অ্যাকসেসিবিলিটি লিংক

স্বদেশী সাবানের বিজ্ঞাপনে রবীন্দ্রনাথ


গোদরেজ সাবানের বিজ্ঞাপনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
গোদরেজ সাবানের বিজ্ঞাপনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলনের ফলে সৃষ্টি হওয়া গণজাগরণের অভিঘাতে, শুরু হয়েছিল ছিল স্বদেশী আন্দোলন। এই আন্দোলনের উদ্দেশ্য ছিল ব্রিটিশ পণ্য বয়কট করা এবং ভারতেই সেই সব পণ্য উৎপাদন করে ব্রিটিশরাজকে অর্থনৈতিক দিক থেকে পঙ্গু করে দেওয়া। ব্রিটিশ পণ্য বর্জনের কথা প্রচার করে চলেছিলেন অরবিন্দ ঘোষ, বিনায়ক দামোদর সাভারকর, বাল গঙ্গাধর তিলক, লালা লাজপত রায়, গান্ধীজি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরসহ আরও অনেক মনীষী।

স্বাধীনতা আন্দোলনে নিজেকে সামিল করার জন্য ভারতীয় ব্যবসায়ীরা নেমে পড়েছিলেন পণ্য উৎপাদনের কাজে। গুণগত মানের দিক থেকে ভারতীয় পণ্যগুলি কিছুটা পিছিয়ে থাকলেও, সেই সব স্বদেশী পণ্যকেই বুকে আঁকড়ে ধরেছিলেন ভারতীয়রা। ব্যবসায়ীরাও নিজেদের মুনাফার লোভ ত্যাগ করে, দেশীয় পণ্যগুলির মান বিশ্বমানে তোলার জন্য সর্বশক্তি নিয়োগ করেছিলেন।

তৈরি হয়েছিল ‘গোদরেজ সোপ লিমিটেড’

১৮৯৭ সালে ভারতের মাটিতে প্রথম সাবান তৈরি করতে শুরু করেছিল মেরঠের ‘নর্থ ওয়েস্ট’ কোম্পানি। কিন্তু সেই সাবান ব্রিটিশ লগ্নি ও প্রযুক্তিতে তৈরি হতো। ১৯১৬ সালে, স্বদেশী আন্দোলনের জোয়ারে ভেসে মহীশুররাজ কৃষ্ণ রাজা ওয়াদিয়ার তৈরি করেছিলেন মাইশোর সোপ ফ্যাক্টরি। ভারতবাসীর হাতে এসেছিল চন্দনের গন্ধে সুরভিত ‘মাইশোর স্যান্ডেল সোপ’। মাত্র দু’বছর পরে, ১৯১৮ সালে, স্বদেশী পণ্য বানানোর ভাবনা থেকেই সাবানের ব্যবসায় এসে পড়েছিল টাটাগোষ্ঠী। উৎপাদন করতে শুরু করেছিল কাপড় কাচার সাবান।

দেশীয় সাবানের বাজারে মহীশুররাজ ও টাটাগোষ্ঠীর সাফল্য দেখে, আর্দেশির ও পিরোজশা গোদরেজ পরীক্ষামূলকভাবে নেমে পড়েছিলেন সাবানের বাজারে। ১৯১৮ সালেই পথচলা শুরু করেছিল গোদরেজ সোপ লিমিটেড। বাজারে এসেছিল গোদরেজ সোপ লিমিটেডের কাপড় কাচার বার সাবান। কিন্ত যে বাজারে টাটাগোষ্ঠী আছে সেখানে একই ধরণের পণ্য নিয়ে টিকে থাকা খুবই কঠিন। সাবানের বাজারে অস্তিত্ব রক্ষার উপায় ভাবতে ভাবতে আর্দেশিরের মাথায় এসেছিল এক যুগান্তকারী পরিকল্পনা।

পৃথিবীর প্রথম ‘অহিংস’ সাবান

সেই যুগে পশুর চর্বি ছিল সাবানের প্রধান উপকরণ। অহিংসা নীতি ও নিরামিষ আহারে বিশ্বাস রাখা বেশিরভাগ ভারতীয়রা তাই কোম্পানির তৈরি সাবান কিনতেন না। এই বিশাল সংখ্যক ক্রেতার কথা ভেবেছিলেন আর্দেশির। গোদরেজ সোপ লিমিটেডের নতুন সাবানে মিশিয়ে দিয়েছিলেন ভারতের চিরন্তন ‘অহিংসা’ নীতি। দু’বছর ধরে গোপনে গবেষণা চালিয়ে, ১৯২০ সালে আর্দেশির ভারতের বাজারে এনেছিলেন চাভি ব্র্যান্ডের ‘No. 2’ সাবান। এটিই পৃথিবীর প্রথম চর্বিমুক্ত সাবান। যে সাবানে চর্বির পরিবর্তে ব্যবহার করা হয়েছিল উদ্ভিজ্জ তেল। ‘No. 2’ সাবান বাজারে আসার পর এক সাক্ষাতকারে আর্দেশির বলেছিলেন, “We launch Chavi, the first soap in the world to be made without animal fat. We score for Swadeshi and ahimsa.”।

