অ্যাকসেসিবিলিটি লিংক

মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার ঝুঁকি কমাবেন কিভাবে?


মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা, প্রতীকী ছবি
মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা, প্রতীকী ছবি

বাড়ির লোকদের “সারপ্রাইজ” দিতে চন্দন বাগচী নতুন মোটরসাইকেল কিনে ৩০ এপ্রিল গাজীপুর থেকে বাগেরহাটের উদ্দেশে রওনা দেন। ৩০ বছর বয়সী এই যুবকের সেটাই ছিল শেষযাত্রা। ফরিদপুর পৌঁছালে বাস এবং ট্রাকের মাঝে চাপা পড়ে মারা যান। সেদিন চন্দনের বিয়ে আর নতুন বাড়ি করার স্বপ্ন মহাসড়কে শেষ হওয়ার পাশাপাশি তার মা-বাবার সঙ্গী হয় “আমৃত্যু যন্ত্রণা”!

বাংলাদেশে চন্দনের মতো কয়েক হাজার মানুষ প্রতি বছর সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান। এর প্রায় অর্ধেকই মোটরসাইকেল চালক কিংবা আরোহী। রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের হিসাব অনুযায়ী, সংখ্যাটা গত বছর ছিল ২ হাজার ২১৪ জন।

মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় মৃত্যুর এমন পরিসংখ্যান নিয়ে প্রায় প্রতি মাসেই আলোচনা-সমালোচনার ঝড় ওঠে। দুর্ঘটনা কমাতে “আইনি কাঠামোর বাধ্যবাধকতা”, “সচেতনতা বৃদ্ধির” মতো বিষয়গুলোর প্রতি জোর দেওয়া হয়। কিন্তু ঠিক কীভাবে মোটরসাইকেল চালালে দুর্ঘটনা কম হয়, সে বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা খুব একটা দেখা যায় না।

ভয়েস অফ আমেরিকা কয়েকজন দক্ষ চালক, সড়ক দুর্ঘটনা গবেষক এবং এ বিষয়ে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা ফাউন্ডেশনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপ করে কিছু নির্দেশনা পেয়েছে।

যত গতি, তত ক্ষতি

রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমান ভয়েস অফ আমেরিকাকে জানিয়েছেন, তাদের হিসাব অনুযায়ী গত এপ্রিলে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় ২০৬ জন মারা গেছেন। প্রতিষ্ঠানটির দেওয়া সর্বশেষ তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে, মে মাসের প্রথম ২০ দিনেই সংখ্যাটা বেশ বেড়েছে, ২২০ জন। সাইদুর রহমান জানালেন, অধিকাংশ ক্ষেত্রে অতিরিক্ত গতিই দুর্ঘটনার প্রধান কারণ।

তিনি বলেন, “বাংলাদেশে এই মুহূর্তে ৩৬ লাখ বা তার বেশি মোটরসাইকেল আছে। এটা খুবই অস্বাভাবিক ব্যাপার। এর মধ্যে [মোটরসাইকেল চালকের] ড্রাইভিং লাইসেন্স ইস্যু করা আছে ২৩ লাখ। অর্থাৎ প্রায় ১৩ লাখ চালকের লাইসেন্স ইস্যু করা হয়নি। এর বাইরেও অসংখ্য মোটরসাইকেল আছে। চালকদের বড় একটি অংশ অপ্রাপ্তবয়স্ক কিশোর এবং তরুণ। এই কিশোরদের বেশির ভাগ অত্যন্ত বেপরোয়া গতিতে মোটরসাইকেল চালিয়ে নিজেরা দুর্ঘটনায় আক্রান্ত হচ্ছে এবং অন্যদের আক্রান্ত করছে। বেপরোয়া গতির এই যে প্রবণতা, এটি আইনি কাঠামোর মধ্যে দিয়ে বন্ধ এবং সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। পারিবারিক এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানভিত্তিক কিছু সচেতনতামূলক ক্যাম্পেইন করা যেতে পারে। গণমাধ্যমে প্রচারণা চালাতে হবে। পাশাপাশি যে সড়ক পরিবহন আইন আছে, সেটি নিশ্চিত করতে হবে”।

