অ্যাকসেসিবিলিটি লিংক

ঢাকার মঞ্চে নারীদের একক অভিনয়


নাটক 'বিনোদিনী'
নাটক 'বিনোদিনী'

অভিনেত্রী ফেরদৌসী মজুমদার তাঁর অভিনীত একক মঞ্চনাটক 'কোকিলারা' সম্পর্কে স্মৃতিচারণ করে বলেছিলেন, “উল্লেখযোগ্য নাটক, যেটা আমার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিল। আমাকে একেবারে সাফল্যের তুঙ্গে উঠিয়ে দিল, সেটা কোকিলারা—একক নাটক, একক অভিনয়। নাটকটি সেই থিয়েটারের প্রাণপুরুষ আবদুল্লাহ আল মামুনেরই সৃষ্টি। আমার নাট্যজীবনের একটা চ্যালেঞ্জ। প্রথম মঞ্চায়ন ১৯৮৯ সালের ১৯ জানুয়ারি। প্রথম অভিনীত হয়েছিল গাইড হাউস মিলনায়তনে। তিন পর্বে তিন মেজাজে লেখা নাটকটি। ১৫ মিনিটের বিরতিসহ সোয়া দুই ঘণ্টা মঞ্চে আমার উপস্থিতি। প্রথম পর্বে আমি গ্রাম থেকে আসা সহজ-সরল এক নারী, এক মধ্যবিত্ত পরিবারের কাজের লোক। নাম কোকিলা। দ্বিতীয় পর্বে উচ্চবিত্ত পরিবারে কোকিলা এক সহজ-সরল কিন্তু শিক্ষিতা এবং একইসঙ্গে ধর্মপরায়ণ ও পতিপরায়ণ গৃহবধূ। তৃতীয় পর্বে এই কোকিলারই এক অভাবনীয় রূপ নিয়ে আমি মঞ্চে উপস্থিত হই। এখানে আমি আগের দুই কোকিলার হয়ে এক জাঁদরেল ব্যারিস্টারের ভূমিকা পালন করি।” [ফেরদৌসি মজুমদার: অভিনয় জীবন আমার, ২০১৯; প্রথমা প্রকাশন, পৃষ্ঠা ৭৩,৭৪]

বাংলা সংস্কৃতিতে মঞ্চনাটকের ইতিহাস দীর্ঘদিনের। প্রাচীন বাংলা সংস্কৃতিতে একসময় উত্তর ভারতীয় সংস্কৃতি থেকেই নাট্যচর্চার প্রসার ঘটে এবং সেটা আদি বাংলা পল্লী সংস্কৃতির সাথে মিশে গিয়ে বাংলা মঞ্চনাটকে নিজস্ব ধারা তৈরি করে। বাংলা নাটকে নারী চরিত্রে অভিনয়ের জন্য নারী শিল্পীর প্রথম আগমন ঘটে ১৯৫০ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর তৎকালীন পূর্ববঙ্গের ‘পাকিস্তান কালচারাল সেন্টারে’ শওকত ওসমানের ‘তস্কর লস্কর’ নাটকের মাধ্যমে। সে সময়ে এটি ছিলো একটি দুঃসাহসিক পদক্ষেপ।

একক নাটক বা মনোড্রামা কী?

একক নাটক বা মনোড্রামা মানে হলো একমাত্র বা একজন অভিনেতার জন্য লিখিত নাটক। এ ধরণের নাটকে একজন অভিনেতার মাধ্যমে একটি গল্প বা গল্পখন্ড উপস্থাপিত হয়। একজন অভিনেতা এক বা একাধিক চরিত্রে আবির্ভুত হন। এ ধরণের নাট্য পরিবেশনাকে ক্ষেত্রবিশেষে সলো পারফরমেন্স/একক অভিনয়/ ওয়ান ম্যান শো বলা হয়ে থাকে।

মঞ্চে 'সারস ডানায় পরান পাখী'
মঞ্চে 'সারস ডানায় পরান পাখী'

