অ্যাকসেসিবিলিটি লিংক

সিলেটে নদ-নদীর পানি কমছে, বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি


সিলেটে নদ-নদীর পানি কমছে, বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি
সিলেটে নদ-নদীর পানি কমছে, বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি

বাংলাদেশের সিলেটে, আটদিন পর বন্যার পানি কমতে শুরু করেছে। তবে, সিলেট নগরীর চিত্র আগের অবস্থায় ফিরতে আরও পাঁচদিন লাগবে।

এদিকে, বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড জানিয়েছে, সিলেটবাসী যেন আর এরকম বন্যা পরিস্থিতির শিকার না হন, সেজন্য ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।শনিবার (২১ মে) পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রধান প্রকৌশলীর (পুর) দপ্তরের সিলেটের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী (পুর) এস এম শহিদুল ইসলাম এ কথা জানান। তিনি বলেন, “বর্তমানে বন্যার পানি কমছে। ফলে সিলেটে আর বন্যা পরিস্থিতি অবনতির সম্ভাবনা নেই। তবে, আরও পাঁচদিন পানিবন্দি থাকতে হবে সিলেটবাসীকে। বন্যায় যেখানে যেখানে বাঁধ ভেঙেছে সেখানে আমাদের পক্ষ থেকে আবার নতুন করে বাঁধ দেয়া হচ্ছে।”

এস এম শহিদুল ইসলাম বলেন, “সিলেটে যে নদী ও খালগুলো আছে, সেগুলো ড্রেজিংয়ের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। ড্রেজিং করার লক্ষ্যে আমরা এখানকার নদীগুলো নিয়ে স্টাডি করছি। সিলেটের সুরমা নদীর গতিপথ ঠিক থাকলেও, এর ড্রেজিং করতে হবে। এ লক্ষ্যে নতুন একটি প্রকল্প হাতে নেয়া হচ্ছে। এখনও প্রকল্পের ডিপিপি প্রণয়ন হয়নি, তবে ফিজিবিলিটি স্টাডির কাজ চলছে।”

সুরমা নদীর ড্রেজিং হয়ে গেলে সিলেটে বন্যা পরিস্থিতি কমে যাবে বলে জানান তিনি।

এদিকে, সিলেটে সুরমা, ধোলাই, পিয়াইন নদ-নদীর পানি আগের থেকে কিছুটা কমেছে। তবে বাড়ছে কুশিয়ারার পানি। ফলে নগরসহ আশপাশের এলাকার পানি কিছুটা কমলেও, ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলা নতুন করে প্লাবিত হয়েছে। বিভিন্ন এলাকায় পানি কমলেও জনসাধারণের দুর্ভোগ বেড়ে চলছে।

পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো), সিলেট-এর তথ্য অনুযায়ী, শনিবার (২১ মে) সকাল ৯টায় কানাইঘাট পয়েন্টে সুরমা নদীর পানি বিপৎসীমার ৮৫ সেন্টিমিটার ও সিলেট পয়েন্টে বিপৎসীমার ২৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। শুক্রবারের চেয়ে শনিবার এ দুটি পয়েন্টে পানি প্রবাহ যথাক্রমে ১১ সেন্টিমিটার ও সাত সেন্টিমিটার কমেছে। এছাড়া, শনিবার একই সময়ে কুশিয়ারা নদীর আমলসীদ পয়েন্টে বিপৎসীমার ১৫৬ সেন্টিমিটার, শেওলায় ৫৫ সেন্টিমিটার ও ফেঞ্চুগঞ্জ পয়েন্টে ৩৬ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। শুক্রবারের চেয়ে শনিবার আমলসীদে ১১ সেন্টিমিটার ও শেওলায় তিন সেন্টিমিটার পানির প্রবাহ কম ছিল। তবে, ফেঞ্চুগঞ্জ পয়েন্টে পানি শুক্রবারের চেয়ে শনিবার ১০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। শুক্রবার এ পয়েন্টে পানি বিপৎসীমার ২৬ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়।

