অ্যাকসেসিবিলিটি লিংক

মেয়েদের ফুটবলে এবার ‘সব দুয়ার’ খোলার অপেক্ষা


নেপালে সাফ নারী শিরোপা জয়ী বাংলাদেশের নারী ফুটবল দলের সদস্যরা,ঢাকায় খোলা ছাদের বাসে দাঁড়িয়ে সমর্থকদের দিকে হাত নাড়ছেন। (ছবি মুনির উজ জামান / AFP)
নেপালে সাফ নারী শিরোপা জয়ী বাংলাদেশের নারী ফুটবল দলের সদস্যরা,ঢাকায় খোলা ছাদের বাসে দাঁড়িয়ে সমর্থকদের দিকে হাত নাড়ছেন। (ছবি মুনির উজ জামান / AFP)

বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় বুধবারের মতো এমন বিকেল খুব কম এসেছে। কখনো মেঘ, কখনো রোদ্দুরে ভরা আকাশের নিচে ছাদখোলা বাসে এই বিকেলের যারা সঙ্গী হলেন, তারা অধিকাংশ নিম্নমধ্যবিত্ত কিংবা দরিদ্র পরিবারের কন্যাসন্তান। ১৭ কিলোমিটারের পথটুকু যেতে যেতে সাফ ফুটবলের জয়িতাদের কানে এসেছে হাজারো মানুষের জয়ধ্বনি। কেউ এদিন দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলেননি, বরং ফুল ছুঁড়েছেন। স্যালুট দিয়েছেন। এদিনের যাত্রাপথ তাদের এ জীবনকালের সীমারেখায় যে পতাকা উড়িয়ে দিল, তাতে কোটি টাকা পুরস্কারের ঘোষণা যেমন এসেছে, তেমনি অপেক্ষা করছে আরও সব প্রতিবন্ধকতা দূর হওয়ার।

শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে চার ঘণ্টার জ্যাম ঠেলে মেয়েরা বাফুফে ভবনে যাওয়ার পর জনাকীর্ণ সংবাদ সম্মেলনে তাদের পরবর্তী লক্ষ্যের বিষয়ে কথা হয়েছে। এসেছে সাড়ে চারশো কোটি টাকার একটি প্রস্তাবনার প্রসঙ্গও। পরে বাফুফে কর্মকর্তারা এবং যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী মোঃ জাহিদ আহসান রাসেল ভয়েস অফ আমেরিকাকে জানিয়েছেন, নারী ফুটবলের উন্নয়নে এবং তাদের সামাজিক প্রতিবন্ধকতা দূর করতে নানা পদক্ষেপ হাতে নেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে সরকারের উচ্চপর্যায়েও শুরু হয়েছে আলোচনা।

প্রতিমন্ত্রীর বিশ্বাস, সাফ শিরোপা জয়ের এই ঐতিহাসিক মুহূর্ত বাংলাদেশের নারীদের জন্য সুযোগ-সুবিধার সব দুয়ার খুলে দেবে।

‘‘স্কুল লেভেলে বঙ্গমাতা গোল্ডকাপ চলছে। যখন এটা শুরু হয়, তখন অনেক ধরনের বাধা বিপত্তি হয়েছিল,’’ বাফুফে ভবন থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেল ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন, ‘‘আল্লাহর রহমতে কয়েক বছর ধরে সেটি কমেছে। এখনো অনেকের মধ্যে দৃষ্টিভঙ্গির সমস্যা রয়েছে। সেই দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনে এই ধরনের ফলাফল অনেক বেশি কাজ করবে। সরকারের পক্ষ থেকে নারীর উন্নয়নে, ক্ষমতায়নে আমরা কাজ করছি। নারীরা যে পিছিয়ে নেই, এই শিরোপা তার প্রমাণ। আমাদের ছেলেরা হয়তো একটু দেরিতে পাচ্ছে বা পাবে। কিন্তু মেয়েরা অনেক আগে থেকেই বয়সভিত্তিক সব টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন। এখন জাতীয় দল চ্যাম্পিয়ন হলো। এটি আমাদের জন্য অনেক বড় অর্জন। এই অর্জন তাদের সব দুয়ার খুলে দেবে।’’

