্বাস করেন না বলেই বিরোধী দলের সংজ্ঞাটা ওনার জানা নেই। তিনি নিজের মাধ্যমে তথাকথিত একটা বিরোধী দল সংসদে রেখেছেন। সেই কারণে তিনি বিরোধী দল দেখতে পাচ্ছেন না। একটাই কারণ, বিরোধী দলের রাজনৈতিক চর্চায় তিনি পদেপদে বাধা দেন। এটা স্বৈরতন্ত্র এবং ফ্যাসিবাদকে হার মানিয়েছে।

বিরোধী দল আছে কি নেই, তার প্রমাণ যদি করতে হয় তাহলে পদত্যাগ করে একটা সুষ্ঠু নির্বাচন দিন। তখন তিনি বলতে পারবেন, বিরোধী দল আছে কি নেই। তিনি যদি বিএনপির কথা বলেন, তাহলে আমি বলব বিএনপি বিরোধী দল না। বিএনপি হল বাংলাদেশের অন্যতম জনপ্রিয় বৃহত্তম রাজনৈতিক দল। সরকার যেহেতু নির্বাচিত না, যেখানে সরকার নেই, সেখানে বিরোধী দল না থাকাই ভালো।

আমরা জানি ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ একটি গণতান্ত্রিক সরকারের হাত থেকে ক্ষমতা ছিনিয়ে নেন। সেটা স্বৈরাচারী সরকার হিসেবে বিবেচিত হয়েছিল। ১৯৯৬ সালে বর্তমান আওয়ামী লীগ শেখ হাসিনার নেতৃত্বে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার মধ্য দিয়ে সেই স্বৈরাচারী শব্দটাকে মুছে ফেলেছে। একটা নির্বাচিত সরকারে রূপান্তরিত করেছে। তার সহযোগী হলেন শেখ হাসিনা। বিএনপি কোনো রাজনৈতিক দল হিসেবে ক্যু করে ক্ষমতায় আসেনি বা কারো ক্ষমতা কেড়েও নেয়নি। বিএনপি একটি সাধারণ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে দল গঠন করেছে। একদলীয় শাসন ব্যবস্থার মধ্যে দিয়ে যখন দল ছিল, সেই মুহূর্তে ১৫ আগস্ট এবং ৭ নভেম্বর ঘটনার পরে জিয়াউর রহমানের যে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসা, তার পরবর্তী পর্যায়ে বহুদলীয় গণতন্ত্রের চর্চা, বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করার মধ্য দিয়ে বিএনপি গড়ে উঠেছে। প্রতিটি নির্বাচনের মধ্য দিয়ে বিএনপি সরকার গঠন করছে। তাই শেখ হাসিনা যে ভাষায় বলতে চান, এটা তার স্ববিরোধী কথা। ওনার মুখে এ ধরনের 'বালখিল্য কথা' শোভা পায় না।

অসীম কুমার উকিল

আওয়ামী লীগের সংস্কৃতিবিষয়ক সম্পাদক ও সাংসদ

অসীম কুমার উকিল।
অসীম কুমার উকিল।

"বিএনপির অভিজ্ঞরা তার (তারেক জিয়া) নেতৃত্ব মানে না। সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগে তারা দলটিকে নিষ্ক্রিয়, অকর্মণ্য করেছে।"

এটা প্রমাণিত সত্য যে রাজনীতির বিরোধী দল বলতে যা বোঝায় বাংলাদেশে তা কোনো অর্থেই নেই। এটা শতভাগ বাস্তব কথা। মামলা, গ্রেপ্তারের দোহাই দিয়ে বিএনপি আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ নিয়ে কথা বলে। এগুলো রাজনৈতিক কোনো অভিযোগ না। রাজনৈতিক কোনো উত্তর খুঁজে পাওয়ার বিষয় না। দমন, নিপীড়ন, অত্যাচারের মধ্য দিয়েই আওয়ামী লীগের জন্ম। পঁচাত্তর পরবর্তী বাংলাদেশে কেন্দ্রীয়, জেলা কিংবা উপজেলায় আওয়ামী লীগের এমন কোনো নেতা ছিলেন না যে কারাবরণ করেননি। সবকিছু মোকাবিলা করেই আমরা আওয়ামী লীগকে দাঁড় করিয়েছি। এভাবেই আমার নেত্রী আওয়ামী লীগের সভানেত্রী হয়েছেন। আবার আমরা এগিয়ে গিয়েছি। আমরা কারফিউ গণতন্ত্রে রাজনীতি করি না। বাংলাদেশে আমরা কারফিউ গণতন্ত্র দেখেছি। আমরা মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তিকে সহায়ক করে অপরাজনীতি করিনি। ইতিহাসের সঠিক ধরায় রাজনীতি করেছি।