অধিকাংশ দুর্ঘটনার জন্য অতিরিক্ত গতির কথা বললেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (এআরআই)পরিচালক অধ্যাপক মো. হাদিউজ্জামানও। পাশাপাশি তিনি “প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার’ বিষয়ে গুরুত্ব দিয়েছেন।

তার ভাষায়, ‘‘প্রথম কথা হচ্ছে গতিসীমা। এ কথা আমরা বারবার বলি। গতিসীমার মধ্যে বাইক চালাতে হবে। গতিসীমার কথা যখন বলছি, সাথে সাথে এটাও বোঝাচ্ছি যে, আমাদের দেশে কেউ প্রাতিষ্ঠানিকভাবে মোটরসাইকেল চালানো শেখেন না। হয়তোবা বন্ধুর একটা মোটরসাইকেল নিয়ে শিখেছেন। আপনি যদি পেশাদার প্রশিক্ষকের কাছে না শেখেন, তাহলে অনেক কিছুই অজানা থেকে যায়। সড়ক পরিবহনসংক্রান্ত যে আইনগুলো আছে—ট্রাফিক সাইন, মার্কিংয়ের মানে কী বা সিগন্যালে কী করতে হবে, এই বিষয়গুলো আমরা শিখছি না। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে বিষয়গুলো না শিখলে অনেক কিছুই অজানা থেকে যাচ্ছে। এই অজানা অবস্থায় কোনোমতে চালানো শিখে আমরা সড়ক-মহাসড়কে নেমে যাচ্ছি। এতে দুর্ঘটনার ঝুঁকি দিন-দিন বাড়ছে”।

বাংলাদেশের চালকেরা যে ধরনের হেলমেট ব্যবহার করেন তার সুরক্ষা ক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন আছে। হেলমেটের এই গুণগত মান নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে হাদিউজ্জামান বলেন, ‘‘আমাদের গবেষণায় দেখেছি, হেলমেটের বিষয়টি যেভাবে বিবেচনায় নেওয়া উচিত, এখনো সেভাবে পারিনি। ঢাকা থেকে শুরু করে সারা বাংলাদেশে হেলমেট পরিধানের সংখ্যা বেড়েছে-এটা নিয়ে আমরা আত্মতুষ্টিতে ভুগি। কিন্তু গুণগত মান নিয়ে ভাবছি না। দুর্ঘটনার পরে আমরা দেখি অনেকেরই হেড ইনজুরি আছে। এতে দ্রুত মৃত্যু হয়। এখানে বিএসটিআইয়ের সক্ষমতা বাড়াতে হবে। আমাদের হেলমেট টেস্টিং ল্যাব দরকার”।

মহাসড়কে “মহাবিপদ”

রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের তথ্যমতে ১ থেকে ৫ মে পর্যন্ত পাঁচ দিনে ১১২টি সড়ক দুর্ঘটনায় ১৩৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে ৫৬ জনই মোটরসাইকেল আরোহী। ২৫ এপ্রিল থেকে ৫ মে পর্যন্ত ১৭৮টি সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে ২৪৯ জনের। এর মধ্যে মোটরসাইকেল আরোহী ছিলেন ৯৭ জন।

ফাউন্ডেশনের তথ্য এবং গণমাধ্যমে প্রকাশিত সড়ক দুর্ঘটনার খবরগুলো পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, মহাসড়কের মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা প্রায়ই ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি করে। এ ক্ষেত্রে মোটরসাইকেলের চালক বা আরোহীর পাশাপাশি অন্য পরিবহনের যাত্রীদের দুর্ঘটনা ঝুঁকি বাড়ে।

সাইদুর রহমান তাই বললেন, ‘‘মহাসড়কে মোটরসাইকেল চলাচল নিষিদ্ধ করা গেলে অথবা মহাসড়কের পাশঘেঁষে সার্ভিস রোড নির্মাণ করতে পারলে অনেকাংশে এই দুর্ঘটনা কমে যাবে। আমরা দেখেছি, পণ্যবাহী যানবাহনের সঙ্গে মোটরসাইকেলের বেশি দুর্ঘটনা ঘটছে। এর মধ্যে ট্রাক, কাভার্ডভ্যান, লরি, ট্রাক্টর উল্লেখযোগ্য। মহাসড়কে গেলে চালকদের অতিরিক্ত সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে”।