পানি কিছুটা কমলেও, কমেনি বন্যাকবলিতদের দুর্ভোগ। বিদ্যুৎ ও গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন, খাবার পানির সংকটতো আছেই। পাশাপাশি উপদ্রুত এলাকায় ছড়িয়ে পড়ছে পানিবাহিত রোগ। সিলেটে বেড়েছে ডায়রিয়ার প্রকোপ। এমন পরিস্থিতিতে, দুর্ভোগ এড়াতে নগর ছাড়তে শুরু করেছেন অনেকে। শুক্র ও শনিবার নগরের প্লাবিত এলাকার অনেক বাসিন্দাকে গ্রামে চলে যেতে দেখা গেছে।

গত ১০ মে থেকে সিলেটে ভারী বর্ষণ শুরু হয়। সেই সঙ্গে উজান থেকে নেমে আসে পাহাড়ি ঢল। ফলে ১১ মে থেকেই সিলেটের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হতে থাকে। আর গত ১৩ মে থেকে সিলেট নগর প্লাবিত হতে থাকে।

শনিবার সিলেটের বিভিন্ন জায়গায় দেখা যায়, যেসব এলাকা, বাসাবাড়ি বা দোকানপাটে পানি প্রবেশ করেছিল, তা ধোয়ামোছা করছেন ভুক্তভোগী জনসাধারণ।

ঘরে জমে থাকা পানি সেচে ধোয়ামোছা করতে দেখা যায় নগরীর লালাদিঘিরপাড় এলাকার বাসিন্দা পলি বেগমকে। তিনি জানান, “শুক্রবার রাতেই তার ঘর থেকে পানি নেমে গেছে। তারপরও ঘরে প্রচুর পানি আটকে আছে। এসব পানি সকাল থেকে সেচে বের করছেন।”

ঘর পরিষ্কার করে জীবাণুনাশক প্রয়োগ করবেন বলে জানান তিনি।

নগরীর উপশহর এলাকার বাসিন্দা আবুল খায়ের জানান, চার দিন ধরে উপশহর এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ নেই। বাসার রিজার্ভ ট্যাংকের পানি প্রায় শেষ পর্যায়ে। বন্যার পানি নামতে শুরু করলেও, কবে পুনরায় বিদ্যুৎ-সংযোগ চালু হবে, তা তিনি জানেন না। ফলে কখন বাসার পানির সমস্যা দূর হবে, তা নিয়েও সংশয় প্রকাশ করেন তিনি।

সিলেট নগরীর ১০ নং ওয়ার্ডের কলাপাড়ার বাসিন্দা আব্দুস সালাম বলেন, “আমার ঘরে যখন পানি প্রবেশ করেছিল, তখন গ্যাসের লাইনে পানি ঢুকে যাওয়ায় গ্যাস-সংযোগ বন্ধ হয়ে গেছে। পুরোপুরি পানি না কমলে এই গ্যাসের সমস্যা সমাধান হবে না।”

সিলেট আবহাওয়া অফিসের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা সাঈদ আহমদ চৌধুরী জানান, “দিন দিন আবহাওয়ার উন্নতি হচ্ছে। তিন-চার দিন আগেও যেখানে কয়েক শ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে, সেখানে গত ২৪ ঘণ্টায় এর পরিমাণ ছিল মাত্র ১২ মিলিলিটার।”

তিনি আরও বলেন, “আগামী ২৩, ২৪ ও ২৫ মের মধ্যে বৃষ্টির পরিমাণ একেবারেই কমে আসবে। বন্যা পরিস্থিতির আরও উন্নতি হবে।”