জেনারেল জিয়া, জেনারেল এরশাদ, বেগম খালেদা জিয়াদের আশ্রয়পুষ্ট হওয়া ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক জঙ্গিগোষ্ঠী ফ্রিডম পার্টি। এদের যৌথঅপশক্তির বিরুদ্ধে মোকাবিলা করে আমরা রাজনীতি করেছি। তারা এখন রাস্তাঘাট অচল করে দেবে, মন্দিরে হামলা করবে, হুমকি দিয়ে মানুষ মারবে, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা করবে, আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের হত্যা করবে-এমন রাজনীতি আমরা পছন্দ করি না। এগুলো তারা করেছে। একসঙ্গে বাংলাদেশের ৬৪ জেলায় বোমাবাজি করেছে। আমার নেত্রীকে তারা ১৯ বার হত্যার চেষ্টা করেছে। আমরা পিছপা হইনি। সামরিক শাসকের পৃষ্ঠপোষকতায় বেড়ে ওঠা অপরাজনৈতিক দলকে মোকাবিলা করে আমরা রাজনীতি করেছি। এখন বিরোধী দল যাকেই বলা হোক না কেন, তাদের রাজনীতি অন্তঃসারশূন্যে পরিণত হয়েছে। মাঠে নেমে জনগণকে সঙ্গে নিয়ে রাজনীতি করা ভিন্ন জিনিস। একটি রাজনৈতিক দলের প্রধানের ঘাড়ে এতিমদের টাকা আত্মসাতের দায়। তাদের দ্বিতীয় ক্ষমতাধর ব্যক্তি বিদেশে বসে ভার্চুয়াল রাজনীতিতে মত্ত। তার বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ প্রমাণিত সত্য। তার নেতৃত্ব নিয়ে বিএনপির মধ্যে শত বিভক্তি আছে। বিএনপির অভিজ্ঞরা তার নেতৃত্ব মানে না। সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগে তারা দলটিকে নিষ্ক্রিয়, অকর্মণ্য করেছে। ক্ষমতার রাজনীতি থেকে সরে জনগণের রাজনীতিটাই তারা করতে পারছে না। আমার নেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যথার্থই বলেছেন, বাংলাদেশে সত্যিকার অর্থে কোনো রাজনৈতিক বিরোধী দল নেই।

হাসানুল হক ইনু

সভাপতি, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ)

হাসানুল হক ইনু।
হাসানুল হক ইনু।

"আনুষ্ঠানিক বিরোধী দলের সরব উপস্থিতি না থাকলেও শক্তিশালী সরব জনগণ বাংলাদেশে আছে। শক্তিশালী সরব গণমাধ্যম আছে। সুতরাং শক্তিশালী সরব সমালোচনা মোকাবিলা করতে হচ্ছে সরকারকে।"

বিরোধী দলের যতটুকু সোচ্চার স্থিতি দরকার, ততটুকু নেই। এই কথা কিছুটা সঠিকই বলেছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। জনগণের যাপিত জীবনের সমস্যার ব্যাপারে যতটুকু প্রতিধ্বনি দরকার, রাজপথ কিংবা সংসদে, সংসদের বাইরে আমরা সেভাবে দেখছি না। এ জন্য আনুষ্ঠানিক বিরোধী দল, জাতীয় পার্টি বা বিএনপি তারা সরব উপস্থিতি জানান দিতে ব্যর্থ। তারা দলীয় স্বার্থের বাইরে বেশি সোচ্চার না। বিএনপি তাদের নেতানেত্রীদের মামলা, অপরাধের থেকে বাঁচাতে বেশি সক্রিয়। জনসমস্যা নিয়ে খুব একটা সক্রিয় না। এ কারণে রাজপথে এবং জাতীয় সংসদে তাদের সরব উপস্থিতি না দেখতে পেয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এই কথা বলেছেন।

