অ্যাকসেসিবিলিটি লিংক

পশ্চিমা পোশাক পরিধানে বিড়ম্বনার শিকার যারা


ঢাকার বাইরে একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছেন নাফিদা নওরীন। দৈনন্দিন জীবনে দৌড়ঝাঁপের জন্য তিনি প্যান্ট, ফতুয়া, পাঞ্জাবি, শার্ট, শর্ট লেংথের টপসে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। সালোয়ার কামিজ পরলেও খুব আলগোছে ওড়না নেন। শাড়ি পরলেও যেভাবে তিনি আরামবোধ করেন সেভাবেই পরেন। পোশাকের কারণে লোকজনের কাছ থেকে বিচিত্র সব ব্যবহার পান বলে জানালেন। বললেন, “পশ্চিমা পোশাকে পরিধানের কারণে অনেকেই অত্যন্ত সহজলভ্য বলে বিচার করতে চান। অনেকেই মনে করেন, আমি যে কারো সাথে 'বিছানায় যেতে' রাজি হয়ে যাব। অনেক সময় নিতান্ত অপরিচিত মানুষও একটু বেশিই খাতির জমানোর চেষ্টা করে থাকেন। তারা মনে করেন, আমি যেহেতু পশ্চিমা ধাচের পোশাক পরি তাই আমার সাথে অস্বস্তিকর আদিরসাত্মক কথাবার্তা বলাই যায়! স্বল্প পরিচিত মানুষও অযথাই কফির দাওয়াত দিতে চায়, একা আড্ডা দিতে চায়।” বললেন, “ইদানীং নতুন উপদ্রব যুক্ত হয়েছে- আমার সাথে অনেকেই ঘুরতে যেতে চান! কফির দাওয়াত দেয়াই যায়, কিন্তু এদের টোন খুব বাজে।” তার পোশাক দেখে অনেকেই অযাচিতভাবে যৌনইঙ্গিতপূর্ণ কথাবার্তাও বলতে চায় বলে জানান তিনি। এমনকি তার সহকর্মীদের সঙ্গীরাও তাকে অনলাইনে এবং অফলাইনে নানান রকম বাজে কথা বলেছে ও যৌনপ্রস্তাব দিয়েছে। নওরীন তাদের প্রস্তাবে না করে দিলে তাদের মন্তব্য ছিল “তোমার পোশাক-আশাক দেখে তোমাকে অনেক লিবারেল, অনেক স্বাধীনচেতা ভেবেছিলাম। কিন্তু তুমি তো তা নও।” নওরীন বললেন, সবচেয়ে ভয়াবহ ব্যাপার হলো, “অনেকেই আমার মায়ের কাছে মন্তব্য করেছে যে, "আমি নেশা করি, কারণ এমন পোশাক পরি। এমনকি আমি নাকি পতিতাবৃত্তির সাথে জড়িত তাই এসব পোশাক পরি।"

কলেজ শিক্ষার্থী নওশীন জানালেন তার অভিজ্ঞতার কথা, “ঘটনা তো বাসা থেকে বের হইলেই কমবেশি ফেইস করতে হয় এবং সব লেভেল থেকেই। আমি একাদশে পড়ি, বেশি দূরে কোথাও গেলে গার্জিয়ান সাথেই যায়, ম্যাক্সিমাম সময়। তারপরও দেখা যায় ওড়না না নেওয়ার কারণে বা সাধারণ টপ, শার্ট প্যান্ট কিংবা টি শার্ট পড়লেও রাস্তাঘাটে বাজে মন্তব্য ছুঁড়ে দেয়। যেমন ফুটপাত দিয়ে হাঁটতেসি, কেউ একজন পাস করে গেল, যাওয়ার সময় খুব বাজে কিছু একটা বলে চলে যায়। একবার এক রিকশাওয়ালা রিকশা চালায় চলে যাচ্ছে, খুব বিকৃত মুখভঙ্গি করে গালি দিয়ে চ্যাঁচায় বলে উঠসে, বের করে দেখা। বলে রিকশা চালায় চলে গেসে। অনেক সময় আমার আম্মু থাকে সাথে, অনেক সময় থাকেনা। আবার আমি এক জায়গায় প্রাইভেট পড়ি, তো সেখানে ছেলেদের গার্জিয়ানরা মিলে আমার আম্মুকে খুব চাপাচাপি করে যে কেন আমি ওড়না পরিনা, এরপর একদিন সরাসরি আমাকেই বলসে। তো ড্রেস আপ নিয়ে ঐ প্রাইভেটেই আরেকটা মেয়েকে ডেকেও বাজে মন্তব্য করসিল কোনো এক গার্জিয়ান। এরকম পরপর কিছু অভিযোগ যাওয়ার পর টিচার সেখানে সিসিটিভি ক্যামেরা লাগাইসে এবং গার্জিয়ানদের বলে দিসে এসব করা যাবেনা। আবার স্কুল কলেজেও কখনো যদি আউট ড্রেসে যাইতে হয়, দেখা যায় খুব ডিসেন্ট ড্রেস আপ কিন্তু কেন সালোয়ার কামিজই পরি নাই সেটা নিয়েও পিটি টিচাররা অনেক বাজে বিহেভ করেন।

ফরচুনেটলি আমি কখনো খুব বড় রকমের কোনো অসুবিধা বা হয়রানির সম্মুখীন হই নাই। আগে যখন ছোট ছিলাম তখন লোকাল বাস, ট্রেনে চড়তে হইতো, তো আমি এসব ইনসিডেন্ট ছোট থেকেই কমবেশি ফেস করসি। সেটা শুধু ড্রেস আপের কারণেই না। কিন্তু ইদানীং রাস্তাঘাটে এসব ইনসিডেন্ট মনে হয় অনেক বেড়ে গেসে। প্রায় প্রতিদিনই কিছু না কিছু হয় বের হইলে। আর এখন যেহেতু বেশিরভাগ সময়ই ওয়েস্টার্ন পরে চলাফেরা করি, আরো সবদিক থেকে কথা আসে।”

চট্টগ্রামের তুষি এখন পড়াশোনা করছেন ভারতের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে। তিনি জানালেন তার অভিজ্ঞতার কথা। পূজার সময় ক্রপ টপ আর জিন্স পরে বন্ধুর সাথে ঘুরতে বের হয়েছিলেন তুষি। মেট্রোতে ওঠার সময় এক পুরুষ ইচ্ছা করেই তার পেট বরাবর গুঁতো মারে। সিট থেকে উঠে দাঁড়ানোর সময় তার ক্রপ টপ কিছুটা উপরে উঠে গেলে বেশ কয়েকজন বয়স্ক পুরুষ তার পেটের দিকে 'ড্যাবড্যাব করে' তাকিয়ে ছিল, বললেন। এছাড়াও তার ঢাকা ভ্রমণের গল্প শুনুন তার ভাষাতেই, “গত নভেম্বরে একটা মিডি ফ্রক পরে দেওয়ান বাসে উঠসিলাম শাহবাগ যাওয়ার জন্য। ইঞ্জিন সিটে বসছিলাম আর কোথাও জায়গা না পেয়ে। ওই সময় আমার পাশে বসা এক লোক আমার হাঁটুতে হাত রেখে জোরে একটা চাপ দেয়, আমি সেখানেই ওকে একটা ঘুষি দিই। পরে রাস্তার মাঝখানে অনেক চিল্লাচিল্লি করার পর ওই লোককে বাস থেকে নামিয়ে দেওয়া হয়। তারপর যতদূর রাস্তা আমি আসছি ততদূর আমাকে পেছন থেকে শুনতে হইসে যে আমি এরকম জামা পরে বাসে উঠলে এসব তো ঘটবেই। ইভেন ড্রাইভার অবধি আমাকে উপদেশ দিসিলো যে এসব পরে যেনো বাসে না উঠি!” তুষি বেশ খেদের সাথেই জানান, “এসবের শেষ নাই। আরো জঘন্য ঘটনার মুখোমুখি হতে হইসে। বিষয়গুলো কেমন যেন রেগুলার রুটিনের মতো মনে হয় এখন।”