একক নাটকে নারী শিল্পীদের অভিনয়

বাংলাদেশে একক মঞ্চনাটকের শুরুটা হয় আরো পরে। মঞ্চে পুরুষ ও নারী উভয় অভিনয়শিল্পীরা একক নাটকে অভিনয় করলেও বেশিরভাগ একক অভিনয়ে নারীদের দেখা গেছে। অভিনেত্রী ফেরদৌসী মজুমদারের ‘কোকিলারা’র মধ্য দিয়ে ১৯৮৯ সালে একক নারী অভিনয়ের সূচনা হয়। এর ধারাবাহিকতায় একে একে মঞ্চস্থ হয় অনেক দর্শকনন্দিত একক নাটক যার বেশিরভাগই নারীকে উপজীব্য করে। নাটকগুলোতে অভিনয়ও করেন নারী শিল্পীরা। নারী শিল্পী অভিনীত উল্লেখযোগ্য মঞ্চনাটকগুলো মধ্যে রয়েছে কোকিলারা (ফেরদৌসী মজুমদার, ঢাকা থিয়েটার), বিনোদিনী (শিমূল ইউসুফ, ঢাকা থিয়েটার), গোলাপজান (রোকেয়া রফিক বেবী, থিয়েটার আর্ট ইউনিট), আমি বীরাঙ্গনা বলছি (লাকী ইনাম নাগরিক নাট্যাঙ্গন), লাল জমিন (মোমেনা চৌধুরী, শূন্যন নাট্যদল), কহে বীরঙ্গনা (জ্যোতি সিনহা, মণিপুরী থিয়েটার), হ্যাপি ডেইজ (জ্যোতি সিনহা, ফ্রান্স অ্যাম্বাসির প্রযোজনা, মণিপুরী থিয়েটার ও হৃৎমঞ্চের সহযোগিতায়), পঞ্চনারীর আখ্যান (রোজী সিদ্দিকী,ঢাকা থিয়েটার), নভেরা (সামিউন জাহান দোলা, ধ্রুপদী), হেলেন কেলার (জুয়ানা শবনম, স্বপ্নদল), সীতার অগ্নিপরীক্ষা ( নাজনীন হাসান চুমকী, সাধনা), ফুলরানী আমি টিয়া (মুনিরা ইউসুফ মেমী, থিয়েটার আরামবাগ), একা এক নারী (তনিমা হামিদ, নাট্যচক্র ), সারস ডানায় পরান পাখি (গোধূলি মাহজেবিন, দ্যাশ বাংলা থিয়েটার), বীরঙ্গনার বয়ান (রওশন জান্নাত রুশনী, শব্দ নাট্যচর্চা কেন্দ্র), দুরাশা, (সৈয়দা নওশীন ইসলাম দিশা, ব্যতিক্রম), পুতুলটিকে দেখে রেখো (শামীমা আরা মুক্তা, মেঠোপথ থিয়েটার), বেহুলা, আমি এবং সতীত্ব (তমালিকা কর্মকার, মহড়া থিয়েটার), স্ত্রীর পত্র (ফেরদৌসি আবেদীন, জিয়নকাঠি), বিস্ময়কর সবকিছু (মহসিনা আক্তার, স্পর্ধা), গহনযাত্রা (শামসি আরা সায়েকা, পদাতিক নাট্য সংসদ), রাইজ এন্ড শাইন (কাজী রোকসানা রুমা, বটতলা), আমার আমি (দীপ্তা রক্ষিত,নান্দীমুখ), অ্যানা ফ্রাঙ্ক (আর্য মেঘদূত, ম্যাড থেটার), বিফোর ব্রেকফাস্ট (নওরীন সাজ্জাদ, নাট্যকলা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়), তারামন বিবি (মুক্তা রহমান, পদাতিক নাট্য সংসদ)।