আনুষ্ঠানিক বিরোধী দলের সরব উপস্থিতি না থাকলেও শক্তিশালী সরব জনগণ বাংলাদেশে আছে। শক্তিশালী সরব গণমাধ্যম আছে। সুতরাং শক্তিশালী সরব সমালোচনা মোকাবিলা করতে হচ্ছে সরকারকে। আমরা রাজপথে দেখেছি নিরাপদ সড়ক আন্দোলন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কর আরোপ প্রতিরোধ আন্দোলন, শিক্ষক সমাজের সরব আন্দোলন। গণমাধ্যম তো যাপিত জীবনের সব সমস্যা নিয়ে কথা বলছে। দুর্নীতি, দলবাজির বিরুদ্ধে গণমাধ্যমের সরব উপস্থিতি বিরোধী ভূমিকা পালন করছে। গণমাধ্যমের সরব উপস্থিতির কারণেই সরকার বিভিন্ন প্রশাসনিক পদক্ষেপ নিয়ে সেইসব ক্ষমতা বহির্ভূত কর্মকাণ্ড প্রতিরোধ করছে। আজকে সরকারি অনেক কর্মকর্তা দুদকের বারান্দায়। অথবা কারাগারে আছে।

যে দুটো দলের কথা তিনি বলছেন, তারা সামরিক শাসনের গর্ভজাত দল। আমি তাদেরকে বলি সামরিক শাসনের বর্ধিত সংস্করণ। তারা গণতন্ত্র এবং সংবিধানের সঙ্গে এখনো খাপ খাওয়াতে পারেনি। এ কারণে সংবিধানের মূলনীতিগুলোকে তারা আন্তরিকতার সঙ্গে গ্রহণও করতে পারেনি। তাই সামরিক শাসনের ছাপ এবং সাম্প্রদায়িকতার ছাপ মোছার যে কাজ চলছে তার সঙ্গে দুই দলের কোনো সম্পর্ক নেই।

রাশেদ খান মেনন

ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি এবং সাংসদ

রাশেদ খান মেনন।
রাশেদ খান মেনন।

"বিরোধী দল হিসেবে আমাদের অভিজ্ঞতা খুব সকরুণ। বাংলাদেশে কখনোই বিরোধী দল স্পেস পায়নি।"

আমি এবং আমরা দুদলেই ছিলাম। সাম্প্রতিক সময়ে যেহেতু আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোট করে ২০০৮ সালে নির্বাচন করেছি, এখনো আমরা সেই জোটে আছি। বিরোধী দল হিসেবে আমাদের অভিজ্ঞতা খুব সকরুণ। বাংলাদেশে কখনোই বিরোধী দল স্পেস পায়নি। সেটা বঙ্গবন্ধুর আমলেও না। বঙ্গবন্ধুর আমলে একটা কথা ছিল তিনি সবাইকে তার মনে করতেন। সেখানে শক্তিশালী একটা বিরোধী দল গড়ে উঠবে, সেটা হয়তো তার ধারণার মধ্যে ছিল না। তিনি অবশ্য সারাজীবন বিরোধী দলের রাজনীতি করেই এ জায়গায় এসেছেন। বিরোধী দলে তার রাজনীতির অভিজ্ঞতাগুলো অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে লিখে গেছেন। কিন্তু সেই সময়ে বিরোধী দলকে বেড়ে উঠতে দেয়া হয়নি। পরবর্তীকালে দেড় দশকের যে সামরিক শাসন, সেখানে বিরোধী দল বলে কিছুই তারা রাখতে চাননি। তারা অবৈধ পন্থায় ক্ষমতা দখল করে উঠে দাঁড়িয়েছেন।