শুধুমাত্র গণপরিবহনেই একজন নারীকে এমন ভয়াবহ অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়- এমনটা মনে করার কোনো কারণ নেই। মেডিকেল শিক্ষার্থী সাইমা জানান, গণপরিবহনের নানান ঝামেলা এড়াতে তিনি রাইড শেয়ারিং অ্যাপস ব্যবহার করে থাকেন। তেমন একটি রাইড শেয়ারিং অ্যাপের একটি কারের ড্রাইভার তাকে জিন্স আর টপস পরিহিত দেখে খুব বিশ্রিভাবে জিজ্ঞেস করে যে, তিনি বারে যান কিনা। এমনকি তার কাছে সিগারেট আছে কিনা তাও জিজ্ঞেস করেন ঐ ড্রাইভার। থাকলে তাকেও একটা দিতে বলেন। এরপর ড্রাইভারের আরও ইঙ্গিতপূর্ণ কথাবার্তায় অনিরাপদ বোধ করলে সায়মা তার এক বন্ধুকে ফোন করেন। রাইড শেষ হবার আগেই মাঝপথে এক জায়গায় নেমে যান তিনি। পরে ওই রাইড শেয়ারিং অ্যাপের কর্তৃপক্ষের কাছে তিনি এ নিয়ে অভিযোগ জানান।

রাস্তায় শার্ট-প্যান্ট পরে হেঁটে যাওয়ার সময় ৫৫-৬০ বছর বয়সী একজন প্রবীণ ব্যক্তির দ্বারা হয়রানির শিকার হন বলে জানান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সুমাইয়া।

পশ্চিমা পোশাক পরা নিয়ে সমাজের দৃষ্টিভঙ্গির কথা জানান একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সাবেরা মেমী। তিনি জানান, “পুরুষের খারাপ দৃষ্টি তো আছেই, এমনকি কাছের মানুষেরাই সমাজের দোহাই দিয়ে মোর‌্যাল পুলিশিং করে। তারপরেও দেখা যায় একটু ছোট পোশাক পরলে কিছু মানুষের ধারণা হয় ছোট পোশাক পরে মানেই মেয়েটা সহজলভ্য। তাকে ক্যাজুয়ালিই বিছানায় নেয়া যাবে।” এধরণের মনোভাবের পুরুষের কাছ থেকে যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন বলেও জানান তিনি। আশেপাশে অনেক মেয়েদেরও দৃষ্টিভঙ্গি হলো, যেহেতু তিনি পশ্চিমা পোশাক পরেন সেহেতু তার শারীরিক চাহিদা অনেক বেশি। পুরুষের দৃষ্টি বেশি বেশি আকর্ষণ করার জন্যই তিনি পশ্চিমা পোশাক পরেন। তিনি বলেন, “যারা যা ভাবে ভাবুক, আমার এই পোশাকে আরাম লাগে।”

শুধুমাত্র পরিবার, সমাজ, রাস্তাঘাটেই নারীদের এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয় তা নয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী তিথি জানান, দ্বিতীয় বর্ষে পড়াকালীন বিভাগের একজন শিক্ষক তাকে অফিসরুমে ডেকে নিয়ে গিয়ে পশ্চিমা পোশাক পরতে নিষেধ করেন। উক্ত শিক্ষকের বক্তব্য ছিল, বিভাগের ছাত্রীরা পশ্চিমা পোশাক পরলে ছাত্ররা আজেবাজে মন্তব্য করে।

একটি বেসরকারি সংস্থায় কর্মরত আছেন মিফতাহুল। তিনি সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি বিষয় জানান। বলেন, “নারীর পশ্চিমা পোশাক পরিধানের প্রতিক্রিয়ার ব্যাপারটি কেবল যৌন আক্রমণেই সীমাবদ্ধ নয়। কোনো পশ্চিমা পোশাকে রাস্তায় বেরুলে পুরুষের ধমকপূর্ণ এক ধরণের দৃষ্টিরও মুখোমুখি হতে হয় আমাদের। যেন তারা দৃষ্টি দিয়ে নারীকে ভষ্ম করে দিতে চান। তাদের চাহনি অনেকটা এরকম থাকে যে, তাদের অর্থাৎ পুরুষের অনুমোদন না থাকা সত্ত্বেও আমি এ ধরনের পোশাক পরে রাস্তায় বের হয়েছি কেন। তারা যেন নারীর এরূপ ঔদ্ধত্যের উৎস জানতে চান।”

এই যে নারীর পোশাক দিয়ে নারীর চরিত্র মেপে ফেলার বিষয়টি- এর পেছনে কয়েক প্রকারের কারণ বিদ্যমান বলে মনে করেন মিফতাহুল। তার মতে, নারীর প্রতি পুরুষের অন্তর্গত বিদ্বেষ একটি বড় কারণ। তিনি বলেন, “আমাদের সমাজ নারীকে মানুষ হিসেবে বিবেচনা না করে শুধুমাত্র একটি ভোগ্যবস্তু হিসেবে বিবেচনা করতে অভ্যস্ত। কোনো নারীর যদি নিজস্ব মতামত এবং পছন্দ-অপছন্দ গড়ে ওঠে এবং তা সামাজিকভাবে প্রদর্শিত হয়, তাহলে পুরুষেরা নিজেদের অস্তিত্বকে হুমকির মুখোমুখি বলে মনে করেন। এছাড়া পশ্চিমা পোশাক মানেই সমাজের চোখে ভাসে পশ্চিমা দেশ অর্থাৎ তাদের ভাষায় ‘ফ্রি সেক্সের দেশ’ যেখানে শারীরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে কোনো 'বাছবিচার' নেই। তাই যেসব নারী পশ্চিমা পোশাক পরেন তাদেরও শারীরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে কোনো পছন্দ-অপছন্দ থাকে না বলে সমাজের বেশিরভাগ পুরুষের ধারণা।” এছাড়া নারী যে নিজের ইচ্ছায়, শুধুমাত্র নিজের ভালো লাগার জন্য এ ধরনের পশাক পরতে পারেন তা এদেশীয় পুরুষদের মানতে কষ্ট হয় বলে মনে করেন তিনি। তার মতে, এদেশের বেশিরভাগ পুরুষের ধারণা, নারী এ ধরনের পোশাক পরে শুধুমাত্র পুরুষকে প্রলুব্ধ করার জন্য। এজন্যই এমন পোশাক যে নারীরা পরেন তারা ভালো মেয়ে নন বলে মনে করেন সমাজের সিংহভাগ পুরুষ।