এ নাটকগুলো মধ্যে অনেক নাটক এখন আর মঞ্চস্থ হয় না। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি জানায়; শেখ সাদী, হেলেন কেলার, একা এক নারী, পুতুলটিকে দেখে রেখো, রাইজ এন্ড শাইন, গহনযাত্রা, পঞ্চনারীর আখ্যান, লাল জমিন, অ্যানা ফ্রাঙ্ক এই নাটকগুলো বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির ঢাকার মিলনায়তনে নিয়মিত মঞ্চস্থ হচ্ছে। এর মধ্যে ‘শেখ সাদী’ বাদে বাকি সবকটিই নারী শিল্পীদের অভিনীত একক নাটক।

কথা হয় নাট্যনির্দেশক, প্রশিক্ষক ও নাট্য গবেষক ড. আইরিন পারভীন লোপার সঙ্গে। তার নির্দেশনায় মঞ্চস্থ হওয়া দুটি একক নাটকের একটি হলো দ্যাশ বাংলা থিয়েটারের নাটক ‘সারস ডানায় পরান পাখী’। নাটকটি সম্পর্কে ড. আইরিন বললেন, "এই নাটকটি একটি সত্য ঘটনা অবলম্বনে করা হয়েছে। একটি প্রাণচাঞ্চল্য ভরা কিশোরী স্কুলের সামনে থেকে কিছু মাদকসেবীদের দ্বারা অপহৃত হয় এবং ধর্ষিত ও খুন হয়। এটাই এ নাটকের মূল কাহিনী। নাটকটি লিখেছেন রাশেদুল ইসলাম রাজা।"

নাটক 'বিনোদিনী'
নাটক 'বিনোদিনী'

একক অভিনয়ের ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ সম্পর্কে তিনি বললেন, "এটি একজন অভিনেতার দক্ষতার উপর নির্ভর করে। একটি দলগত নাটক অনেকজন অভিনেতা যেভাবে এগিয়ে নিয়ে যায় তার কোনোটাই একক নাটকের ক্ষেত্রে হয় না। একজন অভিনেতাকে একই সঙ্গে অনেকগুলো চরিত্রের মতো হয়ে উঠতে হয়। অনেকগুলো গল্প নানাভাবে তাকে প্রেজেন্ট করতে হয়। সবমিলিয়ে একজন অভিনেতার উপরেই পুরো বিষয়টির দায়িত্ব বর্তায়। তাই এটি একজন অভিনেতার জন্য অনেক বড় চ্যালেঞ্জ। তাকে অবশ্যই খুব দক্ষ অভিনেতা হতে হয়। ভীষণ এনার্জিটিক হতে হয়, স্পন্টেনিয়াস হতে হয়। একা একটি স্টেজে এক-দেড় ঘন্টা কিংবা আরো বেশি সময় পুরো দর্শককে ধরে রাখা ভীষণ কঠিন একটি কাজ। খুবই দক্ষ ও অভিজ্ঞ অভিনেতা ছাড়া একা পুরো বিষয়টি দর্শকদের কাছে ফুটিয়ে তোলা সম্ভব নয়।"

জানতে চেয়েছিলাম, একক অভিনয়ের ক্ষেত্রে নারীরা বেশি এগিয়ে কেন? ড. আইরিনের মতে, "আমাদের দেশে তথা এই উপমহাদেশের নারীদের জীবনের ঘাত-প্রতিঘাত, সংগ্রাম বেশি। এ ধরণের কন্টেন্ট অনেক বেশি তাই আমার মনে হয় যারা লিখছেন তারা নারীদের নিয়ে লিখতে বেশি অনুপ্রাণিত হচ্ছেন। ফলে বেশিরভাগ একক নাটকের চরিত্রগুলো নারীকেন্দ্রিক হয়।"

প্রথম একক নাটক ‘কোকিলারা’র এ পর্যন্ত মঞ্চে মোট ৯৯টি শো হয়েছে। ২০০৬ সালে অভিনেত্রী ফেরদৌসি মজুমদার অসুস্থ হয়ে পড়লে বেশ কিছু বছর নাটকের প্রদর্শনী স্থগিত রাখা হয়। এরপর আবার সুদীপ চক্রবর্তীর নির্দেশনায় নতুন করে নাটকটি মঞ্চে আসে।