শেখ হাসিনা আজকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। তিনিও বিরোধী দল করে আজকে এই জায়গায় এসেছেন। সেটা করতে গিয়ে তাকে বহু বাধাবিপত্তির মুখে পড়তে হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পরে দীর্ঘ সময় তাকে নির্বাসনে থাকতে হয়েছে। দেশে ফিরে তিনি জনগণকে সংগঠিত করেছেন। বহু বাধা মোকাবিলা করতে হয়েছে। তার জীবনে মিথ্যা মামলা, জেল-জুলুম কম আসেনি। তাকে পরিপূর্ণ নিশ্চিহ্ন করার জন্য গ্রেনেড হামলা হয়েছে। আমরা চোখের সামনে এসব দেখেছি।

এখনো বিরোধী দল বিএনপি আছে। কিন্তু তাদের পেছনে যে ছায়া তার নাম হচ্ছে স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াতে ইসলামি। অন্য দিকে বামদলগুলো, আমরা যার সঙ্গে যুক্ত ছিলাম, তারা ক্রমাগত বিভক্ত হয়েছে। ভ্রান্ত রাজনীতি করেছে। আমরাও করেছি। কোনো সন্দেহ নেই। সেই জায়গায় সমাজতন্ত্রের বিপর্যয়ের পরে এখনো ঘুরে দাঁড়ানো সম্ভব হয়নি।

এখন কৃষকেরা সংগঠন করলেও মামলায় ফাঁসানো হয়। নতুন যুক্ত হয়েছে ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট। কখন কার বিরুদ্ধে মামলা হয় ঠিক নেই।

বিরোধী দলের যে স্পেস থাকা প্রয়োজন সেটা নেই। আমাদের এক সময়ে বিরোধী দলে বসতে বলেছেন প্রধানমন্ত্রী। আমরা ছাপোষা বিরোধী দল হতে চাইনি।

আমাদের যে অভিজ্ঞতা, বিরোধী দলে থাকা অবস্থায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর যে অভিজ্ঞতা অতীতে ছিল, আজকে তার সঙ্গে মিলিয়ে দেখলে আমরা বুঝতে পারি বিরোধী দল করা কত কঠিন। যখন রাজনীতি সীমাবদ্ধ হয়ে যায় আমলাগোষ্ঠীর হাতে, তখন এ ধরনের জায়গায় দাঁড়ানো খুব কঠিন কাজ। তারপরও আমরা মনে করি বিরোধী দল আছে, থাকবে।

ড.রেজা কিবরিয়া।
ড.রেজা কিবরিয়া।

ড.রেজা কিবরিয়া

আহ্বায়ক, গণ অধিকার পরিষদ

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ওয়াজেদ যে শক্তির কথা বলছেন, সেটা আর্মি, গুণ্ডাবাহিনী এবং পুলিশের শক্তি। নিশ্চিতভাবে সেটা ওনার আছে। আমাদের নেই। কিন্তু জনগণের সমর্থন আমাদের আছে। সেই দিক হিসাব করলে অনেকগুলো শক্তিশালী বিরোধী দল আছে। তাদের মধ্যে গণঅধিকার পরিষদ অন্যতম। সুতারং উনি যে শক্তির কথা বলছেন, সেগুলো না থাকলেও আমাদের জনগণের ভালোবাসা এবং সমর্থন আছে। দালাল সরকার বাদ দিয়ে যদি সুষ্ঠু নির্বাচন হয়,তাহলে দেখবেন কার শক্তি আছে, কার শক্তি নেই। তখন কে ভোটে জিতবে সেটা বোঝা যাবে।

শেখ হাসিনা সংবিধান লঙ্ঘন করে ক্ষমতায় আছেন। প্রথমে প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন নির্বাচনে যেখানে উনি নিজেকে জয়ী ঘোষণা করেছেন, দ্বিতীয়বার ভোট চোরদের নির্বাচনে উনি নিজেকে প্রধানমন্ত্রী বানিয়েছেন- মিলিটারি ডিকটেটরদের চেয়ে তাকে আমি কোনো মতে কম ধরি না। ওনার দোষটা ইনফ্যাক্ট বেশি ধরব। কারণ তিনি যে দলে আছেন, সেই দলটার বদনাম করিয়েছেন। এই দল এককালে জনগণের স্বার্থের পক্ষে ছিল। জনগণের ভোটের অধিকারের কথা বলত। এখন তারা অনেক দূরে সরে আসছে। আমি বলবো, ওনার দোষ যেকোনো মিলিটারি ডিকটেটরের চেয়ে অনেক বেশি।