বিভিন্ন দেশে নারীর পোশাক নিয়ে আক্রমণ ও নিষেধাজ্ঞা

ইরানঃ গত ১৬ সেপ্টেম্বর ইরানে মোর‌্যাল পুলিশের হেফাজতে বাইশ বছর বয়সী কুর্দি তরুনী মাসা আমিনীর মৃত্যুর ঘটনায় দেশটিতে শুরু হয় বিক্ষোভ। মাসা আমিনীকে গত ১৪ সেপ্টেম্বর ঠিকঠাক হিজাব না পরার অভিযোগে গ্রেপ্তার করে ইরানের মোর‌্যাল পুলিশ। অভিযোগ উঠেছে, পুলিশি হেফাজতে থাকাকালীন তাকে মারধোর করায় তিনি মাথার খুলিতে আঘাতপ্রাপ্ত হন এবং ব্রেনডেড হয়ে পড়েন। ১৬ সেপ্টেম্বর তিনি মারা গেলে তার জানাজার পরেই বিক্ষোভ শুরু হয়। বিক্ষোভ দাবানলের মতো ছড়িয়ে পরে পুরো ইরান জুড়েই। শত শত মানুষ হতাহত হয়েছেন, হাজার হাজার বিক্ষোভকারীকে আটক করা হয়েছে। ইরানি মানবাধিকার গোষ্ঠী এইচআরএএনএ-এর তথ্য অনুসারে, দেশটির ১১২টি শহরে এবং শহরের ৪২৮টি রাস্তা ও বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিবাদ সমাবেশ হয়েছে। মাসা আমিনী নিহত হওয়ার পর স্কুলের শিশুরাও জোরপূর্বক হিজাবের প্রতিবাদ করছে। এরই মধ্যে অজানাসংখ্যক স্কুলছাত্রীকে আটক করে ‘মনস্তাত্ত্বিক’ পুনর্বাসন কেন্দ্রে পাঠানো হয়েছে। এ প্রতিবেদন লেখা পর্ন্ত শিশুসহ দুই শতাধিক সাধারণ মানুষ মারা গেছেন। এদিকে বিশ্বের অনেক দেশেই চলমান এ বিক্ষোভকে সমর্থন জানিয়ে সমাবেশ হচ্ছে। ইরানি বংশোদ্ভূত হলিউড তারকা ‘লর্ড অফ দ্য রিং: দ্য রিংস অফ পাওয়ার’-এর অভিনেত্রী ও অ্যাকটিভিস্ট নাজানিন বোনিয়াদি লস অ্যাঞ্জেলসে প্রায় ২০ হাজার মানুষের এক সমাবেশে নেতৃত্ব দিয়েছেন। সমাবেশে তিনি বিক্ষোভকারী নারীদের প্রতি সংহতি জানান।

ভারতঃ এর আগে এ বছরের ফেব্রুয়ারি মাসের শুরুতে ভারতের কর্নাটক রাজ্যে হাইস্কুল ও কলেজে মুসলিম মেয়েদের হিজাব পরে ক্লাসে আসা নিষিদ্ধ করা, আর এ নিয়ে হিন্দুত্ববাদীদের সাথে সংঘাতকে কেন্দ্র করে সারা ভারত উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। কর্নাটক রাজ্যের সেই বিক্ষোভ পশ্চিমবঙ্গসহ দেশটির নানা জায়গায় তখন ছড়িয়ে পড়ে। সে সময় অনলাইনে ভাইরাল হয় একটি ভিডিও - যাতে দেখা যায় কর্নাটক রাজ্যের এক কলেজে কালো বোরকা আর হিজাব পরা এক মুসলিম ছাত্রীকে 'জয় শ্রীরাম' বলে শ্লোগান দিয়ে হয়রানি করছে গেরুয়া কাপড়-ধারী একদল হিন্দুত্ববাদী তরুণ। আর ছাত্রীটিও (মুসকান খান) তাদের পাল্টা জবাব দিচ্ছে 'আল্লাহু আকবর' শ্লোগান দিয়ে। ভারতের সুপ্রিম কোর্টের দুইজন বিচারকের সমন্বয়ে গঠিত একটি বেঞ্চ গত ১৩ অক্টোবর মুসলিম শিক্ষার্থীরা শ্রেণিকক্ষে হিজাব পরতে পারবেন কিনা তা নিয়ে পরস্পরবিরোধী মতামত প্রকাশ করেছে। তাই বিষয়টি এখন নিষ্পত্তির জন্য তিন বা ততোধিক বিচারপতির বৃহত্তর বেঞ্চের সামনে উপস্থাপন করা হবে।

আবার এ বছরের আগষ্ট মাসের শুরুতে প্রকাশ্যে আসে ভারতের কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স ইউনিভার্সিটির এক সাবেক সহকারী অধ্যাপকের সঙ্গে ঘটে যাওয়া একটি ঘটনা, যে ঘটনাটি আসলে ঘটেছিলো ২০২১ সালের অক্টোবর মাসে। ঘটনাটি এমন, ইনস্টাগ্রামে সংশ্লিষ্ট শিক্ষিকার সাঁতারের পোশাক পরা ছবি দেখতে পান ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্র। সেই ছবি নিয়ে আপত্তি তোলেন ছাত্রের বাবা। লিখিত অভিযোগ করেন বিশ্ববিদ্যালয়ে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ নেটমাধ্যমে দেওয়া তার ছবিগুলি ‘আপত্তিকর’ এবং ‘অনুপযুক্ত’ বলে মনে করেন এবং ছবির কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘বদনাম’ হচ্ছে মনে করেন। সে কারণেই তাকে ইস্তফা দিতে বাধ্য করা হয়েছে; বলেন ওই শিক্ষিকা। যদিও বিশ্ববিদ্যালয়ের দাবি, ওই শিক্ষিকা নিজেই ইস্তফা দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে চলে গিয়েছেন। বিষয়টি প্রকাশ্যে আসার পরই শুরু হয় প্রতিবাদের ঝড়।

ফ্রান্সঃ ফ্রান্স সরকার ২০০৪ সালে সব সরকারি স্কুলে মুসলমান মেয়েদের হিজাব এবং অন্যান্য ধর্মীয় পরিচয় বহনকারী পোশাক নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। ফলে বহু মুসলিম মেয়ের স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়ে যায় এবং এ নিয়ে বিতর্ক, বিক্ষোভ চলতে থাকে দীর্ঘদিন। এরপর ২০১৬ সালে জাতিসংঘে অভিযোগ দাখিল করেন এক ফরাসি নারী। অভিযোগটি ছিলো, ২০১০ সালে প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য একটি পেশাদার প্রশিক্ষণ কোর্সে অংশ নেয়ার কথা ছিলো তার। কিন্তু তিনি ধর্মীয় পোশাক পরে থাকার কারণে হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক তাকে স্কুলে ঢুকতে দেননি। সেই অভিযোগের ভিত্তিতে গত ৩ আগষ্ট জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিটি বলেছে, ফ্রান্স বেসামরিক নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার বিষয়ক আন্তর্জাতিক চুক্তি লঙ্ঘন করেছে।

সুইজারল্যান্ডঃ বোরকা পরার ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে সুইজারল্যান্ড সরকার। নিষেধাজ্ঞা অমান্য করলে এক হাজার ডলার জরিমানা করা হবে এরকম একটি নতুন স্বিদ্ধান্তের খসড়া পার্লামেন্টে পাঠিয়েছে সুইস সরকার। ঘটনাটি এই অক্টোবরের শুরুর দিকের। গত বছর সুইজারল্যান্ডে মুখ ঢাকা বা বোরকা নিষিদ্ধ নিয়ে গণভোট হয়, যেখানে ৫১.২ ভাগ মানুষ এর পক্ষে ভোট দেয়।

বাংলাদেশঃ বাংলাদেশে এ বছরের ১৮ মে পোশাক নিয়ে ঘটে যায় আরেকটি ঘটনা। ঢাকা থেকে বেড়াতে আসা এক তরুণীকে নরসিংদী রেলওয়ে স্টেশনে ‘শালীন পোশাক’ না পরার অভিযোগে এক নারী এবং কয়েকজন পুরুষ মিলে লাঞ্ছিত করে। এ ঘটনার একটি ভিডিও একদিন পর ফেসবুকে ছড়িয়ে পরে। ভিডিওতে দেখা যায়, তরুনীর পরনে জিনস ও স্লিভলেস টপস। তাকে একদল লোক ঘিরে রেখেছে। তারা উত্তেজিতভাবে কথা বলছে। একপর‌যায়ে তরুণীর পোশাক ধরে এক নারী টানা-হেঁচড়া শুরু করে। তাকে অশ্লীল গালিগালাজ করে। একজন তরুণ তাকে নিরাপত্তা দেয়ার চেষ্টা করছিলেন, আরো কয়েকজন ব্যক্তির সহায়তায় তিনি স্টেশনমাস্টারের কক্ষে ঢুকে নিজেকে রক্ষা করেন। এ সময় তার সাথে থাকা দুই তরুণকেও মারধোর করে উত্তেজিত কয়েকজন। পরে পুলিশের সহায়তায় তারা ঢাকাগামী ট্রেনে ওঠেন। এ ঘটনায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তীব্র নিন্দার ঝড় ওঠে। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ১০ ও ৩০ ধারায় ভৈরব রেলওয়ে থানায় মামলা হয়। তরুণীকে হেনস্তার ঘটনায় জড়িত সেই নারী মার্জিয়া আক্তার ওরফে শিলাকে (৬০) ২৯ মে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। ১৬ আগস্ট শিলা হাইকোর্টে জামিন পান।