নব্বইয়ের দশকে ঢাকার মঞ্চে সাড়া জাগানো নাটক ‘গোলাপজান’। দেশ এবং দেশের বাইরেও সমান সমাদৃত হয় নাটকটি। পুরোনো ঢাকার এক নারীর জীবন নিয়ে মোহাম্মদ আবু তাহেরের ছোট গল্প অবলম্বনে রচিত নাটকটির রূপান্তর ও নির্দেশনা দিয়েছিলেন এসএম সোলায়মান। ‘গোলাপজান’ নামক একজন সাধারণ নারীর সংগ্রামী জীবনের আখ্যান এটি।

‘হ্যাপি ডেজ’ নাটকটি নোবেলজয়ী নাট্যকার স্যামুয়েল বেকেটের লেখা ‘হ্যাপি ডেজ’ অবলম্বনে নির্মিত। উইনি নামের এক নারীর নিঃসঙ্গ কিন্তু স্বপ্নময় জীবনের দৈনন্দিন সব ছেলেমানুষী কার্জকলাপের মধ্য দিয়ে তাঁর মানসপটকে আঁকা হয়েছে। পুরো নাটকে উইনি তার স্বামী উইলির সঙ্গে প্রলাপের মতো অনর্গল কথা বলে যায়। উইলি জীবিত নাকি মৃত, সে প্রশ্নের মীমাংসাও হয় না। কিন্তু উইনি তাকে নিয়ে জীবনের আনন্দময় দিনের স্বপ্ন দেখে, যা কোনোদিনই তার জীবনে আসে না। এক ঘণ্টার এই নাটকে একক অভিনয় করেছেন জ্যোতি সিনহা।

মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে একক নাটক ‘লাল জমিন’। এ নাটকটি নিয়মিত দেশের ভেতরে ও বাইরে বিভিন্ন স্থানে মঞ্চস্থ হচ্ছে ২০১১ সাল থেকে। নাটকটি লেখেন মান্নান হীরা এবং নির্দেশনা দেন সুদীপ চক্রবর্তী। শূন্যনের আনা এ নাটকটি সংস্কৃতিক মন্ত্রণালয়ের আর্থিক পৃষ্ঠপোষকতায় এ পর্যন্ত ৩০০টির উপরে প্রদর্শনী হয়েছে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে এক কিশোরীর অংশগ্রহণ, সে সময়ে তার জীবনে ঘটে যাওয়া ভয়াবহ সব ঘটনা এবং পরবর্তী সময়ে তার জীবনযুদ্ধ নিয়ে নাটকটির কাহিনী রচিত।

মঞ্চে সাড়া জাগানো একক নাটক ‘বিনোদিনী’। এটি ঢাকা থিয়েটারের সবচেয়ে বেশি মঞ্চায়িত নাটক। প্রথম মঞ্চায়ন হয় ২০০৫ সালে। উপমহাদেশের মঞ্চনাটকের প্রখ্যাত অভিনেত্রী বিনোদিনী দাসীর আত্মজীবনী অবলম্বনে নাটকটি রচিত হয়। নাটকটির গ্রন্থনা ও গবেষণা করেছেন সাইমন জাকারিয়া, মুখবন্ধ ও মুখ্য উপদেষক সেলিম আল-দীন, নির্দেশনা দেন নাসির উদ্দিন ইউসুফ, একক অভিনয় করেন শিমূল ইউসুফ।

একক মঞ্চনাটক নিয়ে লেখক, গবেষক ড. সাইমন জাকারিয়া ভয়েস অফ আমেরিকাকে বললেন, “আমার সৌভাগ্য যে উল্লেখযোগ্য দুটি একক নাটকই আমার লেখা। একটি ‘সীতার অগ্নিপরীক্ষা’ এবং আরেকটি হলো ‘বিনোদিনী’। ‘সীতার অগ্নিপরীক্ষা’ নাটকের দুটি ভার্সন আছে। একটি দিল্লীতে মঞ্চস্থ হয়। আমারই লেখা। এখানে অিভিনয় ররেছে নাজনীন হাসান চুমকী। ২০১০ সালে প্রথম মঞ্চস্থ হয় নাটকটি। এ পর্ন্ত অর্ধশতর বেশি শো হয়েছে।”