জোনায়েদ সাকি।
জোনায়েদ সাকি।

জোনায়েদ সাকি

প্রধান সমন্বয়কারী, গণসংহতি আন্দোলন

বাংলাদেশে দীর্ঘদিন ধরে গণতান্ত্রিক সরকার নেই। যেহেতু বাংলাদেশের পুরো নির্বাচনী ব্যবস্থাটাকে নির্বাসনে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে ফলে এখানে কোনো গণতান্ত্রিক সরকার নেই। এটি একটি ফ্যাসিস্ট সরকার। যারা নানা ধরনের বিদেশি আনুকূল্য নিয়ে এবং রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে সম্পূর্ণ দলীয়করণ করে জবরদস্তির মাধ্যমে ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রেখেছে। জনগণের ওপর স্টিমরোলার চালিয়ে, গুমখুনসহ নানা ধরনের ত্রাস সৃষ্টি করে সব ধরনের প্রতিষ্ঠানের ওপর তাদের নিয়ন্ত্রণ কায়েম করেছে। যখন একটা দেশে কোনো গণতান্ত্রিক সরকার থাকে না, সেখানে বিরোধী দলের জন্য যথাযথ গণতান্ত্রিক ভূমিকায় থাকা কঠিন হয়ে যায়। বাংলাদেশে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো এই কঠিন পরিস্থিতি মোকাবিলা করছে। এটা দুর্ভাগ্যের ব্যাপার যে বাংলাদেশে রাজনৈতিক গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া গড়ে ওঠেনি। আমরা মনে করি এই 'ফ্যাসিবাদ' বাংলাদেশের পরিস্থিতি যেমন খারাপ করেছে, একই সঙ্গে এই 'ফ্যাসিবাদ' বাংলাদেশে নতুন একটা বাস্তবতার জন্ম দিচ্ছে। একে পরাজিত করার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের জনগণ নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতায় পৌছবে। নতুন একটা রাজনৈতিক শক্তিও গড়ে উঠবে। বাংলাদেশের অস্তিত্বের জন্যই গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থা দরকার, যারা এই পুরো জনগোষ্ঠীকে ঐক্যবদ্ধ রাখতে পারবে।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যখন বলেন, তিনি শক্তিশালী বিরোধী দল দেখছেন না, আমরা তখন দেখতে পাচ্ছি দেশে শক্তিশালী কোনো সরকার নেই। এটা বাংলাদেশের জন্য দুর্ভাগ্য।

ড. আসিফ নজরুল।
ড. আসিফ নজরুল।

ড. আসিফ নজরুল

অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

এই বক্তব্য আমার কাছে অদ্ভুত লেগেছে।এই দেশে আদৌ কোনো নির্বাচন হয়েছে কি না, এটা নিয়ে প্রশ্ন আছে। বিরোধী দলকে আদৌ কোনোরকম রাজনীতি করতে দেয়া হয় কি না, সেটা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। আমরা দেখেছি এমনকি এরশাদ আমলেও বিরোধী দল যেপরিমাণ সভা-সমাবেশ করার সুযোগ পেত, যেভাবে বক্তব্য পেশ করার সুযোগ পেত তা কোনোভাবেই দেয়া হচ্ছে না। শক্তিশালী বিরোধী দল দূরের কথা, ছোট-ছোট বামদল সমাবেশ করলে, রাস্তায় নামলে পুলিশ পিটিয়ে ছত্রভঙ্গ করে দেয়। আর আওয়ামী লীগ এবং তাদের সংগঠনগুলো দিনেরাতে রাস্তা দখল করে প্রোগ্রাম করছে। এরকম অবস্থায় উনি এ কথা বলেন কীভাবে।