মতামত

শুধুমাত্র শরীর ঢাকবার জন্যই নয়, নিজেকে সুন্দরভাবে উপস্থাপনের জন্যও মানুষ পোশাক পরে। নারী পুরুষ সবারই পছন্দের পোশাক বেছে নেওয়ার অধিকার রয়েছে। অথচ বারবার নারীর পোশাক নিয়ে বিতর্ক, সমালোচনা হচ্ছে, নারীকে পড়তে হচ্ছে বিড়ম্বনায়। নারীর ওপর পোশাক আরোপিত হয়েছে। শুধু বাংলাদেশ নয়, পৃথিবীর বেশ কিছু দেশেই সাম্প্রতিক সময়ে নারীর পোশাক নিয়ে নানান বিতর্ক, নানান আইন দেখা যাচ্ছে, রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপ দেখা যাচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে ইরানের মাসা আমিনীর মৃত্যুর ঘটনায় পোশাক বিতর্ক ও এর প্রতিক্রিয়া প্রকট রূপ নিয়েছে। এ বিষয়গুলো নিয়ে ভয়েস অফ আমেরিকা কথা বলেছে নারী অধিকার নিয়ে কাজ করছেন এমন কয়েকজনের সঙ্গে। তারা জানিয়েছেন তাদের ভাবনা ও মতামত

সেলিনা হোসেন, কথাসাহিত্যিক

একটা পরিমিতবোধের মধ্যে থেকে যে কোনো পোশাক যদি সুন্দরভাবে পরা হয় সেটা ওয়েস্টার্ন হোক কিংবা দেশি পেশাক সেটা নিয়ে নারীকে অবমাননাকর কথা বলার অধিকার কারো নেই। নারী কী পোশাক পরবে সেটা নিয়ে অন্য কেউ কথা বলতে পারে না। এটা উচিতও না। নারী তো এর আগেও জিনসের প্যান্ট পরেছে, টি শার্ট পরেছে। তখন তো কেউ কিছু বলেনি। এখন যেটা হচ্ছে এটা হলো একটা সামাজিক অপারগতা। নারীকে নানাভাবে অবদমিত করে রাখার জন্য এই সামাজিক অপপ্রচারটা খুবই ন্যাক্কারজনক। বারবার পোশাক নিয়ে কথাবার্তা বলাটা সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয়। পোশাক নিয়ে কোনো রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা বা কোনো সংগঠন বা ব্যক্তি কথা বললে, নারীর উপর পোশাক চাপিয়ে দেওয়া হলে সেটা শুধু নারী হিসেবে নয় বরং মানুষ হিসেবেই অপমানজনক। একজন মানুষ সচেতনভাবেই তার পোশাক পছন্দ করা ও পরবার অধিকার রাখে। সেখানে একজন নারীর ইচ্ছেটাকে বাতিল করে দেয়া কিংবা সে কী পরবে, কীভাবে পরবে তা নির্ধারণ করে দেওয়ার অধিকার অন্য কেউ রাখে না।

শাহানা হুদা রঞ্জনা, সিনিয়র কোঅর্ডিনেটর, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন

পোশাকটা সম্পূর্ণই ব্যক্তির পছন্দ, নারী পুরুষ উভয়ের ক্ষেত্রেই। কিন্তু দেখেন, পুরুষের পোশাক নিয়ে কোনো কথা হচ্ছে না। শুধু নারীর পোশাকটাকেই বেছে নেয়া হয়েছে। এটার ওপরে অন্যের মতামত চাপানো হচ্ছে। ইরানে পোশাকের উপরে, নারীর উপরে যে অত্যাচার চলে আসছে, এটা খোমেনি আসার পর থেকে। এই মোল্লাতন্ত্রের বিরুদ্ধে কিন্তু এরা তখন থেকেই ছোট ছোট আকারে বিভিন্ন ধরণের ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলো। কিন্তু কখনও এরকম বড় আকারে এটা হয়নি। ইরানীদের অনেকেই দেশে থাকলে বোরকা ব্যবহার করেন, দেশের বাইরে গেলে স্বাধীনভাবে চলাফেরা করেন। কারণ এই জিনিসটা আসলে তারা পছন্দ করেন না। কিন্তু ওদের এই সোশ্যাল পুলিশিং এর ঘটনায় পুলিশি হেফাজতে মাসা আমিনী মারা গেলো এবং এর পরেই এটা ইরানে তীব্র আকার ধারণ করেছে। আমি বিভিন্ন জায়গায়, বিভিন্ন মিডিয়াতে এ বিষয়ে পড়ে জানলাম, এতদিন যখন নারীরা বলে এসেছে যে আমাকে আমার পোশাকের অধিকার দাও, আমাকে আমার মতো করে চলতে দাও। তখন কিন্তু পুরুষরা তাদের পাশে আসেনি। এবার কিন্তু পুরুষরাও এসে তাদের পাশে দাঁড়িয়েছে। কেন দাঁড়িয়েছে তার একটা ব্যাকগ্রাউন্ড আছে। সেটা হলো ইরানের অর্থনৈতিক অবস্থা আসলে খুব খারাপ। যার ফলে যখনই একটা পুঞ্জিভূত আন্দোলন দানা বেঁধে উঠেছে, নারী পুরুষ সবাই এখানে যোগ দিয়েছে। যে কারণে ইরানের সরকার ক্রমান্বয়ে কঠিন থেকে কঠিনতর হচ্ছে। কারণ তারা এটা মানতে পারছে না। ঠিক একই অবস্থা আমাদের বাংলাদেশের দিকে যদি তাকাই। বাংলাদেশে দশ থেকে পনেরো বছর আগেই দেখেন। আমরা দেখে এসেছি যে, নারীরা যার যার মতো পোশাক পরছে। যার ইচ্ছা মাথায় কাপড় দিচ্ছে, যার ইচ্ছা বোরকা পরছে। যার ইচ্ছা সে স্লিভলেস পরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। যার ইচ্ছা টিপ দিচ্ছে, যার ইচ্ছা দিচ্ছে না। কিন্তু বাংলাদেশের পার্সপেক্টিভে গত ষোলো-সতেরো বছর ধরে কী এমন ঘটে গেলো যে হঠাৎ করে নারীর পোশাকটাই এখানে ভাইটাল হয়ে উঠলো। একটা জিনিস জানানোর জন্য বলি, আমাদের দেশে কিন্তু হিজাব-আবায়া এগুলো ছিলো না। আশির দশকেও আমরা কিছু মেয়েদের বোরখা পরতে দেখেছি। দেখেন আমাদের আদালত একটা মন্তব্য করেছে, নরসিংদীর মেয়েটার ইস্যুতে। আমাদের আদালত তখন বলেছে যে, "এটা তো বনানী, গুলশান নয় যে এরকম পোশাক পরে বেড়াতে পারে।" এরকম হলে তাকে হেনস্থা হতে হবে, এরকম ব্যাপারটা। এবং কয়েকদিন আগে আমাদের বগুড়ার সাংসদও একই কথা বলেছেন। বলেছেন, “আমি তেতুল হুজুরকেও সাপোর্ট করি। কারণ মেয়েরা টপ, গেঞ্জি এসব পরলে মেয়েদের রেপড হতে হবে।” যদি তাই হয়, তাহলে একটা দুই মাসের শিশু, একজন পঞ্চাশ বছরের নারী, একটা হিজাব পরা মেয়ে কেনো রেপ হয়। তনু তো হিজাব পরা ছিলো, তারপর নোয়াখালীর নুসরাতকে যে অধ্যক্ষ পুড়িয়ে মারলো সে তো বোরখা পরতো। একটা দুই বছরের শিশুর কী অপরাধ? প্রচুর শিশু এখন ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। তাকে কি টি-শার্ট দেখে ধর্ষণ করছে? আচ্ছা, এটাও না হয় বাদ দিলাম। তাহলে ছেলেরা বলাৎকার হচ্ছে কেন? প্রচুর পরিমাণে বালক বলাৎকারের শিকার হচ্ছে। কেন হচ্ছে? ওরা তো ছেলে, তাহলে ওরা কেনো বলৎকারের শিকার হচ্ছে। তার মানে এই টেন্ডেন্সিটা, এই অসুস্থ প্রবণতাটা আমাদের মধ্যে ভয়ঙ্কর রকমে বেড়ে গেছে। এখানে আমি একটা উদাহরণ দিতে পারি। আমার অর্গানাইজেশন ‘মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন’ থেকে আমরা এ বছরের এপ্রিল মাসে একটা জরিপ চালিয়েছিলাম এবং গবেষণা করেছিলাম।