'সারস ডানায় পরান পাখী' নাটকের দৃশ্য।
'সারস ডানায় পরান পাখী' নাটকের দৃশ্য।

বিনোদিনী নাটক সম্পর্কে ড. সাইমন জাকারিয়া বললেন, “বিনোদিনী দাসীর দুটো আত্মজীবনী আছে, একটি ‘আমার কথা’ আরেকটি ‘আমার অভিনেত্রী জীবন’। নাটকটি লেখার কথা ছিলো মূলত সেলিম আল দীনের। পরবর্তীতে সেলিম আল দীনের পরামর্শেই আমি নাটকটি লিখি। আমাকে বলা হয় যে নাটকটি বিনোদিনী দাসীর আত্মজীবনীকেন্দ্রিক হবে। তখন আমি বিনোদিনী দাসীর দুটো আত্মজীবনীই পড়ি এবং সেখান থেকে একটি নাট্য তৈরি করি। সেই নাটকটাই ঢাকা থিয়েটার মঞ্চস্থ করে। আর এই নাটকে উল্লেখযোগ্য দিকটি হলো, আমরা দেখাতে চেয়েছিলাম আধুনিক বাংলা নাটকের মঞ্চে আগে নারীরা অভিনয় করতো না। সচরাচর ছেলেরাই নারী সেজে অভিনয় করতো। মাইকেল মধূসুদন দত্ত বিলেত থেকে ঘুরে আসার পরে আমাদের এই বাংলা অঞ্চলে একটি ধারণার প্রচলন করেন যে, নারীরা কেন মঞ্চে অভিনয় করবে না। তখন অভিনয় করার ক্ষেত্রে শিক্ষিত নারীরাও এগিয়ে আসেন। বাংলা নাট্যমঞ্চের পথিকৃত গিরীশচন্দ্র ঘোষের উদ্যোগেই মূলত বাংলা নাটকের মঞ্চে নারীদের আগমন ঘটে। সেই নারীদের ভেতরে অগ্রগন্য ছিলেন বিনোদিনী দাসী। তিনি কোনো শিক্ষিত, মর্যাদাপূর্ণ পরিবারের নারী নন বরং একজন রক্ষিতা ছিলেন। সে সময়ে বিশেষ করে কলকাতাকেন্দ্রিক ধনী ব্যক্তিরা কিছু নারীদের রক্ষিতা হিসেবে রাখতেন। এই নারীরা শিল্প সংস্কৃতিতে খুব সুশিক্ষিত হতেন। সে সময় এদের অনেকেই অভিনয়ে এলেও সৃজনশীলতার দিক থেকে বিনোদিনী দাসী ছিলেন অনন্য। তিনি কবিতা লিখতেন, তার দুটি কাব্যগ্রন্থও আছে। বিনোদিনী দাসী বাংলা নাটকের জন্য তার জীবনকে উৎসর্গ করেছিলেন, তাঁর সেই আত্মত্যাগের কথা তুলে ধরতেই আমরা থিয়েটারটা লিখেছিলাম।