আপনি বিরোধী দলকে স্পেস দেবেন না, নির্বাচন করতে দেবেন না, আপনি বিরোধী দলকে কোনো কথা বলতে দেবেন না, লাখ-লাখ কর্মীর বিরুদ্ধে মামলা হয়ে থাকবে, শতশত গায়েবি মামলা করবেন-আমি যদি আমার বিরোধী দলকে দমন, নীপিড়ন করে বলি শক্তিশালী বিরোধী দল নেই, তাহলে এটা তো খুব অদ্ভুত একটা কথা হলো। ওনার যদি মনে হয়, সত্যি শক্তিশালী বিরোধী দল প্রয়োজন তাহলে আওয়ামী লীগ যে পরিমাণ সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে, মিটিং-মিছিল করার অন্তত সেটুক দিয়ে দেখতে পারেন বিরোধী দল আছে কি না।

বিরোধী দলের ওপর দিয়ে নির্যাতনের যে রোলার চালানো হয়, সেগুলো বন্ধ করে উনি দেখতে পারেন। যদি তিনি দেখতে চান বাংলাদেশের জনগণ কোন দল সম্পর্কে সত্যিকারে কী মনোভাব পোষণ করে, তাহলে উনি একটি ‘ফ্রি অ্যান্ড ফেয়ার ইলেকশন’ দিয়ে দেখুক। সেটা না দিয়ে যদি এসব বলেন, তাহলে তো কোনো মানে হয় না।

আর মিলিটারি ডিকটেটর (দুটি দলকে) উনি বলতে পারেন; কিন্তু কথা হচ্ছে মিলিটারি ডিকটেটররা জনগণের কাছে জনপ্রিয় হয়েছিল না কি হয়নি। অন্তত একজন মিলিটারি ডিকটেটর আছেন, উনি যদি জিয়ার (জিয়াউর রহমান) কথা বলেন, তিনি মরে যাওয়ার পরেও কতটা পাওয়ারফুল সেটা তো আমরা ১৯৯১ সাল এবং ২০০১ সালে বিএনপির নির্বাচনী সাফল্যের মধ্য দিয়ে দেখেছি। আরেকজন যে মিলিটারি ডিকটেটর আছেন উনি এখনো কত পাওয়ারফুল, উত্তরবঙ্গে এখনো তার জনপ্রিয়তার ওপর ভিত্তি করে জাতীয় পার্টিকে ইলেকশন করতে হবে।তিনিও তো মরে গেছেন। আমি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের কথা বলছি।

আমার কথা হচ্ছে আপনি মিলিটারি শাসক না, তারপরও যদি আপনি আপনার কাজকর্ম দিয়ে মিলিটারি শাসকদের চেয়ে বেশি জনপ্রিয় হতে না পারেন, তাহলে এরচেয়ে বেশি দুর্ভাগ্যজনক আর কিছু নেই।

ড. বদিউল আলম মজুমদার।
ড. বদিউল আলম মজুমদার।

ড. বদিউল আলম মজুমদার

সম্পাদক, সুজন-সুশাসনের জন্য নাগরিক

আমাদের রাজনীতিতে অতীতে একটা ভারসাম্য ছিল। শক্তিশালী সরকারি দল এবং বিরোধী দল ছিল। গত কয়েক যুগে দুটি দল পালাক্রমে ক্ষমতায় গিয়েছে, বিরোধী দলে থেকেছে। ২০১৪ সালের পর ভারসাম্য ভেঙে যায়। এই ভারসাম্য ভেঙে যাওয়ার পেছনে অনেকগুলো কারণ। একটা বড় কারণ হলো নিশ্চিহ্ন করার রাজনীতি। বিএনপি-জামায়াত ক্ষমতায় থাকাকালীন নিশ্চিহ্ন করার রাজনীতির চর্চা করেছে। তারা সফল হয়নি। এরপরে বর্তমান ক্ষমতাসীনরা একই রাজনীতি শুরু করে এবং বহুলাংশে তারা সফল। এর ফলে একটা অকার্যকর বিরোধী দল দেখছি। এখন নামকাওয়াস্তে একটা বিরোধী দল আছে। সংসদে যারা বিরোধী দল, তারা এক সময় সরকারের অংশ হিসেবে নির্বাচন করেছে। মাঠে যারা বিরোধী দল তারা কোমরভাঙা বিরোধী দল। বিভিন্নরকম মামলা-হামলা অর্থাৎ নিশ্চিহ্ন করার রাজনীতির অংশ হিসেবে এটা ঘটেছে। এর পরিণতি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সঠিকভাবে বলেছেন। আমাদের রাজনীতিতে যদি ভারসাম্য না থাকে, সরকারকে যদি দায়বদ্ধ করা না যায় তাহলে সরকার বেসামাল হয়ে যেতে পারে। যেটা আমরা আশপাশের দেশগুলোতে দেখছি। প্রধানমন্ত্রীর এই মন্তব্য যদি কথার কথা না হয়ে সত্যিকারের উপলব্ধি হয় এবং যদি কার্যকর ব্যবস্থা নেন, তাহলে আমরা হয়তো আশাবাদী হতে পারি। আমি মনে করি, প্রথমে আমাদের রাজনৈতিক সমঝোতা প্রয়োজন।