গবেষণাটায় আমরা আসলে দেখতে চেয়েছিলাম যে, পর্ণোগ্রাফি নারীর প্রতি সহিংসতা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে কী ভূমিকা রাখছে? এটা করতে গিয়ে অদ্ভুত কতগুলো জিনিস আমাদের চোখের সামনে ভেসে উঠলো। সেটার সাথে নরসিংদীর যে ঘটনাটা তা একেবারে চলে যায়। আমরা দেখলাম বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ বিদেশি পর্ণোগ্রাফি দেখে না। এরা দেশে নির্মিত, লোকালি মেইড যে পর্ণোগ্রাফি এগুলো দেখে। দেশি মেয়েদেরকে দেখতে এরা বেশি ভালোবাসে। সারা দেশে আমরা এ জরিপটি করেছিলাম। আমাদের সাথে DNET ছিলো। এই পর্ণোগ্রাফিতে যে মেয়েগুলো ব্যবহৃত হয়েছে, প্রত্যেকটা মেয়ে হিজাব পরা। ছবিও আছে কিন্তু আমাদের কাছে। হিজার পরার কারণ তারা তাদের চেহারাটা চেনাতে চায়নি। চেহারাটা ঢাকতে চায়। এরা কিন্তু হিজাবকে পর্দা হিসেবে না, মুখটা লুকানোর জন্য ব্যবহার করছে। কিন্তু সবচেয়ে ভয়ঙ্কর যে ব্যাপার, সেটা হচ্ছে সেই জরিপে নারী-পুরুষ উভয়েই একটা গ্রুপকে ভালো মেয়ে বলছে, একটা গ্রুপকে মন্দ মেয়ে বলছে। কাদেরকে ভালো মেয়ে বলছে? যে মেয়েগুলো সোশ্যাল মিডিয়াতে কম আসে, যে মেয়েগুলো হিজাব পরে, বোরখা পরে, যারা সহবৎ মেনে চলে তারাই হচ্ছে ভালো মেয়ে। তাহলে মন্দ মেয়ে কারা? যারা আধুনিক পোশাক পরে, যারা ওয়েস্টার্ন ড্রেস পরে, যারা বাইরে চাকরি করে, যারা রাতে ডিউটি দেয়, যারা স্পষ্ট মুখের উপরে কথা বলে এই মেয়েগুলো হলো মন্দ মেয়ে। আরো ভয়ঙ্কর ব্যাপারটা হলো যে এই মেয়েদের নানাভাবে হেয় করা যায়, তাদেরকে অপমান করা যায় এটা বিশ্বাস করে শতকরা একাশিজন উত্তরদাতা। এই উত্তরদাতারা মনে করে যে, এধরণের মেয়ে যারা পাশ্চাত্যের পোশাক পরে, আধুনিকভাবে চলাফেরা করে এরাই হচ্ছে মন্দ মেয়ে। আবার এই মন্দ মেয়েগুলোকে সমাজ কী করবে? এই মন্দ মেয়েদেরকে সমাজ চাইলে কটুক্তি করতে পারে, তির্যক মন্তব্য করতে পারে, অপমানজনক আচরণ করতে পারে। শতকরা চৌষট্টি জন মানুষ এটা মনে করে। এই উত্তরদাতাদের মধ্যে কিন্তু নারী পুরুষ উভয়েই আছে। এই যে নরসিংদীর মেয়েটাকে মারলো, এই চৌষট্টি ভাগ মানুষ কিন্তু তার মধ্যে আছে। কারণ ওরা মনে করে যখন একটা মেয়ে এভাবে পোশাক পরে বেড়াবে তাদেরকে মারা, বাজে মন্তব্য করা, সমালোচনা করা খুবই রাইট। এটা করা যায়। আমাদের একই রিসার্চে আমরা দেখেছি যে, নারীর পছন্দের পোশাকের প্রতি অন্য নারীর যে ক্ষোভ এর সাথে আসলে ধর্মের কোন সম্পর্ক নাই। এর সাথে সম্পর্ক আছে হীনতা, নীচতা এবং নিজের পরাধীন জীবন, বন্দীত্ব, যৌন ইর্ষা ও নিজের স্বামী বা ছেলেকে নিয়ে অনিরাপদ বোধ করা। এটাকে একপ্রকার internalized misogyny বলতে পারেন। ভেতরে থাকা নারীবিদ্বেষ। তার ভেতরে যে নারীবিদ্বেষটা কাজ করে সেটাকেই সে তখন দেখায়। এবং আমাদের গবেষণা এই কথাটাই বলেছে যে, এই misogyny ব্যাপারটা থেকেই নারী হয়ে তারা নারীর বিরুদ্ধে অবস্থান নিচ্ছে। এবং তারা মনে করছে যে, মন্দ মেয়ের মতো যারা আচরণ করছে, তারা অন্য ছেলেমেয়েকে নষ্ট করে ফেলবে। প্রায় আশিজন উত্তরদাতা এ কথা মনে করেন এবং এগুলো কিন্ত সব ধারণা তারা পাচ্ছে পর্ণোগ্রাফি দেখা থেকে। আমি কিন্তু শুধু আমাদের সমাজের কথা বলছি। আমাদের সমাজে ভালো মেয়ে, মন্দ মেয়েকে তারা চিহ্নিত করছে পর্ণোগ্রাফি কন্টেন্টের ভিত্তিতে।

আরো এ্যালার্মিং বিষয় হলো ফেসবুকে এখন কতগুলো গেম আছে। সেগুলোর লক্ষ লক্ষ ভিউয়ার। গেমগুলো এরকম, ‘ঐ মাইয়া’...এরকম করে আঞ্চলিক ভাষায় বলছে, “এইডা কী পইরা বেড়াইতাছস, দাঁড়া তোরে মারি” এইটা বলে ঠাস ঠাস করে মারতে শুরু করে। যে যত মেয়েকে মারতে পারবে, মেয়েকে এরকম শাস্তি দিতে পারবে তার নাম্বার তত বাড়বে। এই গেমগুলো আমাদের এখানেই তৈরি হচ্ছে এবং এত মানুষ এটা দেখছে যে এটা কল্পনা করা যায় না। ফলে আমাদের সামাজিক মাধ্যমেও পোশাক নিয়ে এ বিষয়গুলো ছড়াচ্ছে এবং নারীকে মন্দভাবে দেখানোর একটা ইমেজ তৈরি করা হচ্ছে। সেই ইমেজটা তৈরি হচ্ছে বাংলাদেশের যে লোকাল মেইড পর্ণোগ্রাফি তার উপরে ভিত্তি করে।

