অ্যাকসেসিবিলিটি লিংক

ছোটবেলার ঈদগুলো ছিল অন্যরকম—নিগার সুলতানা


নিগার সুলতানা।

দুই বছর ধরে করোনার প্রকোপে বিপর্যস্ত সময়টা বোধহয় পেরিয়ে এসেছে গোটা বিশ্ব। এর মধ্যেই খুশির বার্তা নিয়ে হাজির ঈদ–উল–ফিতর। গত দুই বছরের ঘরবন্দী অবস্থায় ঈদ কাটানো মানুষের জন্য এ যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচা। দৈনন্দিন জীবনের শত ব্যস্ততা পেরিয়ে ঈদের উৎসবে ব্যস্ত সবাই। প্রিয়জেনর সান্নিধ্য পাওয়াতে বাধা নেই। দলবেঁধে ঘুরতে যাওয়াতেও নেই মানা।

বাংলাদেশ নারী ক্রিকেট দলের অধিনায়ক নিগার সুলতানা জ্যোতির কাছেও এবারের ঈদটা তেমনই।নিউজিল্যান্ডে নারীদের ওয়ানডে বিশ্বকাপে বাংলাদেশ ভালো করার পর এটিই তার প্রথম ঈদ। শেরপুরে নিজ পিতৃভূমে তিনি ব্যস্ত সময়টা পুরোপুরি উপভোগের। এর মধ্যেই ভয়েস অফ আমেরিকার সঙ্গে কথা বলেছেন নিজের ঈদ উদ্‌যাপন ও ক্রিকেট নিয়ে।

ভয়েস অফ আমেরিকা: দুই বছর পর আবার আগের মতো ঈদ। নিশ্চয়ই এবার প্রাণভরে উপভোগ করছেন?

নিগার সুলতানা: অবশ্যই! ২০২০ সালে তো লকডাউনের কারণে ঢাকায় ঘরে বসে ছিলাম। গত বছরও করোনার নানা বিধিনিষেধ ছিল। এবার আল্লাহর রহমতে সময়টা ভালো। করোনার প্রকোপও কমে গেছে। আমি আমার বাবার বাড়ি শেরপুরে এসেছি ঈদ করতে। পরিকল্পনা তো অনেকই আছে। আসল ব্যাপার হচ্ছে, এবার বাবা–মাসহ পরিবারের সবার সঙ্গে ঈদ করতে পারছি।

ভয়েস অফ আমেরিকা: বিশ্বকাপে ভালো পারফরম্যান্স কী এবারের ঈদকে আরও একটু ভিন্নমাত্রা দিচ্ছে?

নিগার সুলতানা: ভালো তো লাগছেই। ওয়ানডে বিশ্বকাপে প্রথমবারের মতো খেলেছি। পাকিস্তানকে হারিয়েছি। আরও দুটি ম্যাচে আমরা জিততে পারতাম। অন্য ম্যাচগুলোতেও আমাদের পারফরম্যান্স একেবারে খারাপ ছিল না। সব মিলিয়ে একটা তৃপ্তি তো আছেই। আমাদের খেলা সবাই দেখেছেন, সবাই খুশি হয়েছেন। এর মধ্যে ঈদে বাড়ি এসেছি। সবাই বিশ্বকাপ নিয়ে জানতে চাচ্ছেন। তবে বিশ্বকাপেই পড়ে থাকতে চাই না আমরা। আরও এগোতে চাই।

ভয়েস অফ আমেরিকা: ঈদ নিয়েই প্রশ্ন করি। কোনো স্পেশাল কিছু রান্না করার পরিকল্পনা কী করেছেন?

নিগার সুলতানা: ঈদে আমাদের বাসায় চটপটি করা হয়। সেটি আমার সবচেয়ে প্রিয়। ঈদের রান্নায় মাকে সাহায্য করি। আমার ভালো লাগে ঘর গোছাতে। ঈদে নিজের বাড়িকে সাজিয়ে তোলার মধ্যে অন্যরকম আনন্দ আছে। রান্না তো করবই। পোলাও, মাংস, সেমাই, জর্দা, চটপটি সবকিছুতেই আমার অবদান থাকবে। দুই–একটা ডিশ হয়তো নিজেই রেঁধে ফেলব।

ভয়েস অফ আমেরিকা: একটা অন্যরকম প্রশ্ন করি, ঈদে কেবল মেয়েরাই রান্না করে, ঘর গোছায়—এমন একটা সংস্কৃতি আছে আমাদের দেশে। এটাকে কীভাবে দেখেন?

