বাংলাদেশের অর্থনীতি শ্রীলঙ্কার মত হবে কি হবে না এ নিয়ে চলছে নানামুখী বিশ্লেষণ। সঙ্গে আশঙ্কার কথাও বলা হচ্ছে। কিন্তু সরকার বলছে, বিপদের কোনো আশঙ্কা নেই। বলা হচ্ছে, বাংলাদেশের অর্থনীতি শ্রীলঙ্কার মতো হবে না।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে বলা হয়েছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজে চলমান অর্থনীতির গতি-প্রকৃতি পর্যালোচনা করেছেন। তথ্য-উপাত্ত নিয়ে প্রায় তিন ঘণ্টার পর্যালোচনা করে এটা নিশ্চিত হয়েছেন, বাংলাদেশে শ্রীলঙ্কার পরিস্থিতি হবে না। কারণ বাংলাদেশের যে বৈদেশিক ঋণ রয়েছে তা আগামী এক দশকের মধ্যে পরিশোধযোগ্য। প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব ড. আহমদ কায়কাউস মঙ্গলবার বিকেলে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে চলমান অর্থনৈতিক বিষয়ে সংবাদ সম্মেলনে বলেন- "যারা আজকে শ্রীলঙ্কার সঙ্গে বাংলাদেশের তুলনা করে...এরচেয়ে দুঃখজনক আর কিছু হতে পারে না।"
বুধবার যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ডিসিতে ‘সাউথ এশিয়া ইকোনমিক আপডেট’ প্রকাশ উপলক্ষে এক সংবাদ সম্মেলনে বিশ্ব ব্যাংকের দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের প্রধান অর্থনীতিবিদ হান্স টিমারও প্রায় একই মত দিয়েছেন। বলেছেন- "বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কার মতো অবস্থায় নেই। বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ তুলনামূলকভাবে কম। এখন যে ঋণ রয়েছে তা জিডিপির ১৭ শতাংশের মতো। তাছাড়া এই ঋণের বড় অঙ্ক বিশ্ব ব্যাংকের মতো বহুজাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে সহজ শর্ত ও স্বল্প সুদে নেয়া। শুধু তাই নয়, মোটা অঙ্কের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও রয়েছে। যা দিয়ে ছয় মাসের বেশি আমদানি করা সম্ভব।" তিনি অবশ্য এই অর্থ উন্নয়ন বিনিয়োগের জন্য ব্যবহার করার ক্ষেত্রে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছেন।
শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক সংকট
দক্ষিণ এশিয়ার দ্বীপ রাষ্ট্র শ্রীলঙ্কা অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের মুখে। দেশটি অনেকটা দেউলিয়া হয়ে গেছে। নিজেরাই ঋণ পরিশোধ করা সম্ভব নয় বলে জানিয়ে দিয়েছে। ৭৪ বছরের ইতিহাসে এবারই প্রথম চরম অর্থনৈতিক সংকটে পড়েছে দেশটি। এক সময় দেশটি ছিল দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে উন্নত অর্থনীতির দেশ। তাদের মাথাপিছু আয় ছিল ৪ হাজার মার্কিন ডলারের বেশি। দেশটিতে শিক্ষিতের হার ৯৫ শতাংশ। যা এই অঞ্চলে অন্য কোনো দেশে নেই। কয়েকদিন আগেও এক ডলারের মূল্য ছিল ১৯০ শ্রীলঙ্কান রুপি। এখন ৩শ' রুপি ছাড়িয়ে গেছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভেও বড় ধরনের ঘাটতি। ১ বিলিয়ন থেকে ২ বিলিয়ন ডলারে ওঠানামা করছে। এরমধ্যে আগামী বছরের মধ্যে ৭ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার ঋণ পরিশোধ করতে হবে।