এখন হিজাবটা আসলে কে পর্দা করতে ব্যবহার করছে আর কে মুখ ঢাকতে ব্যবহার করছে, সেটাও রিসার্চের বিষয়। ডেইলি স্টারে আমি কিছুদিন আগে একটা রিপোর্ট দেখেছি। সেখানে বলছে সাতাশি ভাগ নারী জীবনে অন্তত একবার বিভিন্নভাবে হয়রানির শিকার হয়েছে। তাহলে কি আমরা বলব, এই শতকরা সাতাশি জন মেয়ে শুধুমাত্র পোশাকের কারণেই হয়রানির শিকার হয়েছে? তা তো না। কিছুদিন আগে, আরেকটা ঘটনা আমরা দেখি। একটা মেয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে ছবি তুলতে গিয়েছিলো। দুটো ছেলে গিয়েছিলো ছবি তুলে দিতে। মেয়েটা স্লিভলেস ব্লাউজ ও শাড়ি পরে ছবি তুলছিলো। সেজন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন নারী টিচার তাকে বলেছে, তুমি কি ন্যুডিটি করছো? তুমি তো পর্ণোগ্রাফি করছো। মেয়েটার, ছেলেটার বাবা-মাকে ডেকে এনে তাদেরকে তারা হেনস্থা করেছে। তাদেরকে এই মোর‌্যাল পুলিশিং এর দায়িত্বটা কে দিলো? পোশাককে কেন্দ্র করে নারীর উপরে এই যে একটা অত্যাচার শুরু হয়েছে এটা কোথায় গিয়ে থামবে জানি না, কারণ আমরা তো এ্যাওয়ার না। আমার কাছে এগুলো খুব ভয়ের একটা বিষয় বলে মনে হয়।

ঋতু সাত্তার, থিয়েটার এন্ড পারফরম্যান্স আর্টিস্ট

পোশাক নিয়ে প্রায় প্রতিটি ধর্মে একটা দিকনির্দেশনা আছে। এবং সবগুলো ধর্মেই কিন্তু বলা হয়েছে পুরুষ এবং নারীর শরীর ঢেকে রাখার কথা এবং এগুলো এমনভাবে রিপিটেড ... তো এখানে দীর্ঘদিনের একটা সংস্কার কাজ করে। যখন ১৯২০ সালে মেয়েরা প্রথম গাউন ছেড়ে হাঁটু পরযন্ত লম্বা স্কার্ট পরা শুরু করলো ইউরোপে। তখন কিন্তু মেয়েরা যথেষ্ট backlash এর সম্মুখীন হয়েছিলো। ব্যাপারটা অতো সহজ ছিলো না কোনোদিনই। অথবা ক্যাথলিক মেয়েরা যখন মাথায় একটা ঢাকনা দিয়ে রোববার করে চার্চে যাওয়া বন্ধ করলো, তখন কিন্তু ভয়াবহ backlash হয়েছে। আমাদের পৃথিবীটা কিন্তু গত বিশ বছর ধরে টার্ন করছে extremism এর দিকে। সাউথ এশিয়াতে যদি দেখেন, এই প্রতিটা জায়গায় আসলে ন্যাশনালিস্টিক রিলেজিয়াস ভিউটাই হচ্ছে এই রাইট উইং গভর্নমেন্টগুলার ওয়ান অফ দ্য মেইন পলিটিক্যাল ভিউস। তো সেখানে নারীর পোশাক, সে হিজাব পরবে কি পরবে না, তাকে পরতে দেয়া হবে কি হবে না এটা তো একদমই রাইট উইং ফ্যাসিস্ট গভর্নমেন্টের একটা মূল জায়গা। নারী স্বাধীনতার সাথে আমরা যখন বলি যে আমি কী পরবো, কী পরবো না সেটা আমার নিজের দায়িত্ব, ব্যাপারটা আসলে সবসময় তা না। আমি কী পরবো, কি পরবো না সেটা আসলে কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা না। এটা একটা কালেকটিভ এ্যাকশন। এখন ইরানে যে আপরাইজিংটা হয়েছে, এইটা বলা যেতে পারে যে দীর্ঘদিনের রেশ। আমি মাথায় কাপড়টা পরতে চাই কি চাই না... এক্ষেত্রে বলা যায়, আমি তো আসলে চাই, কিন্তু আপনি যখন আমার ওপরে এটা চাপিয়ে দিতে চাচ্ছেন, তখন আমি আর চাই না। ব্যাপারটা এরকম হয়ে গেছে। আমাদের দেশেও ব্যাপারটা অনেকটা এরকম। যেমন, আমি তো শাড়িই পরতে চাই। কিন্তু আপনি যখন আমাকে তা চাপিয়ে দেন, তখন আমার প্যান্ট পরতে ইচ্ছা করে। বা আপনি যখন আমাকে শাড়ি পরলে বলেন যে শাড়ি আমার পরা উচিৎ না আমার কামিজ পরা উচিত তখন আমার শুধু শাড়িই পরতে ইচ্ছা করে। ব্যাপারটা হচ্ছে চাপিয়ে দেয়া ও না দেয়া এবং আমার উপর কে চাপিয়ে দেবে, কেনো চাপিয়ে দেবে। আমি যদি বুঝি যে আমার ওপরে পোশাকের যে বাধা দেয়া হচ্ছে সে বাধাটা আসলে আমাকে সাপ্রেস করার জন্য এবং রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের জন্য; সেক্ষেত্রে আমি তো কোনোদিন সেটা এ্যাকসেপ্ট করবো না। আমি কেনো scapegoat হতে যাবো, আমি মেয়ে বলে? আমি সংগঠিত না বলে? কিন্তু এটা কেউ ভেবে দেখে না, আমি চাইলে সংগঠিত হতে আমার বেশি সময় লাগবে না।

পৃথিবীর যে কোনো দেশে নারী জাগরণ বা নারী আন্দোলন যখন হয় তখন অন্য কোণে বসা যে কোনো মেয়ের সেটা বোঝার জন্য নতুন করে ফেমিনিজম পড়তে বসতে হয় না। সে আসলে সেটা তার অস্তিত্ব দিয়ে এমনিই বোঝে। আমার এটা সবসময় মনে হয় যে, ছোট ছোট কাজগুলো দিয়েই তো বড়বড় চেঞ্জ আসে। আজকে ইরানে হচ্ছে, এর আগে ইন্ডিয়াতে হলো, তারপরে বাংলাদেশে হবে, তারপর অন্য কোনো দেশে হবে। আর বাংলাদেশের তো সিচুয়েশনটা আসলে আন্ডার অবজারভেশন। কারণ বাংলাদেশের সোসাইটি কিন্তু অনেক বড় চেঞ্জের ভেতর দিয়ে চলে যাচ্ছে, যেটা আমরা আদৌ খেয়াল করছি না বা খেয়াল করলেও ইগনোর করছি। নরসিংদীর ঘটনাটা প্রসঙ্গে যদি বলি, বাংলাদেশের রেলওয়ে স্টেশন বা বাস স্টেশন খুবই পুরুষপ্রধান এবং ওই জায়গাগুলো এত আনরেগুলাইজড, এত ধরণের ভাসমান মানুষ, ভাসমান পেশা থাকে ওখানে। তো ওইসব জায়গার পরিবেশটাই বেশ নারী অবান্ধব। এখানে বোঝার ব্যাপার আছে যে এ ধরণের জায়গাগুলোতে আসলে কী ধরণের ঘটনা ঘটতে পারে। অনেক ঘটনা আসলে ঘটে তারমধ্যে নরসিংদীর ঘটনাটা আমাদের সামনে এসেছে। তবে এই যে রেলওয়ে স্টেশন বা বাস স্টেশনের যে চিত্র তার ভেতরেও একটা কথা সত্যি যে, এই ঘটনাটা যখন ঘটলো, ঘটনাতে কিন্তু মেয়েটাকে কিছু পুরুষ রক্ষা করলো আর একজন মহিলাই কিন্তু মেয়েটাকে বেশি এ্যাসল্ট করার চেষ্টা করলেন। এটাও কিন্তু একটা বোঝার মতন ব্যাপার। এবং আমাদের মেয়েদের অন্দরমহলের শালীনতার ভার তো আজীবন মেয়েদের কাঁধেই ছিল, তবে এখন যেহেতু বহিরমহলে সকল শ্রেণির মেয়েরাই বেশি সেই চর্চা নানারকম উস্কানিতেই এমন উগ্রভাবে প্রকাশ পেতে পারে। মেয়েরা যখন মেয়েদের ওপর মোরাল পুলিশিং করার মতন জায়গায় যাচ্ছেন সেটা কি একদিনে হয়েছে?