নিগার সুলতানা: দেখুন এটা অতীত থেকে চলে আসছে। তবে পুরো বিষয়টি বদলে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। আমি তো এখন দেখি ছেলেরাও বাড়ির মেয়েদের অনেক বিষয়ে সাহায্য করে। তারাও রান্নাবান্না করে। ঘর গোছায়। জানালার পর্দা বদলে দেয়। আমার বাসায় অবশ্য আমি এসব কাজ আনন্দ নিয়েই করি। তবে সবাই মিলে বাড়ির কাজগুলো করলে আনন্দের মাত্রা আরও বেড়ে যায়, এটা বলতে পারি।

ভয়েস অফ আমেরিকা: ঈদে সবারই ছোটবেলার স্মৃতি মনে পড়ে। আপনার নিশ্চয়ই অনেক মধুর স্মৃতি আছে?

নিগার সুলতানা: আসলে ছোটবেলার ঈদগুলোই মজার ছিল। তখন সেলামি পেতাম, সেলামি নিয়ে আমাদের মধ্যে কী যে প্রতিযোগিতা হতো। বাবারা ঈদের নামাজ পড়ে কখন আসবেন, সেটার জন্য বসে থাকতাম। ভাইদের আগে যেন সেলামি আদায় করতে পারি, সেটিই লক্ষ্য থাকত। আমাদের বাড়ি থেকে ঈদগাহ দেখা যায়। বাবা–ভাইদের নামাজ শেষ করে আসতে দেখলেই আমরা সবাই প্রস্তুত হয়ে যেতাম। কী আনন্দটাই না হতো। এখন ভাবলে খুব অবাক লাগে। কত অল্পতেই উল্লসিত হতাম আমরা। ঈদের আগের দিন, যেটিকে চাঁদরাত বলে, সেটার মজা ছিল অন্যরকম। মাগরিবের সময় ঈদের চাঁদ দেখার জন্য মাঠে জড়ো হওয়া। এখন তো চাঁদ না দেখেই ঈদ করি। ছোটবেলার সেই দিনগুলো কোথায় যেন হারিয়ে গেছে।

ভয়েস অফ আমেরিকা: ঈদ আপনার কাছে কী? এটা কী কেবলই একটা উৎসব, নাকি বাড়তি কিছু খুঁজে পান এর মধ্যে?

নিগার সুলতানা: আসলে আমার কাছে সবচেয়ে বেশি ভালো লাগে সবার আনন্দটা। এটাই ঈদ। এই যে সবাই হুড়োহুড়ি করে কেনাকাটা করছে, নানা ধরনের ব্যস্ততা, সবাই কিন্তু প্রিয়জনদের জন্যই। তবে ঈদের আনন্দটা যেন সবাই উপভোগ করতে পারে, সেটিই মাথায় রাখা দরকার। যাদের সামর্থ্য আছে, তাদের দায়িত্ব, যাদের সামর্থ্য নেই, তাদের আনন্দের ব্যবস্থা করা। আমরা যান্ত্রিক জীবনযাপন করি। কাজ, কাজ আর কাজ। সেটি যে পেশাই হোক। খালি ছুটছি। ঈদ একটু বিশ্রামের সুযোগ করে দেয়। তবে ঈদ সব সময়ই ছোটদের। ওই যে সেলামি আদায় করা! নতুন জামা পরে ঘুরে বেড়ানো—এর চেয়ে আনন্দের আর কী থাকতে পারে।

নিগার সুলতানা।
নিগার সুলতানা।

ভয়েস অফ আমেরিকা: এবার তো অনেককেই আপনার সেলামি দিতে হবে?