এর আগে তিনি সংবাদ সম্মেলনে বলেন,‘‘ফুটবল ফেডারেশনের পক্ষ থেকে একটি দীর্ঘমেয়াদি প্রশিক্ষণ এবং একাডেমি তৈরির প্রস্তাবনা আমাদের মন্ত্রণালয়ে ইতিমধ্যে জমা পড়েছে। এ জন্য ব্যয় হবে সাড়ে চারশো কোটি টাকা। এই প্রশিক্ষণ কার্যক্রমের সঙ্গে চারটি একাডেমি থাকবে। বাংলাদেশের চারটি জেলায় একাডেমিগুলো হবে। এই বিজয়ের পরে, এই উৎসবের পরে প্রস্তাবনাটি পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে জমা দিলে কোথাও আটকে থাকবে না বলে আমি মনে করি। খুব সহজে আমরা অনুমোদন পাব।’’

প্রতিমন্ত্রীর মতো বাফুফে সভাপতি কাজী সালাউদ্দিনও তার পরিকল্পনা সাজিয়ে ফেলেছেন, ‘‘আমি পরবর্তী ধাপের কথা ভাবছি। দক্ষিণ এশিয়া ছেড়ে পুরো এশিয়া নিয়ে চিন্তা করছি। এটার জন্য আমার সঙ্গে টেকনিক্যাল ডিরেক্টরের কথা হয়ে গেছে। আমরা গেমপ্ল্যান তৈরি করেছি। অপেক্ষা করছি ফান্ডিংয়ের জন্য। এরপরে থাইল্যান্ড, কোরিয়া, জাপান-এদের সঙ্গে খেলব। খেললে হয়তো দু-চার গোলে হারব। কিন্তু ব্যাপার না। আমাদের শিখতে হবে। কয়েকটি দলের সঙ্গে আবার জিতব। এই প্রোগ্রাম ইতিমধ্যে করেছি।’’

জাতীয় দল ব্যবস্থাপনা কমিটির চেয়ারম্যান কাজী নাবিল আহমেদ মনে করছেন এই জয় নতুন প্রজন্মের মেয়েদের ফুটবল খেলতে উদ্বুদ্ধ করবে, ‘‘বাংলাদেশের নারীরা এই চ্যাম্পিয়নশিপ জেতায় আমি গর্বিত। মেয়েদের নতুন প্রজন্ম এবং অন্যদের এটা ফুটবল খেলা শুরু করতে উদ্বুদ্ধ করবে। এমন আত্মবিশ্বাসী জয় দেখা স্বস্তির।’’ ভয়েস অফ আমেরিকাকে তিনি আরও বলেন

সোমবার (১৯ সেপ্টেম্বর) নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডুর দশরথ স্টেডিয়ামে নারী সাফের ফাইনালে স্বাগতিক দেশ নেপালকে ৩-১ গোলে উড়িয়ে চ্যাম্পিয়ন হয় বাংলাদেশ। বুধবার (২১ সেপ্টেম্বর) চ্যাম্পিয়ন মেয়েরা দেশে ফেরেন।

সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে এই প্রথম শিরোপা জিতলো বাংলাদেশের নারী জাতীয় দল। এই দলের অধিকাংশ খেলোয়াড়কে এক দশক ধরে দেখভাল করছে বাফুফে। দীর্ঘ এই যাত্রা যে মোটেও সহজ ছিল না সেটি এদিন মনে করিয়ে দিয়েছেন নারী ফুটবল কমিটির চেয়ারম্যান মাহফুজা আক্তার কিরন।

তিনি বলেন, ‘‘আজকে আপনারা মেয়েদের যে ফুটবল দেখতে পাচ্ছেন, সেটি মূলত ২০১২ সালের ফসল। আজকে যে কৃষ্ণা, মারিয়া, সানজিদাকে দেখতে পাচ্ছেন তারা ২০১২ সালের ট্যালেন্ট হান্ট থেকে এসেছে। এদের নিয়ে অনেক চড়াই-উতরাই পার করে এখানে এসেছি। এই জার্নি সহজ ছিল না। অনেক স্ট্রাগল করতে হয়েছে।’’