আমাদের দেশে ‘ছতর ঢাকা’ একটা সোশ্যাল ট্যাবু। অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি পৃথিবীর বেশিরভাগ মুসলিম দেশ, ইজিপ্ট, টার্কি, ইরান, সৌদি আরবে কখনও ‘ছতর ঢাকা’ নিয়ে কোনো মেয়েকে এতো চিন্তা করতে হয়না। এখানে মেয়েরা চুল ঢাকার জন্য একটা স্কার্ফ পরে। কিন্তু আমাদের এখানে স্পেশালি বাংলাদেশে ‘ছতর ঢাকা’ একটা সোশ্যাল ট্যাবু। এটা আপনার ওয়েস্টার্ন বা ইস্টার্ন পোশাকের সাথে সম্পর্কিত না। আমাদের দেশে বডিশেইমিং এবং বডি দিয়ে ছেলেমেয়ের দূরত্ব তৈরি করে যেভাবে বাচ্চাদের বড় করা হয়; সোশ্যালি, পলিটিক্যালি মেয়েদের বডির সাথে যে ছেলেদের অদ্ভুত একটা অস্পষ্ট বিভেদ তৈরি করে রাখা হয় তাতে মেয়ে শরীরটা ধীরে ধীরে আকাঙ্খার বস্তু হয়ে দাঁড়ায়। সেখানেই সবচেয়ে বড় প্রবলেম। আমাদের দেশে হাফ প্যান্ট পরে একটা মেয়েশিশু ফুটবল খেলবে কি খেলবে না এটা যত বড় ট্যাবু কিন্তু একটা মেয়ে যে খেলাধুলা করছে না, তার যে জীবনে স্পোর্টস নাই সেটা নিয়ে কিন্তু আমরা ভাবি না। সো আমাদের পুরো জিনিসগুলোই হাটঁছে খুব অদ্ভুত, অস্পষ্ট কিছু ভাবনা এবং ট্যাবু ঘিরে।

আমি যেটা মনে করি, কিছু বোঝার আগেই কিন্তু আমাদের এখানে কালচারাল বিপ্লবটা ঘটে গেলো। শাড়ি চলে গেলো, হিজাব চলে আসলো। এক ওয়েস্টার্ন পোশাক নিয়ে আমরা কথা বলছি, আরেক মিডলইস্টার্ন পোশাক এসে আমাদের মধ্যে ঢুকে গেলো। আমাদের দেশে শিক্ষা, সংস্কৃতি, ওপেন কনভার্সেশন সবকিছুই বন্ধ। আমাদের এখানে একটি ওপেন কনভার্সেশন ভীষণভাবে allowed, সেটা হল মসজিদের খুতবা। ২০২২ সালে যখন আমাদের লাইফটা টেকনোলজি ডিপেন্ডেন্ট। আমরা বাসা থেকেই পৃথিবীর যে কোন জায়গায় কাজ করতে পারি, যোগাযোগ করতে পারি, এরকম একটা সিচুয়েশনে এসে আমরা আজকে কথা বলছি ছতর ঢাকবো নাকি ঢাকবো না। আমার মনে হয় যে এই যে আপনার সাথে আজকে আমার কনভারসেশন হচ্ছে এরকম কনভারসেশন আরো বহু জায়গায় আরো অনেক হওয়া উচিত। অনেকভাবে হওয়া উচিত। যে মসজিদে খুতবা হচ্ছে সে মসজিদের ইমামের সঙ্গে আমাদের কনভারসেশন হওয়া উচিত, কারণ আমিও মুসলমান উনিও মুসলমান। দেখুন, আমি কিন্তু পশ্চিমা আধুনিকতার কথা বলছি না। আমরা তো এখনো প্র্যাকটিসিং মুসলিম। আমরা নামাজ পড়ি, কুলখানিতে যাই, জানাযায় যাই। বেশিরভাগ মানুষই তো আমরা ইসলামের রীতি অনুসারেই পৃথিবী থেকে বিদায় নিচ্ছি, আমাদের বিয়ে হচ্ছে, বাচ্চার জন্ম হচ্ছে, বাচ্চার আকিকা, খৎনা দিচ্ছি। তো আমার কাছে মনে হয় পলিটিক্স এর উর্ধ্বে তো পৃথিবীর কিছু না। নারীর পোশাক নিয়ে এই প্রত্যেকটা কথাবার্তাই হচ্ছে বাংলাদেশের সোশিও পলিটিকাল সিচুয়েশনের বহিঃপ্রকাশ।

মারজিয়া প্রভা, নারীবাদী অ্যাকটিভিস্ট

শুধু পাশ্চাত্য পোশাকেই যে হচ্ছে তা নয়। তেজগাঁও কলেজের শিক্ষিকার যে ঘটনাটা হয়েছিল, ওটা হয়েছিল টিপ পরার জন্য। এটা নরসিংদী ঠিক আগের একটি ঘটনা। পুরো ব্যাপারটায় আমরা দেখি ইরান, বা ভারত কিংবা সুইজারল্যান্ড এই জায়গাগুলোতে যেটা হয়েছে, রাষ্ট্র পোশাকের উপর একটা নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। বাংলাদেশে আবার ধরেন, রাষ্ট্রের জায়গা থেকে যে পোশাক নিয়ে বেশি কিছু বলা হয় ব্যাপারটা তা না। ইনফ্যাক্ট আমাদের সংবিধানের ধারাতেই এই পোশাক নিয়ে বা জীবন-যাপনের একটা স্বাধীনতা আছে। কিন্তু বাংলাদেশে যেটা হচ্ছে, এখানে সমাজের যে মনস্তত্ত্ব; এর মধ্যে পোশাকটা নিয়ে বিশেষ করে নারীর পোশাক নিয়ে এক ধরনের পিতৃতান্ত্রিক মানসিকতা দেখা যাচ্ছে। এর আগে আমরা দেখেছি বরেন্দ্র ইউনিভার্সিটিতে ছেলেদের চুল কেটে ফেলা হয়েছে। মানে এই চর্চাটা আমাদের সমাজের মনস্তত্ত্বের মধ্যে লুকায়িত আছে। এটা কেন, সেটা খুঁজতে গিয়ে একটা বিষয় বারবারই আসে যে, আসলে নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। এখন নিয়ন্ত্রণের তো বেশ কিছু টুলস আছে। কখনো আপনার আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করবে, ‘চুপ কর। আস্তে কথা বল। বেশি চিৎকার করো না। জোরে হাসবে না।’ ঠিক তেমনি পোশাকটাও হচ্ছে ওরকম। পোশাকটাকে নিয়ন্ত্রণ করা খুব সহজ। পোশাক যেহেতু মানুষের নিত্য নৈমিত্তিক একটা ব্যবহার্য জিনিস। এটার প্রতি যদি নিয়ন্ত্রণ করা যায় তাহলে একটা মানুষের কিন্তু মবিলিটি নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। এবং নারীর পোশাক নিয়ন্ত্রণের পিছনে আসলে নারী যে স্বাধীনভাবে বাঁচতে চায়; সে চাকরি করবে, রাতের বেলা বাইরে যাবে, ঘুরতে বের হবে। এ বিষয়গুলো, এই মবিলিটিগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্যই আসলে পোশাককে একটা টুলস হিসেবে ইউজ করা হয়। সমাজে এখন সব মানুষ বলবো না কিন্তু কিছু অংশের মানুষ, কিছু চিন্তার মানুষ, আমরা যদি তাদের দুর্বৃত্ত বলতে চাই কোট আনকোট ভাবে, তারা এই টুলসটা ইউজ করে। কারণ নরসিংদীতে যখন মেয়েটাকে অ্যাটাক করা হয় তখন ওখানে একজন ভিক্ষুক নারী কিন্তু মেয়েটাকে বাঁচাতে এসেছিলো এবং সে বলছিল যে, ‘ঢাকার মেয়েরা তো এ ধরনের পোশাক পরেই। তোমরা এরকম করছ কেন।’