বিনোদিনী দাসীর নামে একটি থিয়েটার হল হওয়ার কথা ছিলো, ‘বি থিয়েটার’ নামে। সেই হল গড়ে তোলার জন্য গিরীশ ঘোষ এবং সংশ্লিষ্টরা একজন বিত্তশালী ব্যক্তির সঙ্গে চুক্তি করেন। সেই ব্যক্তি অর্থায়ন করেন। হল রেজিস্ট্রেশনের সময় গিরীশ ঘোষ সহ তথাকথিত শিক্ষিত সমাজের লোকজনের বিবেকে বাধে যে একজন রক্ষিতার নামে হলের নাম রেজিস্ট্রেশন করবো! বি থিয়েটার নাম রাখলে হয়তো সভ্য সমাজের কেউ আর নাটক দেখতে আসবে না। তখন তারা স্বিদ্ধান্ত নেয় যে হলটির নাম রাখা হবে ‘স্টার থিয়েটার’। বিনোদিনী এই হল গড়ে তোলার পেছনে প্রচুর শ্রম দিয়েছিলেন। রেজিস্ট্রেশন হওয়ার পরে গিরীশ ঘোষের কাছে তিনি জানতে পারেন হলের নাম হবে স্টার থিয়েটার। গিরীশ ঘোষ বিনোদিনীর মন রাখতে বলেন, ‘তুমিই তো স্টার।’ বিনোদিনী দাসী এই চাতুরি বুঝতে পারেন এবং ভীষণ কষ্ট পান। এরপর বিনোদিনী স্বিদ্ধান্ত নেয় যে সে আর নাটক করবে না। মঞ্চ থেকে নিজেকে সরিয়ে নেয়। সে সময়টাতেই সে তাঁর আত্মজীবনী লিখতে শুরু করেন। সেখানে তিনি থিয়েটার জগতের লোকজনের আচরণ, তার অভিনয় জীবন, নাটকে অভিনয়ের অভিজ্ঞতা সব বিষয় উল্লেখ করেন। এখানে আমরা একদিকে বাংলা নাটকের ইতিহাস দেখতে পাই, আরেকদিকে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের আচরণ দেখতে পাই। এছাড়া বাংলা নাটকের মঞ্চে নারীদের আগমন সম্পর্কেও জানতে পারি যে কত কষ্ট করে তারা থিয়েটারের এই চর্চাটাকে প্রতিষ্ঠা করেছিলো। এই বিষয়গুলো তুলে ধরার জন্য এবং বিনোদিনীকে স্মরণ করার জন্য, সম্মান জানানোর জন্য আমরা এই নাটকটি লিখি এবং নাসিরউদ্দিন ইউসুফের নির্দেশনায় ঢাকা থিয়েটার থেকে মঞ্চস্থ হয়। শিমুল ইউসুফ এতে একক অভিনয় বিনোদিনী দাসী একজন আর্টিস্ট ছিলেন, ঢাকা থিয়েটারের এই নাটকে আমরা তাঁকে সেই সম্মানটি দিয়েছি। করেছেন। এটি ঢাকা থিয়েটারের সর্বোচ্চ মঞ্চস্থ নাটক। ঢাকার মঞ্চে এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি নাটক। এই নাটকটি ঢাকা থিয়েটার বহু দেশে মঞ্চায়ন করেছে। এমনকি সেই ‘স্টার থিয়েটার’ হলেও নাটকটি মঞ্চস্থ হয়েছে।”

