অ্যাকসেসিবিলিটি লিংক

“যারা বলেছে আমাকে ছুরি মেরে মারতে পারলেই বেহেশতে চলে যাবে এটা নিয়ে একধরনের দুঃখবোধ আছে”


মুহম্মদ জাফর ইকবাল
মুহম্মদ জাফর ইকবাল

সাক্ষাৎকারঃ মুহম্মদ জাফর ইকবাল

মুহম্মদ জাফর ইকবাল বাংলাদেশের একজন খ্যাতিমান শিক্ষক ও সাহিত্যিক। সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এই অধ্যাপক ও জনপ্রিয় বিজ্ঞান কল্পকাহিনী লেখক শিক্ষকতা থেকে অবসরে গেলেও দেশের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে নিজেকে সংযুক্ত রেখেছেন। শিক্ষার্থীদের নানা দাবি ও অধিকার আদায়ে এখনও তিনি সোচ্চার। বাংলাদেশের প্রগতিশীল আন্দোলনে দীর্ঘদিন তিনি সক্রিয় ভূমিকা পালন করে আসছেন। সম্প্রতি বাংলাদেশের মুন্সিগঞ্জে বিজ্ঞান শিক্ষক হৃদয় মণ্ডলকে আটকের পরে ভয়েস অফ আমেরিকাকে দেওয়া তার বক্তব্য দেশব্যাপী সাড়া ফেলে। ২৬ এপ্রিল (মঙ্গলবার) ২০১৮ সালে তাকে হত্যা চেষ্টার মামলার রায় হয়েছে সম্প্রতি। মামলার রায় এবং অন্যান্য সাম্প্রতিক বিষয়ে তিনি কথা বলেছেন ভয়েস অফ অমেরিকার সঙ্গে।

ভয়েস অফ আমেরিকার পক্ষে সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন এহসান মাহমুদ।


ভয়েস অফ আমেরিকা : ২০১৮ সালের ৩ মার্চ বিকেলে শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্তমঞ্চে একটি অনুষ্ঠান চলাকালে আপনার ওপর ছুরি দিয়ে হামলা চালানো হয়েছিল। ওই সময় মাথা ও ঘাড়ে আঘাত পেয়েছিলেন। সিলেটে এবং ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে হয়েছিল আপনাকে। ওই হামলার ঘটনায় শিক্ষার্থী ও পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে ফয়জুল নামে একজনকে আটক করেছিল। পরে ফয়জুলের বিরুদ্ধে হত্যাচেষ্টার মামলা হয়েছে। আজকে (২৬ এপ্রিল) সেই মামলার রায় হয়েছে। তাতে প্রধান আসামীর (ফয়জুল) যাবজ্জীবন সাজা ঘোষণা হয়েছে। এই রায়ে আপনি সন্তুষ্ট কিনা?

মুহম্মদ জাফর ইকবাল : রায়ে আমি সন্তুষ্ট কিনা- এই প্রশ্নের জবাবে বলতে গেলে আমি বলবো, আমার কাছে ওই ছেলেটার জন্য খারাপ লাগছে। ওর জন্য করুণা হচ্ছে। ওকে জীবনের বাকিটা সময় কারাগারেই থাকতে হবে। এর বাইরে রায় নিয়ে আলাদা কোনো ফিলিংস নেই। আমাকে যখন আঘাত করা হয়েছিল, তারপরে চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হওয়ার পর আমি তার খোঁজখবর নিয়েছিলাম। ও তখনই ধরা পড়েছিল। আমার শিক্ষার্থীরা ওকে সেখানেই ধরে ফেলেছিল। আমি তখন বলেছিলাম, ওই ছেলেটার সাথে আমার কোনো ব্যক্তিগত শত্রুতা তো নেই। ওকে যারা ব্রেনওয়াশ করেছে, যারা বলেছে আমাকে ছুরি মেরে মারতে পারলেই বেহেশতে চলে যাবে এটা নিয়ে আমার একধরনের দুঃখবোধ আছে। এই যে পৃথিবী কতো সুন্দর, সেখানে না তাকিয়ে যারা মানুষকে হত্যার জন্য অন্য মানুষকে পরামর্শ দেয় তাদের জন্য, এই পরিস্থিতির জন্য একটা খারাপ লাগা কাজ করে। এখন যারা ফয়জুলের মতো ছেলেদের বুদ্ধি দিয়ে পরামর্শ দিয়ে এমন বিপদের দিকে ফেলে দিচ্ছে তাদের তো খুঁজে বের করা যাচ্ছে না। তাই আমি রায়ে সন্তুষ্ট কিনা, এই বিষয়টাকে আসলে এইভাবে দেখতে চাই না।

ভয়েস অফ আমেরিকা : তাহলে আপনি কীভাবে পুরো বিষয়টিকে মূল্যায়ন করবেন?