সমাজে এই দুই ধরনের ব্যাপারে আছে। তবে এখনো রাষ্ট্রীয়ভাবে বাংলাদেশের নারীদের পোশাকের উপর সেই ভাবে অন্তরায় তৈরি হয়নি। কিন্তু আবার যখন আপনি কোর্ট অঞ্চলে যাবেন, তখন আপনি আসামি হন আর ভিক্টিম হন আপনাকে মাথায় একটা ওড়না দিতে হবে। আপনি যদি জিন্স ফতুয়া পড়ে যান আল্টিমেটলি আপনাকে জামিন দিতে দেরি করবে। এরকম ঘটনা আমাদের সাথেও ঘটেছে। পুলিশের কাছে কোন একটা মামলা নিয়ে গেলে আপনি যদি একটা ছোট টপস বা জিন্স পরে যান, মামলাটা যদি হয় ধর্ষণের অথবা নিপীড়নের, সে ক্ষেত্রে মামলা নেয়ার আগে আপনার চরিত্রের পোস্টমর্টেম করতে শুরু করে। তো রাষ্ট্র সেভাবে নিয়ম করে দেয়নি কিন্তু আবার রাষ্ট্রীয় প্রশাসন এ ধরনের আচরণগুলো করে। একদিকে সমাজের মনস্তত্ত্বের মধ্যে এটা লুকায়িত আছে এবং রাষ্ট্রের প্রশাসনের মধ্যেও কাঠামোগতভাবে নারীর পোশাক নিয়ে এ ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি আছে। কিন্তু আমাদের এখন পর্যন্ত সংবিধান এবং নাগরিক অধিকারের জায়গা থেকে পোশাক নিয়ে বৈষম্য করার কোন রাইট আসলে কারো নাই, কিন্তু করা হয়।

তবে এ বিষয়গুলো অনেকদিন ধরেই এলার্মিং। আমার মা আমাকে বলেছেন, পাকিস্তান পিরিয়ডে যখন জিন্স পরা হত তখনও মেয়েরা বুলিংয়ের শিকার হতো। বাংলাদেশের চিরাচরিত মনস্তত্ত্বের ভিতরেই কিন্তু এ জিনিসগুলো আছে। আমাদের অফিসগুলো বা কর্পোরেট মহলে যেখানে শিক্ষিত মানুষজন আছে, সেখানেও পোশাক নিয়ে কিন্তু এক ধরনের চর্চা হয়। বাজে কথা বলা হয়। কেউ যদি স্লিভলেস পড়ে যায় কোন পার্টিতে বা কোন একটা সেমিনারে তাকে নিয়ে দেখা যায় ফিসফিসানি, কানাকানি হচ্ছে‌। তার মানে আমি বলতে চাচ্ছি যে, জিনিসটা এখন যেভাবে হচ্ছে সেটা হয়তো আগে হয়নি কিন্তু জিনিসটা যে কখনো ছিল না ব্যাপারটা তা নয়। সব সময় এ মনস্তত্ত্বটি লুকায়িত ছিল। এখন এটা সহিংসতার দিকে যাচ্ছে। হ্যাঁ, আমাদের রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ এখনো শুরু হয়নি তবে ঘটনাগুলো সেদিকেই যাচ্ছে। যেমন নরসিংদীর মেয়েটা নিজে মামলা করেনি। ওর সাথে এত বড় সহিংসতা হয়ে যাবার পরও ও মামলার দিকে গেল না। কারণ ও জানে ও বিচার পাবে না। এবং বাংলাদেশে এই যে পোশাক নিয়ে কথা বলা, পোশাক নিয়ে বুলি করা প্রকারান্তরে তো যৌন হয়রানির মধ্যেই পড়ে। কারণ আপনাকে পোশাক দিয়ে একচুয়ালি 'স্লাট শেমিং' করা হচ্ছে। মানে ওই পোশাকটা পরতেছ, তুমি খারাপ মেয়ে। তোমার সাথে আমি যা ইচ্ছা তাই করতে পারি। তোমাকে গালি দিতে পারি, তোমার গায়ে হাত দিতে পারি। ব্যাপারটা তো তাই! কিন্তু একজন নারী এটার জন্য যে প্রতিকার পেতে কোথাও যাবে, কোন সুরক্ষার জায়গায় তো আসলে নাই। কোন সিস্টেম নাই। হয়তো একটা জিডি নিবে, হয়তো পুলিশ চাইলে একটা মামলাও ঠুকে দেবে কিন্তু তারপর সেই মামলা দীর্ঘদিন ধরে চলতে থাকবে। কোর্টে উঠবে, ডেট পিছাবে। বিচারহীনতার একটা সংস্কৃতি...। তো আসলে এই জিনিসটা আরো বাড়বে, আমার কাছে মনে হয়। আমার কাছে মনে হয় যে, যতদিন পর্যন্ত আমরা আমাদের আইনি প্রক্রিয়াগুলো এবং নারীর সেখান থেকে বিচার পাওয়ার জায়গাগুলো ঠিক না করতে পারি, একটা সিস্টেমেটিক জায়গায় না আসতে পারি, ততদিন নারী মামলা করবেও না। করলেও ওই হ্যাসেলের মধ্যে দিয়ে কোন নারী যেতে চায় না। তার কারণে অনেক নিপীড়ক পার পেয়ে যায়। দিন দিন এই নিপীড়কগুলো পার পেয়ে গেলে এদের তো সংশোধনের কোন জায়গা পাচ্ছে না। বিচার ব্যবস্থা তো আসলে একটা সংশোধনের জায়গা। আমরা যতই সচেতন করি, আমরা যতই বাকোয়াস বলি যে, নারী-নিপীড়ন বন্ধ করো। এটা সমাজের জন্য ক্ষতিকর। আসলে ও বুঝতেছে কোথায় ক্ষতিকর? ও তো খোলা হাওয়ায় ঘুরতেছে। আমার কাছে মনে হয় যে বিচার ব্যবস্থা যতদিন পর্যন্ত ঠিক না হবে ততদিন আসলে পোশাক নিয়ে এই সহিংসতা থাকবে এবং বলার কোন জায়গা আমার নাই। আমি বলব কোথায়?

XS
SM
MD
LG