মিয়ানমারের সিনিয়র জেনারেল মিন অং হ্লাইং-এর নেতৃত্বাধীন জান্তার সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন বন্ধের জন্য থাইল্যান্ড-এর সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর সংসদ সদস্যরা । তারা বলেছেন “কোনও আসিয়ান সদস্য রাষ্ট্রের মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক থাকা উচিত নয়। কারণ বাহিনীটি মিয়ানমারকে অস্থিতিশীলতার কেন্দ্রে পরিণত করেছে; যা পুরো অঞ্চলকে হুমকির মুখে ফেলেছে।”
বৃহস্পাতিবার (২৬ জানুয়ারি) মালয়েশিয়ার প্রাক্তন সংসদ সদস্য এবং আশিয়ান পার্লামেন্টারিয়ানস ফর হিউম্যান রাইটসের (এপিএইচআর) কো- চেয়ারপার্সন চার্লস সান্তিয়াগো বলেছেন, “কোনো আসিয়ান সদস্য রাষ্ট্রের এমন সেনাবাহিনীর সঙ্গে 'বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক' থাকা উচিত নয়, যা মিয়ানমারকে অস্থিতিশীলতার কেন্দ্রে পরিণত করেছে এবং পুরো অঞ্চলকে হুমকির মুখে ফেলেছে।”
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর সংসদ সদস্যরা বলেন যে মিয়ানমার সেনাবাহিনী, ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে ব্যর্থ অভ্যুত্থানের পর, মিন অং হ্লাইং-এর ক্ষমতাকে শক্তিশালী করতে নিজের জনগণের ওপর সব ধরনের নৃশংসতা চালিয়ে যাচ্ছে। তারা প্রতিবেশী দেশ থেকে নিপীড়ন এবং সামরিক হামলা থেকে পালিয়ে আসা শরণার্থী এবং আশ্রয়প্রার্থীদের সহায়তা দেওয়ার জন্য থাই কর্তৃপক্ষকেও আহ্বান জানিয়েছেন।
পশ্চিম মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে মিয়ানমার ও থাই সশস্ত্র বাহিনীর শীর্ষ নেতাদের মধ্যে বৈঠকের পর, বৃহস্পতিবার (২৬ জানুয়ারি) জান্তাকে বিচ্ছিন্ন করার এই আহ্বান আসে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর সংসদ সদস্যদের পক্ষ থেকে।
মিয়ানমারের নিয়ন্ত্রিত গণমাধ্যমের তথ্যমতে, রয়্যাল থাই সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান, জেনারেল চ্যালারম্ফন শ্রীসাওয়াসদি এবং সামরিক জান্তা প্রধান মিন অং হ্লাইং, দুই সশস্ত্র বাহিনীর মধ্যে পারস্পরিক আস্থা, পারস্পরিক বোঝাপড়া এবং বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ককে আরও দৃঢ় করার লক্ষ্যে ২০ জানুয়ারি মিলিত হন।
যখন উচ্চ-পর্যায়ের বৈঠক চলছিল, মিয়ানমার সামরিক বাহিনী তখন সাগাইং অঞ্চলে অবস্থিত একটি গ্রামে নির্বিচারে বিমান হামলা চালাচ্ছিল। এতে অন্তত সাত গ্রামবাসী নিহত হন এবং ত্রিশ জনের বেশি আহত হন। মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী প্রতিবেশী কারেন ও কারেন্নি রাজ্যে যখন বিমান হামলা চালাচ্ছিল তখন বেশ কয়েকবার থাই ভূখণ্ডেও গোলা পতিত হয়।
সহিংসতা বন্ধ ও মানবিক সংকট মোকাবেলায় ২০২১ সালের এপ্রিলে আসিয়ান সদস্য দেশগুলো ও মিয়ানমার জান্তা আলোচনার মাধ্যমে পাঁচ দফা ঐক্যমতে সই করেছিল। এপিএইচআর বারবার বলেছে, মিন অং হ্লাইং শুরু থেকেই তার শর্তাবলি মেনে চলার কোনো ইচ্ছা দেখায়নি।