মুহম্মদ জাফর ইকবাল : আমি সহজভাবে বলতে চাই- এরকম ঘটনার পেছনে যারা রয়েছেন তাদের খুঁজে বের না করাটা আমাকে একধরনের কষ্টই দেবে। একটা ক্ষোভ তৈরি হয়েছে বলতে পারেন। এইরকম ঘটনা তো আরও ঘটেছে। এখন অন্যসব ঘটনার বিচার দ্রুত হোক, সেটাও চাই। পাশাপাশি এইধরনের ঘটনা যারা ঘটান তাদের বলতে চাই, এইভাবে তো হয় না। কাউকে কুপিয়ে বা মেরে নিজেদের বিশ্বাস প্রতিষ্ঠা করা যায় না। ভালোবাসা প্রতিষ্ঠা করা যায় না।

ভয়েস অফ আমেরিকা : কিছুদিন আগে লেখক হুমায়ুন আজাদ হত্যা মামলার রায় হয়েছে। আপনি নিশ্চয়ই তা অবগত আছেন ....

মুহম্মদ জাফর ইকবাল : জি। এখানে এইদেশে এমন ঘটনা আরও আছে। দেশের প্রচলিত বিচারের প্রতি আমাদের সকলেরই শ্রদ্ধাশীল থাকা উচিৎ বলে ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি। সেই মামলার রায় হয়েছে। আবার এখন সিলেটের মামলার রায় হল। বিচার ব্যবস্থা নিয়ে আমার কোনো প্রশ্ন নেই। আমার কষ্ট বলুন বা আমার দুঃখ বলুন- এই ধরনের মানুষদের জন্য আছে।

ভয়েস অফ আমেরিকা : এইবার আমরা ভিন্ন একটি প্রসঙ্গে কথা বলতে চাই। রাজধানী ঢাকার কলাবাগানে তেঁতুলতলা মাঠে একটি থানা নির্মাণ করার কথা শোনা যাচ্ছে। এলাকাবাসী তাদের এই একমাত্র মাঠটি রক্ষা করতে চায়। এই মাঠরক্ষার আন্দোলনে গিয়ে এক মা তার আঠারো বছরের কম বয়সী সন্তানসহ হাজতবাস করলেন। এই বিষয়টিকে আপনি কীভাবে দেখছেন?

মুহম্মদ জাফর ইকবাল : প্রথমেই আমি বলতে চাই, এই ধরনের ঘটনা যখন ঘটে তখন দেশের পুলিশবাহিনী কি বুঝতে পারেন না এতে তাদের ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়! সম্প্রতি আমরা পুলিশের এমন আরও একটি ঘটনা কিন্তু দেখেছি। মুন্সিগঞ্জের শিক্ষক হৃদয় মণ্ডলকে আটক করা হয়েছিল। সেখানেও কোনো দোষ না করেও শিক্ষক হৃদয় মণ্ডলকে আটক করা হয়েছিল। তাকে জেলে যেতে হয়েছিল। এখন আমি বলবো, এখানে কলাবাগানে থানা হওয়ার কোন দরকার নেই। এই জায়গায় যেহেতু এলাকাবাসী মাঠটি ছাড়তে চাইছেন না, সেহেতু এখানে থানার জন্য একটা বিল্ডিং তৈরি করার তো দরকার নাই। এর জন্য অন্য জায়গা নিতে পারে। থানা-পুলিশ কেন দরকার হয়? এলাকাবাসীর নিরাপত্তা বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষার জন্যই তো। তাহলে সেই এলাকাবাসী যদি মনে করেন এখানে থানার চেয়ে একটি খোলা মাঠ বেশি দরকার তাহলে সেই সিদ্ধান্ত মেনে নিতে আপত্তি কোথায়? ঢাকা শহরে এমনিতেই শ্বাস নেওয়া জায়গা কমে আসছে। তাই এখানে একটু খোলা জায়গা আছে, সেটা খোলা রাখার পক্ষে আমি। আর এই ঘটনায় একটি আঠোরো বছরের বাচ্চাকে যেভাবে ধরে নিয়ে থানার হাজতে রাখা হল, তা আমাকে কষ্ট দিয়েছে। আমাদের পুলিশকে আরও বিবেচক হতে হবে। নইলে তা বাহিনীর ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত করবে।

XS
SM
MD
LG