চারদিকের অনিয়মে আমরা দুর্নীতির সাম্রাজ্যে পরিণতি হয়েছি। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো ভেঙে পড়েছে। চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি বেসামাল পর্যায়ে পৌঁছেছে।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান, প্রয়াত বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান বলেছিলেন, "দেশটা বাজিকরদের হাতে।" এখন আমরা সত্যি বাজিকরদের হাতে। এটা অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ সৃষ্টি করছে। এর ভেতর যোগ হয়েছে ইউক্রেন যুদ্ধ। আমরা সামনে চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারি। এই অবস্থায় প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য যদি সত্যিকারের উপলব্ধি হয়, তাহলে আলাপ আলোচনা করে রাজনৈতিক সমঝোতায় পৌঁছানো দরকার। সুদূর প্রসারী এইসব সমস্যার জন্য সবাই মিলে আমাদের ব্যবস্থা নেয়া দরকার।

সুলতানা কামাল।
সুলতানা কামাল।

সুলতানা কামাল

মানবাধিকারকর্মী

বাংলাদেশে এখন শক্তিশালী কোনো রাজনৈতিক বিরোধী দল নেই। এর কারণ হলো আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি যেভাবে এগিয়েছে সেখানে যে দল ক্ষমতায় গেছে তারা সবকিছু এমনভাবে কুক্ষিগত করেছে, যারা ক্ষমতার বাইরে থেকেছে তারা তেমনভাবে রাজনীতির চর্চা করতে পারেনি। তার ফলে আস্তে আস্তে তারা নিষ্ক্রিয় হয়ে গেছে। বাংলাদেশে প্রধানগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল বিএনপি, তারা যখন নির্বাচনে অংশ নিল না তখন থেকেই তারা কোনো কিছু করে না। তারা মনে করে শুধুমাত্র ক্ষমতায় থাকলেই দেশের জন্য কাজ করতে হবে। নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করা বিএনপির একটা ঐতিহাসিক ভুল ছিল। নিজেদের অন্তর্বর্তী কারণে দলটি দুর্বল হওয়াতে বামদল যেগুলো ছিল, মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের শক্তি একসময় রাজনৈতিক কৌশলের কারণে আওয়ামী লীগের সঙ্গে আঁতাত করেই রাজনীতি করেছে। বিরোধী দলের যে চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য থাকে নানা কারণে ওই দলগুলোও তা হারিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে কথা বলেছেন, তিনি আসলে বাস্তব সত্য উচ্চারণ করেছেন।

একটা দেশে বিরোধী দল না থাকলে সংসদীয় গণতন্ত্র বলতে আমরা যেটা বুঝি সেটা কার্যকর থাকে না। জনগণের স্বার্থ সুরক্ষিত থাকে না।

বঙ্গবন্ধু তার অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে বলেছেন, ‘‘যদি একটা শক্তিশালী বিরোধী দল তৈরি করা না যায়’’; তিনি কিন্তু এখানে না থাকার কথা বলেননি। বলেছেন ‘‘যদি তৈরি করা না যায়’’, তাহলে জনগণের রাজনীতি সুচারুভাবে কাজ করতে পারে না। সংসদীয় গণতন্ত্রের জন্য সুষ্ঠুভাবে চলতে হলে একটা শক্তিশালী বিরোধী দল কিংবা শক্তিশালী বিরোধী রাজনৈতিক দল অবশ্যই প্রয়োজন।

XS
SM
MD
LG