সিলেট পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্র জানিয়েছে, “শুক্রবারের মতো শনিবারও সুরমার পানি কমা অব্যাহত আছে। শনিবার সকাল ৯টা পর্যন্ত আগের দিনের চেয়ে কয়েক সেন্টিমিটার পানি কমেছে। তবে কুশিয়ারা নদীর পানি দুই সেন্টিমিটার বেড়েছে ফেঞ্চুগঞ্জ পয়েন্টে।”

সিলেট জেলার, ১৩টি উপজেলার ৮৫টি ইউনিয়ন প্লাবিত হয়েছে। ৩২৬টি আশ্রয় কেন্দ্র খোলা হয়েছে বন্যাকবলিত মানুষের জন্য।

সিলেটের জেলা প্রশাসক মো. মজিবর রহমান বলেন, “সিলেটের বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে। তবে প্লাবিত এলাকাগুলো থেকে পানি এখনও নামেনি। সরকার বন্যার্তদের সব ধরনের সহায়তা দিচ্ছে।”

বন্যায়, সড়কের সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে সিলেট জেলায়। জেলায় সওজ ও এলজিইডির আওতাধীন মোট ১২১টি সড়কের ৩৩২ কিলোমিটার সড়ক পানিতে ডুবে গেছে। এ ছাড়াও ভেঙে গেছে দুটি কালভার্ট।

এলজিইডি’র নির্বাহী প্রকৌশলী মো. ইনামুল কবীর জানান, “বন্যায় ১১১টি সড়কের ২৬৭ কিলোমিটার অংশে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। সদর উপজেলা ও কোম্পানীগঞ্জে দুটি কালভার্ট ভেঙেছে। রাস্তার ওপরে এখনও পানি, তাই ক্ষয়ক্ষতির আর্থিক পরিমাণ নির্ধারণ করা যাচ্ছে না।”

সড়ক বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, “সিলেটের আন্তঃজেলা ১০টি প্রধান সড়কের ৬৫ কিলোমিটার অংশ প্লাবিত হয়েছে। এর মধ্যে পাঁচটি সড়কে যান চলাচল সম্পূর্ণ বন্ধ আছে। জকিগঞ্জে বাঁধ ভেঙে নতুন এলাকা প্লাবিত হওয়ায়, দুটি সড়কে পানি দ্রুত বাড়ছে।”

সিলেট জেলা প্রশাসন কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, জেলার ১৩ উপজেলার মধ্যে ১০টি উপজেলার ৮৬টি ইউনিয়ন প্লাবিত হয়েছে। পানিতে দুই হাজার ৪২১ হেক্টর আউশ ধানের বীজতলা, এক হাজার ৭০৪ হেক্টর বোরো ধান ও এক হাজার ৩৩৪ হেক্টর গ্রীষ্মকালীন সবজি বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে। এছাড়া ৬৪০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্যাকবলিত হয়ে পড়ায় অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানে পাঠদান বন্ধ রয়েছে।

এদিকে, শনিবার নগরীতে পানি কমলেও বিশুদ্ধ পানির ও রান্না করা খাবারের সংকট তীব্র হয়েছে। বন্যার পানিতে নগরীর মেন্দিবাগ এলাকায় অবস্থিত সিলেট সিটি করপোরেশনের ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্ট প্লাবিত হয়েছে। পাশাপাশি চারটি পাম্প তলিয়ে যাওয়ায় পানি সরবরাহ করা যাচ্ছে না। এমন অবস্থায় কয়েকটি এলাকার পানিবন্দি মানুষ বিশুদ্ধ পানির সংকটে পড়েছেন। নগরীর শাহজালাল উপশহর এলাকায় বিদ্যুৎ বিভ্রাটের জন্য মানুষের দুর্ভোগ কয়েকগুণ বেড়েছে।

সিসিকের প্রধান প্রকৌশলী নূর আজিজুর রহমান জানান, “পানিবন্দি নগরবাসীর জন্য পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট, খাবার স্যালাইন ও শুকনো খাবার সরবরাহ করা হচ্ছে। এছাড়া ১৩টি আশ্রয় কেন্দ্রে রান্না করা খাবার সরবরাহ করা হচ্ছে। রান্না করা খাবার অপ্রতুল বলে জানিয়েছেন আশ্রয় নেয়া মানুষ।”