মিয়ানমারের সংকট নিয়ে বৈশ্বিক প্রতিক্রিয়ায়, এপিএইচআরের তৈরি করা আন্তর্জাতিক সংসদীয় তদন্তের প্রতিবেদনে (আইপিআই) আসিয়ানকে পাঁচ দফা ঐক্যমত পরিত্যাগ করার আহ্বান জানিয়েছে। কারণ এটি স্পষ্টতই ব্যর্থ হয়েছে। সান্তিয়াগো বলেছেন, “আমরা আমাদের আইপিআই রিপোর্টে দাবি করেছি, আসিয়ানের উচিত মিয়ানমারের জাতীয় ঐক্য সরকারকে (এনইউজি) দেশটির বৈধ কর্তৃপক্ষ হিসেবে নিযুক্ত করা এবং জাতিগত সংগঠনগুলোর সঙ্গে একটি নতুন ঐকমত্য নিয়ে পুনরায় আলোচনা করা।”
“আসিয়ান উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকে জান্তার প্রতিনিধিদের আমন্ত্রণ না করার প্রাথমিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে। মালয়েশিয়া ও আসিয়ানের বর্তমান সভাপতি ইন্দোনেশিয়ার মতো দেশগুলো এনইউজিতে যুক্ত হতে ইচ্ছুক৷ মিং অং হ্লাইংয়ের সঙ্গে সাক্ষাত করে, থাইল্যান্ড সেই প্রচেষ্টাগুলোকে দুর্বল করছে এবং আঞ্চলিক গোষ্ঠীর মধ্যে বিভাজন আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে:” উল্লেখ করেন এপিএইচআর কো- চেয়ারপার্সন চার্লস সান্তিয়াগো।
থাইল্যান্ড মিয়ানমারের সঙ্কট নিয়ে আলোচনার জন্য গত ডিসেম্বরে একটি বৈঠকের আয়োজন করেছিল। ঐ বৈঠকে মিয়ানমার জান্তা, লাওস ও কম্বোডিয়া’র পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং ভিয়েতনামের উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী উপস্থিত ছিলেন। মালয়েশিয়া, ফিলিপাইন, ইন্দোনেশিয়া এবং সিঙ্গাপুর এতে অংশ নেয়নি।
থাইল্যান্ড এবং মিয়ানমার দুই হাজার ৪০০ কিলোমিটারেরও বেশি সীমানা ভাগ করে। আর ঐ সীান্তেও জান্তার আক্রমণে লক্ষাধিক মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে। তবুও থাইল্যান্ড সীমান্তের ওপারে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর আক্রমণ থেকে পালিয়ে আসা শরণার্থীদের গ্রহণ করতে অস্বীকার করে। প্রায়শই কয়েক দিন পর, এমনকি কয়েক ঘন্টা পর, যারা সীমান্ত অতিক্রম করে, তাদের পিছনে ঠেলে দেয়। মানবাধিকার সংস্থাগুলো গত দুই বছর ধরে এর নিন্দা জানিয়ে আসছে।
প্রতিবেশী দেশ থেকে আসা আশ্রয়প্রার্থীরা থাইল্যান্ডে খুব একটা ভালোভাবে বাস করে না, যেখানে তাদের কোনো আইনি সুরক্ষা নেই এবং তারা নির্বাসনের ভয়ে থাকে।
সান্তিয়াগো বলেছেন, “ইন্দোচীনে বিংশ শতাব্দীর যুদ্ধের পর থেকে লাওস, কম্বোডিয়া বা ভিয়েতনাম থেকে আসা শরণার্থীদের স্বাগত জানানোর ইতিহাস রয়েছে থাইল্যান্ডের। থাই সরকারের উচিত মিয়ানমারের সীমান্তবর্তী জাতিগত রাজ্যগুলোতে যুদ্ধ থেকে পালিয়ে আসা শরণার্থীদের জন্য তার সীমানা উন্মুক্ত করা এবং যারা রাজনৈতিক আশ্রয় চায় তাদের আইনী সুরক্ষা প্রদান করা, যাদের মধ্যে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী থেকে পালিয়ে আসারাও রয়েছে। তাদের স্থানীয় সুশীল সমাজ সংস্থা এবং আন্তর্জাতিক এনজিওগুলোর দ্বারা আন্তঃসীমান্ত সাহায্যের সুবিধা প্রদান করা উচিত। আবারও, এই ইস্যুতে মিয়ানমারে থাই সরকারের প্রধান কথোপকথনকারীর উচিত হলো এনইউজি জোটবদ্ধ জাতিগত সংগঠন এবং প্রাণবন্ত নাগরিক সমাজের সঙ্গে যোগাযোগ বজায় রাখা।”