‘‘১২ সালে আমরা যখন ট্যালেন্ট হান্ট করে ওদের নিয়ে আসি, তখন একটা স্পন্সরও ছিল না। আমি এবং প্রেসিডেন্ট (কাজী সালাউদ্দিন) বসে তখন আলোচনা করি আমাদের বছরব্যাপী প্রশিক্ষণ দরকার। কিন্তু কীভাবে করব? প্রেসিডেন্ট বললেন, শুরু করো। দেখা যাবে। এরপর ২০১৫ সাল পর্যন্ত ট্রেনিংয়ের সব খরচ আমি এবং কাজী সালাউদ্দিন ব্যক্তিগতভাবে বহন করেছি। প্রতিদিন মেয়েদের খেতে ৩০-৩৫ হাজার টাকা লাগে। তাদের মেডিকেল, স্পোর্টস গিয়ার-সব মিলিয়ে অনেক খরচ।’’

এত অনিশ্চয়তার ভেতরেও বাফুফে নারী ফুটবলে বিনিয়োগ করায় মেয়েরা প্রতিদানের সংকল্প করেন। অধিনায়ক সাবিনা খাতুন ভয়েস অফ আমেরিকার সঙ্গে আলাপকালে সেই সংকল্পের কথা স্মরণ করেন, "আমার দলের অধিকাংশ ফুটবলারের বয়স আমার থেকে কম। আমি এদের আগলে রাখি। টুর্নামেন্ট শুরুর আগে সবাইকে বলেছিলাম, স্যারেরা আমাদের জন্য এত কিছু করছেন, আমাদেরও কিছু করতে হবে।’’

‘‘...সংবাদ সম্মেলনেও বলেছি, এখনো বলছি: মেয়েদের ফুটবলে বাফুফে যে ইনভেস্ট করেছে, আমার মনে হয় তার প্রতিদানে আমরা সফল। আমাদের লক্ষ্য থাকবে দেশের মানুষকে এমনভাবে হাসিখুশি রাখার। আজকে তারা যেভাবে আমাদের স্বাগত জানিয়েছে, তাতে বলার অবকাশ থাকে না যে বাংলাদেশের মানুষ ফুটবলকে কতটা ভালোবাসে।’’

এখন পর্যন্ত যত পুরস্কার

এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত বেশ কয়েকটি পুরস্কারের ঘোষণা এসেছে সাফজয়ী মেয়েদের জন্য। বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড ৫০ লাখ টাকা দিতে চাওয়ার কথা জানিয়েছে।

বাফুফে সহসভাপতি আতাউর রহমানও নারী ফুটবল দলকে ৫০ লাখ টাকা আর্থিক পুরস্কারের ঘোষণা দিয়েছেন। বুধবার মেয়েদের বরণ করতে হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে গিয়ে সংবাদমাধ্যমের সামনে এ ঘোষণা দেন তিনি। এছাড়া সিনিয়র সহসভাপতি আব্দুস সালাম মুর্শেদীও ৫০ লাখ টাকা পুরস্কারের ঘোষণা দিয়েছেন।

অন্যদিকে বিজয়ী দলে থাকা খাগড়াছড়ির তিন খেলোয়াড় এবং একজন সহকারী কোচকে ১ লাখ টাকা করে মোট ৪ লাখ টাকা পুরস্কার দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে জেলা প্রশাসন। সোমবার খাগড়াছড়ি জেলা প্রশাসক প্রতাপ চন্দ্র দাশ বিশ্বাস এ ঘোষণা দেন।

দলের গোলরক্ষক রুপনা চাকমাকে সরকারের পক্ষ থেকে বাড়ি তৈরি করে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বুধবার রাঙামাটি জেলা প্রশাসক মো. মিজানুর রহমান গণমাধ্যমকে এতথ্য নিশ্চিত করেছেন।

চারদিক থেকে এভাবে পুরষ্কারের ঘোষণা আসলেও বাফুফে ‘টাকার অভাবে’ কিছু দিতে পারছে না বলে জানিয়েছেন সভাপতি কাজী সালাউদ্দিন, ‘‘বাফুফে মেয়েদের জন্য সব করবে। কিন্তু ব্যক্তিগত সাহায্য এই মুহূর্তে করতে পারছি না। কারণ আপনারা সবাই জানেন, আমাদের কাছে টাকা নেই।’’

‘‘তবে এরই মধ্যে আমার দুই ভাইস প্রেসিডেন্ট ৫০ লাখ করে মোট এক কোটি টাকা দিয়ে দিয়েছেন। বাইরের থেকে যে টাকাই আসবে ৩১ সদস্যের দলকে সমান ভাগে ভাগ করে দেওয়া হবে। দশটাকাও রাখবো না। সব টাকাই খেলোয়াড়দের দিয়ে দেব।’’

XS
SM
MD
LG