নিগার সুলতানা: সবাই মুখিয়ে আছে (হাসি)। বেশ বিপদেই আছি। জুনিয়র টিমমেটরা ইতোমধ্যেই ফোন দিয়ে বিকাশ নম্বর দিয়ে রেখেছে। বাড়ির ছোটরা আছে। প্রতিবেশিদের ছেলেমেয়েরাও অপেক্ষা করে আছে। তবে আমারও সেলামি আদায় করতে হবে বড়দের কাছ থেকে, নয়তো ছোটদের দেব কীভাবে!

ভয়েস অফ আমেরিকা: ঈদে সবচেয়ে বেশি মিস করেন কাকে?

নিগার সুলতানা: আমার বড় খালাকে। উনি ২০১২ সালে আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। আমি ওনার সঙ্গে লেগে থাকতাম। উনিও প্রচণ্ড আদর করতেন আমাকে। আমার খুব আক্ষেপ হয়, এই যে আমি জাতীয় নারী ক্রিকেট দলের অধিনায়ক হয়েছি, বিশ্বকাপে দেশকে নেতৃত্ব দিয়েছি, এসবের কিছুই উনি দেখে যেতে পারলেন না। উনি থাকলে খুব ভালো হতো। তিনি আমাকে জীবনবোধ শিখিয়েছেন। অনেক প্রাপ্তিতেও যে মাথা নিচু করে থাকতে হয়, সেটি তার কাছ থেকেই শেখা। ওনার যখন মৃত্যু হয়, তথন আমি শেরপুরের হয়ে একটা ম্যাচ খেলতে খুলনায় যাচ্ছিলাম। আগে থেকেই অসুস্থ ছিলেন। কিন্তু ঠিক ওই সময়ই তিনি মারা যান। বাড়ি ছাড়ার আগেও আমি তার সঙ্গে কথা বলেছি, চুল আঁচড়ে দিয়েছি, গায়ে লোশন–টোশন মাখিয়ে দিয়েছিলাম।
খুলনায় গিয়ে কেন যেন মনটা খুব খারাপ লাগছিল। বাড়িতে ফোন দিলাম। কিন্তু মা আমাদের তার মৃত্যুর খবর দিতে চাননি, আমার খেলা ছিল বলেই হয়তো। বড় খালার মৃত্যুটা আমার জীবনের সবচেয়ে কষ্টের অধ্যায়। ঈদে ওনার স্মৃতি খুব মনে পড়ে।

ভয়েস অফ আমেরিকা: বিদেশের মাটিতে নিশ্চয়ই বেশ কয়েকটি ঈদ কাটিয়েছেন?

নিগার সুলতানা: ২০১৫ সালে প্রথম বিদেশের মাটিতে ঈদ করি। খুব মন খারাপ হচ্ছিল। আমার সতীর্থরা আমার মন ভালো করে দিয়েছিল। সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি, তারা সেমাই রান্না করেছেন, নুডলস রান্না করেছেন। বিদেশের মাটিতে তো আর বাড়তি কিছু করার থাকে না, একটু নিজেরা আনন্দ করা, রান্নাবান্না করা বা বাইরে একটু ঘুরতে যাওয়া। তবে বিদেশের মাটিতে ঈদ করলে পরিবারের সবার কথা, বন্ধু–বান্ধবদের কথা খুব মনে পড়ে। সেই অনুভূতিটা বাজে।

ভয়েস অফ আমেরিকা: এবার একটু ক্রিকেটে ফিরি, বিশ্বকাপে পাকিস্তানকে হারিয়েছেন। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে জিততে জিততে দুর্ভাগ্যক্রমে হেরেছেন। দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে জিততে পারতেন। অস্ট্রেলিয়া, ভারত, ইংল্যান্ড, নিউজিল্যান্ডের মতো দলগুলোর সঙ্গে অভিজ্ঞতা কেমন ছিল?

