প্রায় চার মাস পর গত বুধবার (২২ জুন) বাংলাদেশে একদিনে করোনা শনাক্ত আবার এক হাজার ছাড়িয়েছে। বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, রাজধানীর কয়েকটি এলাকায় মহামারির চতুর্থ ঢেউ শুরু হয়েছে।
তারা ওমিক্রনের দুটি সাব-ভেরিয়েন্ট-বিএ.৪-৫ কে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও কোভিড সংক্রমণের হার বাড়ানোর জন্য দায়ী বলে মনে করছেন। বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, আগামী সপ্তাহগুলোতে করোনা শনাক্ত আরও বাড়তে পারে, শুরু হতে পারে কমিউনিটি ট্রান্সমিশন।
তবে নতুন ঢেউ আগেরগুলোর মতো মারাত্মক হওয়ার সম্ভাবনা কম বলে মনে করেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, অনেক মানুষের মধ্যে সংক্রমণ বা উল্লেখযোগ্য সংখ্যার মানুষকে টিকা দেয়ার মাধ্যমে অ্যান্টিবডি অর্জন হয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মুখপাত্র ডা. রোবেদ আমিন, আইইডিসিআরের উপদেষ্টা ডা. এম মুশতাক হোসেন এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) সাবেক আঞ্চলিক উপদেষ্টা মুজাহেরুল হক এমন পর্যবেক্ষণের কথা জানান।
তারা কোভিড-১৯ স্বাস্থ্যবিধি কঠোরভাবে মেনে চলার ওপর জোর দেন। যার মধ্যে রয়েছে সবাইকে মাস্কের ব্যবহার এবং সবচেয়ে বয়স্ক ব্যক্তিদের সংক্রমণ কমাতে কোভিড ভ্যাকসিনের বুস্টার ডোজের কভারেজের আওতায় আনার জন্য ভ্যাকসিনেশন বৃদ্ধি করা।
বাংলাদেশে গত বুধবার ১ হাজার ১৩৫ এবং গত বৃহস্পতিবার ১ হাজার ৩১৯ জন নতুন করে করোনা সংক্রমিত বলে শনাক্ত হয়েছে।
এর আগে, গত ২৫ ফেব্রুয়ারি সর্বশেষ দৈনিক ১ হাজারের বেশি (১ হাজার ৪০৯ জন) করোনা সংক্রমিত বলে শনাক্ত হয়েছিল, যেখানে ১১ জন মারা গিয়েছিল।
সাম্প্রতিক সংক্রমনের হার নিয়ে ডা. রোবেদ আমিন বলেন, “ওমিক্রনের সাব-ভেরিয়েন্ট বিএ.৪-৫ বিশ্বব্যাপী অনেক জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছে। আমি মনে করি এই দুটি সাব-ভেরিয়েন্টের সংক্রমণ আমাদের দেশে কোভিড শনাক্ত বৃদ্ধির পেছনে ভূমিকা রাখছে। আমরা নিশ্চিত হওয়ার জন্য জিন সিকোয়েন্সিং রিপোর্টের জন্য অপেক্ষা করছি।”
ডা. আমিন বলেন, “ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তির সংখ্যা বৃদ্ধি আরও অন্তত তিন সপ্তাহ অব্যাহত থাকবে। তবে এই ঢেউ মারাত্মক নাও হতে পারে। যেহেতু ক্রমবর্ধমান শনাক্ত-সংখ্যার তুলনায় হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীর সংখ্যা এখনও খুব কম, আমরা ধরে নিতে পারি যে, এই ঢেউ গুরুতর না-ও হতে পারে।”
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলেছেন, “ঢাকা শহরের বিভিন্ন গোষ্ঠী এখন বিভিন্ন ভাইরাসের ক্লাস্টার সংক্রমণ প্রত্যক্ষ করছে। লোকজন মাস্ক না পরে এবং অন্যান্য স্বাস্থ্য সুরক্ষা বিধি বজায় না রেখে, ঘোরাফেরা করার কারণে এটি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে না। এছাড়া, এখনও কোভিড সংক্রমণের আসল চিত্র পাওয়া যাচ্ছে না, কারণ ভাইরাসের লক্ষণ রয়েছে এমন অনেক লোক কোভিড পরীক্ষা করছে না।”
