বাংলাদেশে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার হাস বলেছেন, “মিয়ানমারের বর্তমান পরিস্থিতি, বিশেষ করে সাম্প্রতিক ঘটনার পর বিরাজমান পরিস্থিতি, দুর্ভাগ্যবশত রোহিঙ্গাদের জন্মস্থান রাখাইন রাজ্যে তাদের নিরাপদ, স্বেচ্ছায়, মর্যাদাপূর্ণ বা টেকসই প্রত্যাবর্তনের অনুমতি দেয় না।”
পিটার হাস বলেন, “দুঃখজনকভাবে, খুব শিগগিরই তাদের প্রত্যাবাসন হবে বলে মনে হচ্ছে না।”
বৃহস্পতিবার (২৯ সেপ্টেম্বর) রাজধানীর একটি হোটেলে ফ্রেডরিখ-এবার্ট-স্টিফটাং (এফইএস) বাংলাদেশের সহযোগিতায় সেন্টার ফর গভর্নেন্স স্টাডিজ (সিজিএস) আয়োজিত ‘মিট দ্য অ্যাম্বাসেডর’ অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রদূত এ কথা বলেন।
অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন সিজিএস-এর নির্বাহী পরিচালক জিল্লুর রহমান। বক্তব্য দেন জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন এবং সিজিএস -এর চেয়ারম্যান মঞ্জুর এ চৌধুরী ও এফইএস বাংলাদেশের আবাসিক প্রতিনিধি ফেলিক্স কোবিজ।
রাষ্ট্রদূত পিটার হাস বলেন, “জরুরি প্রতিক্রিয়া থেকে আরও টেকসই অবস্থায় উত্তরণে, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের সঙ্গে কাজ করতে প্রস্তুত। আমরা বাংলাদেশ সরকার এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক দাতা সম্প্রদায়ের সঙ্গে কাজ করতে চাই। যাতে শরণার্থীদের শিক্ষা ও জীবিকা অর্জনের আরও ভালো সুযোগ সৃষ্টি হয় এবং ক্যাম্পগুলোতে আরও বেশি নিরাপত্তা প্রদান করা যায়।”
তিনি আরও বলেন, “বাংলাদেশ রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মানবিক সুরক্ষার জন্য আন্তর্জাতিক মানদণ্ড পূরণ করে। আর মিয়ানমারে নিরাপদ, স্বেচ্ছায় এবং মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবর্তন সম্ভব না হওয়া পর্যন্ত, তাদের আতিথেয়তা অব্যাহত রাখবে।”
রাষ্ট্রদূত হাস বলেন, “বাংলাদেশ রোহিঙ্গা শরণার্থীদের স্বাগত জানিয়ে আশ্রয় দেয়ার ক্ষেত্রে অবিশ্বাস্য উদারতা ও সহানুভূতি দেখিয়েছে। বাংলাদেশের ওপর যে আর্থিক বোঝা চেপেছে, আমরা সে বিষয়ে সচেতন।”
এই আতিথেয়তার সমর্থনে রাষ্ট্রদূত হাস বলেন, “যুক্তরাষ্ট্র গত সপ্তাহে ঘোষণা দিয়েছে যে, তারা রোহিঙ্গা শরণার্থী এবং বাংলাদেশি আপ্যায়নকারী সম্প্রদায়কে সহায়তার জন্য অতিরিক্ত ১৭ কোটি ডলার দেবে। এই নতুন অর্থায়নে, রোহিঙ্গা শরণার্থী সংকটে যুক্তরাষ্ট্রের মোট সহায়তা প্রায় ১৯০ কোটি ডলারে পৌঁছেছে।”
রাষ্ট্রদূত হাস বলেন, “আমরা এই প্রয়াসে সহযোগিতা করেছি এই আশায় যে, রোহিঙ্গারা শিগগিরই নিরাপদ ও মর্যাদাপূর্ণ ভাবে তাদের জন্মভূমিতে ফিরে যেতে পারবে।”
উল্লেখ্য,কক্সবাজার ও ভাসানচর দ্বীপে ১১ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়েছে বাংলাদেশ।
র্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞার পর বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড কমেছেS
পিটার হাস বলেন, “র্যাব এবং এর সাত সাবেক ও বর্তমান কর্মকর্তার বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার উদ্দেশ্য তাদের শাস্তি দেওয়া নয় বরং আচরণ পরিবর্তন করে তাদের জবাবদিহি নিশ্চিত করা।”
যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত আরও বলেন, “সহিংসতা থাকলে শান্তিপূর্ণ ও অবাধ নির্বাচন সম্ভব নয়। তিনি বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচনের ওপর জোর দেন এবং সাম্প্রতিক রাজনৈতিক সহিংসতার বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন।