জেলার ১৩টি উপজেলার গ্রামগুলোর চারপাশে থইথই পানি। অধিকাংশ ঘরবাড়ি ডুবে আছে। দূর থেকে দেখলে মনে হয়, পানির মধ্যে ভাসছে গ্রামগুলো। কয়েক দিন আগেও যেখানে ধান মাড়াই ও শুকানোর জন্য জায়গা করা হয়েছিল, সেখানে এখন ১০ ফুট পানি।

এসব গ্রামের বাসিন্দারা জানান, আগে গ্রামের চারদিকে প্রচুর খাল ও নালা ছিল। অতিবৃষ্টিতে সেসব জলাধার পানি ধারণ করত। এখন সেসব ভরাট করে আবাসনসহ বিভিন্ন স্থাপনা গড়ে ওঠায় পানিপ্রবাহের স্বাভাবিক পথ রুদ্ধ হয়ে পড়েছে। ফলে বাড়িঘরে বন্যার পানি উঠছে

গ্রামের বাসিন্দারা অভিযোগ করেন, ত্রাণ পাওয়ার জন্যে জনপ্রতিনিধিরা স্বজনপ্রীতি করে তালিকা প্রস্তুত করেছেন। প্রয়োজন সত্ত্বেও অনেক দরিদ্র মানুষ ত্রাণ পাননি। খাবারসহ নানা সংকটে পানিবন্দী জীবনে তাঁদের দুর্ভোগের শেষ নেই বলে অনেকে আক্ষেপ করেন।

চলতি বন্যায় ভেসে গেছে সিলেট জেলায় সাত হাজার ২৫১টি পুকুরের মাছ। ক্ষতি হয়েছে আনুমানিক ছয় কোটি ৭৪ লাখ টাকা। এতে অন্তহীন ক্ষতির মুখে পড়েছেন খামারীরা। এসব তথ্য জানিয়েছেন সিলেট জেলা মৎস্য বিভাগ।

জেলা মৎস্য কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, সিলেটের ১৩টি উপজেলার মধ্যে ১১টি উপজেলায় আট হাজার ৩২২টি পুকুরে খামারিরা মাছ চাষ করেছেন। এগুলোর মধ্যে সাত হাজার ২৫১টি পুকুর বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত পুকুরের মোট আয়তন ৮৫৪ দশমিক ৭০ হেক্টর। জেলার ওসমানীনগর ও ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলায় মাছ চাষি নেই বলে জানা গেছে।

মৎস্য কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, সিলেট জেলার মধ্যে সবচেয়ে বেশি পুকুরের মাছ ভেসে গেছে জকিগঞ্জ উপজেলায়। এখানে তিন হাজার ১০০টি পুকুরের মাছ ভেসে গেছে। এরপর বেশি ক্ষতি হয়েছে গোয়াইনঘাট উপজেলায়। এখানে ভেসে গেছে দুই হাজার পুকুরের মাছ। অন্যান্য উপজেলার মধ্যে বিশ্বনাথে এক হাজার ১৪০, সিলেট সদরে ৪৮০, কানাইঘাটে ১৮০, জৈন্তাপুরে ১১০ ও কোম্পানীগঞ্জে ৮০টি পুকুরের মাছ ভেসে গেছে। বাকি উপজেলার মধ্যে গোলাপগঞ্জে ৫৯, বিয়ানীবাজারে ৪৮, বালাগঞ্জে ৪০ ও দক্ষিণ সুরমায় ১৪টি পুকুরের মাছ ভেসে গেছে। সব মিলিয়ে এক হাজার ৩৩৭ মেট্রিক টন মাছ ও ১২১ মেট্রিক টন পোনা ভেসে গেছে।

XS
SM
MD
LG