রোবেদ বলেন, “কোভিড পরিস্থিতির আরও অবনতি হলেও, আমরা মোকাবেলার জন্য প্রস্তুত। প্রায় ২ হাজার হাসপাতালের বেড কোভিড রোগীদের চিকিৎসার জন্য প্রস্তুত রয়েছে।”
জনগণকে ভ্যাকসিনের বুস্টার ডোজ গ্রহণের আহ্বান জানান ডা. রোবেদ।ডা. রোবেদ বলেন, “এখনও অনেকে তৃতীয় ডোজ পাননি। টিকা দেয়ার মাধ্যমে সংক্রমণ বন্ধ নাও হতে পারে। তবে, এটি তীব্রতা কমাতে পারে। তাই, বয়স্ক ব্যক্তি এবং যাদের বিশেষ ধরণের রোগ আছে, তাদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিয়ম কঠোরভাবে পালন করতে হবে। পাশাপাশি, তাদের তৃতীয় ডোজ গ্রহণ করা উচিত।”
ডা. এম মুশতাক বলেন, “হঠাৎ করে কোভিড আক্রান্তের সংখ্যা বৃদ্ধি একটি ইঙ্গিত যে, বাংলাদেশে মহামারির চতুর্থ ঢেউ আসছে। মানুষ যদি স্বাস্থ্যবিধি যথাযথভাবে মেনে চলে, তাহলে তিন সপ্তাহ পর্যন্ত ভাইরাসের সংক্রমণ বাড়তে পারে। ভাইরাসটি ঢাকায় ক্লাস্টার ভিত্তিতে ছড়িয়ে পড়ছে এবং কিছু জেলাতেও বিক্ষিপ্তভাবে সংক্রমণ বাড়ছে। তবে শিগগিরই কমিউনিটি ট্রান্সমিশন শুরু হবে।”
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ মুশতাক বলেন, “নতুন ঢেউ অনিবার্য ছিল। কারণ স্বাস্থ্য সুরক্ষা বিধি বজায় রাখতে এবং মাস্ক পরার জন্য মানুষের উদাসীনতার কারণে এটি কিছুটা আগে এসেছে। অন্যদিকে, প্রাকৃতিক সংক্রমণ বা টিকা দেয়ার মাধ্যমে অর্জিত রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তিন মাস পর ক্ষয় হয়ে যায়।”
তিনি বলেন, “আমরা আশা করি এই ঢেউ মারাত্মক হবে না,। কারণ প্রায় ৭০ শতাংশ মানুষ ইতোমধ্যে দুটি ডোজ গ্রহণ করেছে। অনেক লোকের ভাইরাসের সংস্পর্শে আসার মাধ্যমে প্রাকৃতিক অ্যান্টিবডি রয়েছে। মৃত্যুহার কমাতে, বয়স্ক এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম ব্যক্তিদের যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ভ্যাকসিনের তৃতীয় ডোজ দেয়া উচিত।”
ডা. এম মুশতাক বলেন, “সরকারের উচিত স্বাস্থ্য সুরক্ষা বিধি কঠোরভাবে প্রয়োগ করা এবং গণসমাবেশ, জনসমাবেশ এবং সামাজিক সমাবেশকে নিরুৎসাহিত করা। আর, এখনো যারা টিকা পাননি, তাদের খুঁজে বের করতে হবে। বয়স্ক মানুষ, বিশেষ করে যারা বুস্টার ডোজ নেননি, তাদের অবশ্যই টিকা দিতে হবে।”
তিনি বলেন,“সরকারের উচিত অবিলম্বে সংক্রমিত ব্যক্তিদের কাছাকাছি আসা ব্যক্তিদের শনাক্ত করা এবং তাদের আইসোলেশন পাঠানোর ব্যবস্থা করা। আমাদের এখন কঠোরভাবে এটি অনুসরণ করা উচিত। কারণ শনাক্তের সংখ্যা এখনও কম। সরকারের উচিত ভাইরাসের উপসর্গ আছে এমন ব্যক্তিদের কোভিড টেস্ট করাতে উৎসাহিত করা। পরীক্ষা, কন্টাক্ট ট্রেকিং এবং আইসোলেশন, ভাইরাস ধারণ করার মূল নীতি।”
ডা. মুজাহের বলেন, “ভাইরাসটি বিভিন্ন জেলায় ছড়িয়ে পড়তে পারে বলে, মৃত্যুর হার কমাতে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা প্রদানের জন্য সরকারের উচিত উপজেলা স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলোকে প্রস্তুত করা।”