প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহণের পাশাপাশি চালকেরা আরও যেসব বিষয়ে সতর্ক থাকবেন

১. দূরপাল্লার যাত্রায় পেছনে একজনকে রাখতে হলে সঙ্গী নির্বাচনের বিষয়ে খেয়াল রাখতে হবে। খুব কাছের বন্ধুকে না নেওয়াই ভালো। এ বিষয়ে রাইডার সুমন মন্ডল ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন, ‘‘আমি একটি প্রশিক্ষণ থেকে এ বিষয়ে সতর্ক হয়েছি। প্রিয় বন্ধু পেছনে থাকলে রাইডের সময় অনেক গল্প হয়। এতে দুর্ঘটনার ঝুঁকি দ্বিগুণ বেড়ে যায়”।

২. দুই বা ততোধিক বাইকে একসঙ্গে রাইড করবেন না। সামনের বাইককে অনুসরণ করতে গিয়ে পেছনের বাইক প্রায়ই দুর্ঘটনায় পড়ে।

৩. সামনের বাইক দুই সেকেন্ড আগে ওভারটেক করলেও সময়টা অনেক। এটা পেছন থেকে বোঝা যায় না। তখন মনে হয়, ও তো প্রবেশ করল, আমিও পারব। এমন করবেন না। ওই দুই সেকেন্ড সময়ে অন্য গাড়ি চলে আসবেই।

৪. মোটরসাইকেলে দুর্ঘটনার কিছু ফাঁদ থাকে। এগুলো চিনতে হয়। অনেক সময় চালক কিছু একটা ভাবতে ভাবতে কল্পনার জগতে চলে যান। এ সমস্যা থেকে বাঁচার জন্য নিজের সঙ্গে নিজে কথা বলবেন। নিজেকে মনোযোগ ঠিক রাখতে বলবেন।

৫. মোটরসাইকেল চালানোর সঙ্গে ফুটবল খেলার ব্যাকরণগত একটা মিল আছে। ফাঁকা জায়গা তৈরি। সব সময় সামনে-পেছনে স্পেস রাখবেন। কাছাকাছি কেউ চলে আসলে, তার গতি আপনার মতো হলে ছেড়ে দিয়ে আবার জায়গা বানাবেন। ওভারটেক করতে যাবেন না।

৬. অবশ্যম্ভাবী পরিস্থিতি সৃষ্টি না হলে ওভারটেক এড়িয়ে যাওয়া ভালো। যে যেতে চায়, তাকে যেতে দিন। একান্তই ওভারটেক করতে হলে সামনের গাড়ির আয়নায় চালককে আগে দেখে নেবেন। চালককে আপনি দেখতে পেলে আপনাকেও তিনি দেখবেন।

৭. বাস কিংবা ট্রাকের গা ঘেঁষে ওভারটেক করবেন না। দূরত্ব রাখবেন। খুব কাছে থেকে ওভারটেক করলে চালক আপনাকে দেখতেই পাবে না।

৮. একটা রিকশা অথবা ভ্যানকে ওভারটেক করলেও সতর্ক থাকবেন। যাকে ওভারটেক করছেন তিনি যেন বুঝতে পারেন। সামনের চালক আপনার ওভারটেকের বিষয়টি বুঝতে পেরেছেন কি না, এ বিষয়ে আপনার আগে নিশ্চিত হতে হবে। এটা নিজেই অনুভব করা যায়।

৯. ট্রাক! এই পরিবহনটি মোটরসাইকেল চালকদের জন্য বিপজ্জনক। সামনে দেখলে পাশে চলে যাবেন, পেছনে দেখলেও ছেড়ে দেবেন।

১০. সামনে আগুয়ান কোনো বাস দেখলে নিজের গতি কমান। পেছনে অনেক গতিতে কেউ আসলেও নিজের গতি কমান। মনে রাখবেন দুর্ঘটনা অন্যের গতি এবং ভুলের কারণেও হতে পারে।