রাষ্ট্রদূত পিটার হাস বাণিজ্য, শ্রম অধিকার, আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক রাজনীতি এবং ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলসহ বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করেন।
রপ্তানিমুখী শিল্পে, কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি করেছে উল্লেখ করে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত বলেন, “শ্রম অধিকারের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের এখনও উদ্বেগ রয়েছে।”
যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা ও র্যাব
উল্লেখ্য, গত বছরের ১০ ডিসেম্বর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে র্যাবের সাবেক ও বর্তমান সাত কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয় যুক্তরাষ্ট্র। দেশটির ট্রেজারি ডিপার্টমেন্ট ও পররাষ্ট্র দপ্তর পৃথকভাবে এই নিষেধাজ্ঞা দেয়। এই কর্মকর্তাদের মধ্যে র্যাবের সাবেক মহাপরিচালক এবং বাংলাদেশ পুলিশের বর্তমান আইজিপি বেনজীর আহমেদও রয়েছেন। এরই মধ্যে তার আমেরিকান ভিসাও বাতিল করা হয়েছে। এ ছাড়া র্যাবের বর্তমান মহাপরিচালক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন, অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশনস) খান মোহাম্মদ আজাদ, সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশনস) তোফায়েল মোস্তাফা সরোয়ার, সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশনস) মো. জাহাঙ্গীর আলম ও সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশনস) মো. আনোয়ার লতিফ খানের ওপরও নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি ডিপার্টমেন্ট। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর পৃথক এক ঘোষণায় বেনজীর আহমেদ এবং র্যাব ৭–এর সাবেক অধিনায়ক মিফতাহ উদ্দীন আহমেদের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি বিভাগের প্রকাশিত বিবৃতিতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব), মাদক দ্রব্যের বিরুদ্ধে সরকারের লড়াইয়ে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য অভিযুক্ত। এতে বলা হয়েছে যে, তারা আইনের শাসন, মানবাধিকারের মর্যাদা ও মৌলিক স্বাধীনতা এবং বাংলাদেশের জনগণের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিকে ক্ষুণ্ন করে। এটি যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা স্বার্থের বিরুদ্ধে হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। র্যাব হচ্ছে ২০০৪ সালে গঠিত একটি সম্মিলিত টাস্ক ফোর্স। তাদের কাজের মধ্যে রয়েছে অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, অপরাধীদের কর্মকান্ড সম্পর্কে গোপন তথ্য সংগ্রহ এবং সরকারের নির্দেশে তদন্ত পরিচালনা করা।
বিবৃতিতে আরও বলা হয়, বাংলাদেশের বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো বা এনজিওদের অভিযোগ হচ্ছে যে, র্যাব ও বাংলাদেশের অন্য আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, ২০০৯ সাল থেকে ৬০০ ব্যক্তির গুম হয়ে যাওয়া এবং ২০১৮ সাল থেকে বিচার বহির্ভূত হত্যা ও নির্যাতনের জন্য দায়ী। কোনো কোনো প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে, এই সব ঘটনার শিকার হচ্ছে বিরোধী দলের সদস্য, সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মীরা।