বিনোদিনী নাটকের স্মৃতিচারণ করে অভিনেত্রী শিমূল ইউসুফ ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন, “বিনোদিনী প্রথম মঞ্চস্থ হয় ২০০৫ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি (সম্ভবত)। বিনোদিনীর আত্মজীবনী থেকে নেয়া। সাইমন জাকারিয়া, সেলিম আল-দীনের অধীনের গবেষণা করে স্ক্রিপ্ট রেডি করেন। পান্ডুলিপিটা একটু বড় ছিলো। সেখান থেকে কমিয়ে একটু ছোটো করে আমি বিনোদিনী করি, তাও দেড় ঘন্টার একটা একক অভিনয়। বিনোদিনী নাটকে যে গানগুলো ব্যবহার করা হয়েছে তার মধ্যে একটি গান ছাড়া বাদবাকি সবগুলো গানই বিনোদিনী দাসীর কবিতা থেকে নেয়া। বিনোদিনী খুব বড় কবি ছিলেন। তার কবিতাগুলোকে আমি সুর করে গান করেছি। শুধু গিরীশ ঘোষের লেখা চৈতন্যলীলার একটি গান, যেটা কীর্তন আঙ্গিকে। তো সেটারও সুর করেছি আমি। আর চারটি গান বিনোদিনীর নিজের লেখা, সেগুলোরও সুর করেছি। এভাবে মিউজিক, কস্টিউম, কোরিওগ্রাফ, স্ক্রীপ্ট এডিটিং, সব একসাথে ধরেছিলাম। আর এখানে যে বত্রিশটা চরিত্রের কথা বলা হয়, তার বেশিরভাগ চরিত্রগুলো আলাদা করে বোঝা যাবে না। ন্যারেশনের মধ্য দিয়ে আসে, ন্যারেশনের মধ্য দিয়েই চলে যায়। বিনোদিনী অভিনীত কিছু উল্লেখযোগ্য নাটকের অংশবিশেষ বিনোদিনী নাটকে ছুঁয়ে যাওয়া হয়েছে, যেমন-মেঘনাদবধ কাব্য, নীলদর্পণ, মৃণালিনী, চৈতন্যলীলা। এছাড়া রামকৃষ্ণ পরমহংস, স্বামী বিবেকানন্দ, গিরীশ ঘোষ, গুর্মুখ রায় এসমস্ত চরিত্রগুলোও ‘বিনোদিনী’ নাটকে এসেছে। এছাড়া বিনোদিনী দাসীর মা, ঠাকুমা সহ তাঁর ব্যক্তিগত জীবনের আরো অনেক চরিত্র অল্প অল্প করে এই নাটকে এসেছে। ওই ন্যারেশনের মধ্য দিয়েই আমি আলাদা আলাদা করে চরিত্রগুলো চিত্রন করার চেষ্টা করেছি। প্রথমদিকে অন্যের আত্মজীবনী মুখস্থ করাটা আমার জন্য খুব কঠিন ছিলো। একজনের ব্যক্তিগত ভালো লাগা, মন্দ লাগা, ঘাত-প্রতিঘাত; সমাজ থেকে, নাটকের দলগুলো থেকে নিগৃহীত হওয়া এ সমস্ত বিনোদিনী দাসীর একান্ত ব্যক্তিগত বিষয় মুখস্থ করা খুব টাফ ছিলো। অন্যের ডাইরী মুখস্থ করা যে খুব কঠিন ব্যাপার এটা আমি ‘বিনোদিনী’ করতে গিয়ে বুঝতে পেরেছি। একটা সময়ে আমার মনে হয়েছিলো আমি পারবো না। সাধু ভাষায় লেখা, সচরাচর তো আমরা সাধু ভাষায় কথা বলি না, এজন্য আমার মুখস্থ করতে খুবই কষ্ট হয়েছিলো।

আমার সব কাজ আমি একসাথে করার চেষ্টা করি। গানের সুর, কোরিওগ্রাফ এবং অ্যাক্টিং, ন্যারেশনটা আমি একসাথে তৈরি করার চেষ্টা করি। তাতে আমার সুবিধা হয় যে, আমার মুভেমেন্ট কী হবে, কীভাবে হাত-পা নাড়াবো তা ঠিক করতে পারি। বিনোদিনীতে আমি একটা পুরোনো দিনে একটা জেশ্চার নিয়েছিলাম। প্রায় ১০০ বছর আগে নারীরা কীভাবে হাঁটতেন, কথা বলতেন সেই জেশ্চার নেওয়ার চেষ্টা করেছিলাম। পেরেছি কিনা আমি বলতে পারবো না। বিনোদিনীর অরিজিনাল বইটা আমি শান্তিনিকেতন থেকে সংগ্রহ করি। বইটি আউট অফ মার্কেট ছিলো। পশ্চিমবঙ্গের সূবর্ণরেখা প্রকাশনীর মালিক আমাকে তাঁর নিজের সংগ্রহের বইটি দেন। এরপর ঢাকায় এসে সাইমন জাকারিয়াকে বইটি দেই। নাটকের শুরুর মুখবন্ধটি সেলিম আল-দীন আমার অনুরোধে লিখে দিয়েছিলেন। ২০১৯ সালের ২০ ডিসেম্বর বিনোদিনীর ১২৮তম শো হয়েছিলো। তবে আমি এখনও ‘বিনোদিনী’ শেষ করিনি। আমার যখনই মনে হবে আমি তখনই নাটকটি আবার করবো। প্যানডামিকের কারণে এরপর গত তিন বছরে আর কোনো শো করতে পারিনি। ”

XS
SM
MD
LG