১৯২২ সালে বাজারে এসেছিল গোদরেজের ‘No. 1’ সাবান

ইচ্ছে করেই আর্দেশির গোদরেজ বিশ্বের প্রথম চর্বিমুক্ত সাবানটির নাম দিয়েছিলেন ‘No. 2’। কারণ তার মাথায় No.1 সাবান তৈরির পরিকল্পনা চলছিল। No. 1 সাবানটি হবে ব্রিটিশ সাবান গুলির থেকেও উন্নত। একেবারে বিশ্বমানের। কিন্তু দাম হবে ‘No. 2’ সাবানের থেকে সামান্য বেশী। ১৯২২ সালে তাই বাজারে এসেই তুফান তুলেছিল গোদরেজের No.1 সাবান।

তবুও বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে ভারতে তৈরি বিশ্বমানের সাবানকে আরও ছড়িয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করেছিলেন আর্দেশির। এর আগে ‘No. 2’ সাবানের বিজ্ঞাপনে দেখা গিয়েছিল অ্যানি বেসান্ত ও রাজাগোপালাচারিকে। তারা স্বদেশী ব্র্যান্ডটিকে সফল করতে সর্বান্তকরণে সাহায্য করেছিলেন। No.1 সাবানের বিজ্ঞাপনের জন্য আর্দেশির বেছে নিয়েছিলেন এমন একটি মানুষকে, ভারত সহ বিশ্বের মানুষ যাকে এক ডাকে চেনেন। তিনি হলেন রবীন্দ্রনাথ।

বাংলার বিজ্ঞাপনদাতাদের কাছে তখন রবীন্দ্রনাথের চাহিদা তুঙ্গে

না অর্থ উপার্জনের জন্য নয়, স্বদেশী কোম্পানিগুলির পায়ের তলার মাটি শক্ত করার জন্য রবীন্দ্রনাথ তখন দেখা দিচ্ছিলেন একের পর এক স্বদেশী পণ্যের বিজ্ঞাপনে। আজকের দিনে ভারতের সেলিব্রেটিরাও এতো বিজ্ঞাপন করেছিলেন কিনা সন্দেহ। রবীন্দ্রনাথের করা বিজ্ঞাপনগুলিকে নিয়ে অসামান্য গবেষণা করেছেন অরুণ কুমার রায়। ১৮৮৯ সাল থেকে ১৯৪১ সাল পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথের করা প্রায় ৯০টি পণ্যের বিজ্ঞাপন খুঁজে পেয়েছিলেন অরুণ বাবু। এর বাইরেও সম্ভবত অসংখ্য বিজ্ঞাপনে দেখা গিয়েছিল বিশ্বকবিকে।

প্রায় সব ধরণের পণ্যের বিজ্ঞাপনে দেখা যেতো রবীন্দ্রনাথের নাম ও উক্তি। কিংবা ছবি ও উক্তি। পণ্যগুলির মধ্যে ছিল বই থেকে শুরু করে স্নো, ক্রিম, ঘি, মিষ্টি, কেশ তেল, ওষুধ, লাইম জুস, তিল তেল, গ্লিসারিন, হারমোনিয়াম ও আরও কত কী। বিজ্ঞাপনগুলি প্রকাশিত হতো বসুমতী, ক্যালকাটা মিউনিসিপ্যাল গেজেট, ভাণ্ডার, সাধনা ম্যাগাজিনগুলিতে। প্রকাশিত হতো আনন্দবাজার, অমৃতবাজার ও স্টেটসম্যান পত্রিকাতে। ডঃ উমেশ চন্দ্র রায়ের ‘পাগলের মহৌষধ’ নামক একটি ওষুধের বিজ্ঞাপনে রবীন্দ্রনাথের একটি মজার উক্তি তো প্রবাদ হয়ে গিয়েছিল। পাগলের মহৌষধের বিজ্ঞাপনে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, “আমি ইহার উপকারিতা বহুকাল যাবৎ জ্ঞাত আছি।”

গোদরেজের No.1 সাবানের বিজ্ঞাপনে দেখা দিলেন রবীন্দ্রনাথ

বিশ্বকবির লেখার প্রেমে আগেই পড়েছিলেন সাহিত্যপ্রেমী আর্দেশির। No.1 সাবানের বিজ্ঞাপনে তাই চেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথকেই। যার জনপ্রিয়তা বিশ্বজোড়া। গোদরেজের স্বদেশী সাবানের বিজ্ঞাপনের মডেল হওয়ার প্রস্তাব ফিরিয়ে দেননি রবীন্দ্রনাথ। ১৯২২ সালে সারা ভারত জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছিল গোদরেজ No.1 সাবানের বিজ্ঞাপন। বিজ্ঞাপনের ছবিতে দেখা গিয়েছিল, হাত দুটো কোলের সামনে রেখে বসে আছেন বিশ্বের সাহিত্য ও সংস্কৃতির অন্যতম সেরা নক্ষত্র রবীন্দ্রনাথ।

ছবির পাশে লেখা, “I know of no foreign soaps better than Godrej’s and I will make a point of using it.”।

[রূপাঞ্জন গোস্বামী/ দ্য ওয়াল]

XS
SM
MD
LG