চীনা ঋণের ফাঁদে বিগত দেড় দশকে শ্রীলঙ্কা বেশ কিছু ব্যয়বহুল ও উচ্চাভিলাষী প্রকল্প হাতে নিয়েছে। অর্থনীতিবিদরা বলেছেন, এগুলো অপ্রয়োজনীয়। অর্থনৈতিকভাবে লাভজনকও নয়। একটি বিমানবন্দর নির্মাণ করা হয়েছে যেখানে কোনো বিমান ওঠানামা করে না। হাম্বান টোটায় গভীর সমুদ্র বন্দরের কাছে একটি চীনা শহর নির্মাণের পরিকল্পনা ভুল বলে প্রমাণিত হয়েছে। সমুদ্র বন্দরটি চীনের কাছে ৯৯ বছরের লিজ দিতে বাধ্য হয়েছে শ্রীলঙ্কা।
অর্থনীতিবিদরা কী বলছেন
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, কোনো ক্ষেত্রে শ্রীলঙ্কার সঙ্গে বাংলাদেশের তুলনা চলে না। কারণ শ্রীলঙ্কার বৈদেশিক ঋণ ৩৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। দেশটির জনসংখ্যার মাথাপিছু ১৬৫০ মার্কিন ডলার ঋণ রয়েছে। এই দিক থেকে বাংলাদেশ সম্পূর্ণ আলাদা অবস্থানে। বাংলাদেশের মোট ঋণ রয়েছে ৪৯ দশমিক ৪৫ বিলিয়ন ডলার। জনসংখ্যা ১৬৯ মিলিয়ন। মাথাপিছু ঋণ ২৯২ দশমিক ১১ মার্কিন ডলার। করোনা অতিমারির কারণে শ্রীলঙ্কার অর্থনীতিতে ধ্বস নেমেছে। রেমিট্যান্সেও প্রভাব পড়েছে। তবে বাংলাদেশ কোভিডের ধাক্কা কাটিয়ে উঠলেও ইউক্রেন যুদ্ধ নয়া সংকট তৈরি করেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর আতিউর রহমান শুক্রবার ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন- "শ্রীলঙ্কার অর্থনীতির সঙ্গে বাংলাদেশের অর্থনীতির কোনো মিল বা সম্পর্ক নেই। বাংলাদেশের অর্থনীতির সূচক ভিন্ন এক জায়গায় দাঁড়িয়ে। তার মানে এই নয় যে, শ্রীলঙ্কা থেকে শেখার কিছু নেই।
এক নম্বর শিক্ষা হলো- আমরা যেন সব সময় আয় বুঝে ব্যয় করি।
দুই নম্বর হলো- সক্ষমতা অনুযায়ী বিদেশি ঋণ নিতে হবে। এখনো পর্যন্ত সেই নীতি অনুসরণ করছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের বিদেশি ঋণ জিডিপি’র মাত্র ১২/১৩ শতাংশ। এটা খুবই কম। চিন্তার কোনো কারণ নেই। বাংলাদেশকে এখানে খুবই সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে।
তৃতীয় হলো- বড় বড় প্রকল্প বাস্তবায়নের সময় ঋণ নেয়া হলে সেখানে সুদ হার যেন খুব বেশি না হয়, সেদিকে নজর দিতে হবে। বাংলাদেশের সুদ হার এখনো কমই আছে। এই ধারাটা যেন অব্যাহত থাকে। বাংলাদেশের এই জায়গায় কোনোভাবেই ভুল করা যাবে না। শ্রীলঙ্কা যেটা করেছে সুদ হার অনেক বেশি দিয়ে বিদেশি ঋণ নিয়েছে।"
তিনি বলেন- "বাংলাদেশের রাজস্ব বাড়াতে হবে। যেটা বাংলাদেশ করছে। অন্যদিকে শ্রীলঙ্কার রাজস্ব কমেছে। অনেক খাতে ভ্যাট কমিয়ে দিয়েছে। কৃষি খাত খারাপ করেছে। সেদিক থেকে বাংলাদেশ কৃষিতে ভালো করছে।" সুতরাং শ্রীলঙ্কার মতো "উল্টাপাল্টা সিদ্ধান্ত" নেয়া যাবে না বলে মনে করেন এই অর্থনীতিবিদ।
ওদিকে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন- "মনে রাখতে হবে, পাঁচ-ছয় বছর আগেও শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি অনেক শক্তিশালী ছিল। কিন্তু দুর্বল হতে বেশি সময় লাগেনি। তাই আমাদের শ্রীলঙ্কা থেকে অনেক কিছু শেখার আছে। দেশটি আমাদের সাবধান বাণী শুনিয়ে গেছে।" তিনি বলেন- "আমরা শ্রীলঙ্কা হইনি এটা সত্য, কিন্তু সম্পূর্ণ ঝুঁকিমুক্ত বলাটা অতিরঞ্জন হবে। তাই শ্রীলঙ্কাকে আমাদের মনোযোগে রাখতে হবে।"
"বাংলাদেশের দায়দেনা পরিস্থিতি পর্যালোচনা করলে আমরা ভিন্ন আভাস পাচ্ছি," বলে মত দেন এই অর্থনীতিবিদ।