১১. সামনে পেছনে গতিময় গাড়ি দেখলেই ধরে নেবেন আপনার দিকে আসলেও আসতে পারে। তিনি মদ্যপ কিংবা ঘুম ঘুম চোখে আছেন কি না সেটি আপনার জানার কথা নয়। মোট কথা গন্তব্যে পৌঁছানোর আগ পর্যন্ত সতর্ক থাকা প্রয়োজন। নিজের গতি এমন পর্যায়ে রাখবেন যেন অন্যদিকে গাড়ি নামিয়ে দিতে পারেন।

১২. সামনে-পেছনে অবারিত স্পেস পেলেই একটু গতিতে চালাতে পারেন। মনে রাখবেন, দুর্ঘটনার অর্থ হচ্ছে, যে পরিস্থিতির কথা আপনার ভাবনায় ছিল না। গতিতে গাড়ি চালালেই এই ধরনের পরিস্থিতি বেশি সৃষ্টি হয়। ছোট একটা ইটের কারণেও একদম ফাঁকা রাস্তায় আপনি পড়ে যেতে পারেন। এ কারণেই মূলত বলা হয়-যত গতি, তত ক্ষতি।

১৩. দুর্ঘটনায় সবাই কম-বেশি পড়েন। যার গতি কম থাকে, তিনি প্রায়ই অক্ষত অবস্থায় রক্ষা পান। গতি বেশি হলে...!

১৪. হাইওয়েতে সাইনবোর্ড খেয়াল করতে হবে। নিচ থেকে উঠে আসা ছোট রাস্তা দিয়ে ভ্যান-নসিমন মূল সড়কে চলে আসে। “সংযোগ সড়ক” লেখা সাইনবোর্ড দেখলেই গতি কমাতে হবে।

১৫. বাংলাদেশের মহাসড়কে গরু থেকে শুরু করে ধান পর্যন্ত দেখা যায়। এসব দূর থেকে খেয়াল রেখে গতি নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।

১৬. গর্ত! ঢাকার রাস্তায় একটু পর পর বড় বড় গর্ত দেখা যায়। কোনোটি ম্যানহোলের, কোনোটি আবার ভেঙে সৃষ্টি হয়েছে। মহাসড়কেও এমন থাকতে পারে। বড় গাড়ির পেছনে মাঝ বরাবর থাকলে এই গর্ত বুঝতে পারবেন না। তাই দূরত্ব রেখে একদিকের চাকা অনুসরণ করে চালাতে হবে।

১৭. আয়নার ব্যবহার: একটু পর পর আয়নায় পেছনের গাড়ি পর্যবেক্ষণ করবেন। এটি নিয়মিত অনুশীলন করতে হবে।

১৮. ডিভাইডারহীন রাস্তা: মহাসড়কে ডিভাইডার থাকে কিছু দূর, কিছু পথ আবার থাকে না। এসব এলাকায় বেশি দুর্ঘটনা হয়। ডিভাইডারহীন রাস্তায় এক দিকের বড় গাড়ি প্রায়ই অন্য দিকে চলে আসে। সাবধান!

১৯. একটানা দ্রুতি গতি: একটানা দ্রুত গতিতে থাকলে বিভ্রম তৈরি হয়। দূরে গেলে এক ঘণ্টা পর পর ৫ মিনিট করে বিশ্রাম নিন।

২০. নতুন চালকেরা আদর্শ ব্রেকিং পদ্ধতি অনেক সময় বুঝে উঠতে পারেন না। যাদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেই, তাদেরই এই সমস্যা শুরুতে বেশি হয়। হাত এবং পা-দুটি ব্রেক একসঙ্গে করতে হবে। জরুরি পরিস্থিতি ছাড়া চকিত এভাবে ব্রেক করবেন না। বিশেষ করে যদি আপনার বাইকে “এন্টি লক ব্রেকিং সিস্টেম” বা এবিএস না থাকে। এবিএস থাকলেও গতি নিয়ন্ত্রণে এনে ব্রেকের অভ্যাস অবশ্যই করতে হবে।

XS
SM
MD
LG