নিগার সুলতানা।
নিগার সুলতানা।

নিগার সুলতানা: সত্যি অসাধারণ অভিজ্ঞতা। পাকিস্তানকে হারানোর অনুভূতি অন্যরকম। খারাপ লাগে ওয়েস্ট ইন্ডিজের মতো দলকে নাগালের মধ্যে পেয়েও হারাতে পারিনি। সেদিন আমাদের ড্রেসিং রুমে আমরা অনেকেই কেঁদেছি। নিতে পারছিলাম এত কাছে গিয়েও মাত্র ৪ রানে হেরে যাওয়ার দুঃখটা। বিশ্বকাপের মতো মঞ্চে একটা জয় অনেক বড় ব্যাপার। দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ব্যাটাররা ভালো করেনি। আমি নিজেও কিপিং করতে গিয়ে হাঁটুতে চোট পেয়েছিলাম। একটু নিচের দিকে নেমেছিলাম তিনটি ব্যথানাশক খেয়ে। তবে দায় আমি নিচ্ছি। আমার কাছ থেকে দল যে ধরনের ব্যাটিং পারফরম্যান্স আশা করেছিল, সেটি দিতে পারিনি। ব্যাটিংটা ভালো হলে আমরা সে ম্যাচটাও জিততে পারতাম। অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড আর নিউজিল্যান্ডের সঙ্গে আমরা প্রথমবারের মতো খেলেছি। আমি বিশ্বাস করি, প্রথমবারই যেভাবে খেলেছি, বেশি করে খেললে পারফরম্যান্স আরও ভালো হবে। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ম্যাচটার কথা বিশেষভাবে বলতে হয়। আমাদের অল্প রান তাড়া করতে গিয়ে ওদের ৫ উইকেট পড়ে গিয়েছিল। সালমা আপা সেদিন অসাধারণ বোলিং করেছেন। অস্ট্রেলিয়ার ড্রেসিং রুম থেকে ওদের ব্যাটাররা বলছিল, সালমা আপার ওভার দেখে খেল। এর থেকেই বোঝা যায় কতটা ভয় পেয়েছিল ওরা। আমি মনে করি আমরা যতো বেশি শক্তিশালী দলগুলোর বিপক্ষে ম্যাচ খেলব, তত বেশি ভালো করব।

ভয়েস অফ আমেরিকা: বিশ্বকাপের আত্মবিশ্বাসটা নিশ্চয়ই সামনের দিনগুলোতে কাজে আসবে?

নিগার সুলতানা: আমিও মনে করি তাই। বিশ্বকাপ আমাদের অনেক অভিজ্ঞ করেছে। বিশেষ করে নিউজিল্যান্ডের মাটিতে খেলা হওয়ায়। আমাদের এখন নিজেদের ছাড়িয়ে যেতে হবে। বিশ্বকাপের আত্মবিশ্বাসটা কাজে লাগাতে হবে। ক্রিকেট বোর্ড এরই মধ্যে আমাদের জন্য অনেক ম্যাচের ব্যবস্থা করেছে। এই বছরটা খুব ব্যস্ততার মধ্যে যাবে। সামনে মেয়েদের ক্রিকেটের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল, এটা আমি বলতেই পারি।

ভয়েস অফ আমেরিকা: সামনে ব্যস্ততাগুলো কী কী নিয়ে?

নিগার সুলতানা: ঈদের পরপরই মেয়েদের প্রিমিয়ার ক্রিকেট লিগ শুরু হবে। করোনার কারণে দুই বছর ঘরোয়া ক্রিকেট হয়নি। ঘরোয়া ক্রিকেট খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিযোগিতামূলক ক্রিকেটের চর্চাটা হয় এখানে। কেবল নেট অনুশীলন করে আর নিজেদের মধ্যে অনুশীলন ম্যাচ খেলে উন্নতি করা যায় না। আমি এবার রুপালি ব্যাংকের হয়ে খেলব। খেলাঘর সমাজকল্যাণ সংঘে পাঁচ বছর কাটিয়েছি। এবার নতুন দল দেখে আমার জন্য ব্যাপারটা বাড়তি চ্যালেঞ্জের। সেপ্টেম্বরে চীনের হাংঝুতে এশিয়ান গেমস আছে। সেখানে ভালো করতে হবে। এরপর দক্ষিণ আফ্রিকায় টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপের বাছাইপর্ব আছে। নিউজিল্যান্ড সফরে যাব। এটা দ্বিপক্ষীয় সিরিজ। আমরা খুবই রোমাঞ্চিত এই সিরিজটা খেলতে পেরে। বিসিবি আমাদের জন্য অনেক কিছু করছে। আমাদেরও কিছু দেওয়ার দায় আছে।

XS
SM
MD
LG