অ্যাকসেসিবিলিটি লিংক

বিশ্বের সেরা ও বৈচিত্র্যপূর্ণ ৫টি বইমেলা


বইমেলায় বই পড়ছেন একজন ক্রেতা। ৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩। (ছবি-এএফপি/ মুনিরুজ্জামান )
বইমেলায় বই পড়ছেন একজন ক্রেতা। ৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩। (ছবি-এএফপি/ মুনিরুজ্জামান )

পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে লেখক, পাঠক, প্রকাশক এবং মুদ্রণজগতের জন্য বইমেলার গুরুত্ব অপরিসীম। মুদ্রণ যন্ত্রের প্রসারের সঙ্গে বিশ্বের নানান শহরে ছাপা বই যেমন বাড়তে থাকে, তেমনি তা পাঠকের কাছে সহজলভ্য করার তাগিদে বইমেলার আয়োজনও বাড়তে থাকে। একবিংশ শতকে পৌঁছতে পৌঁছতে বিভিন্ন ভাষার মানুষের জন্য বইমেলা হয়ে উঠেছে এক মুক্তাঙ্গন। এখানে রইল বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয়, বৈচিত্র্যে ভরা এবং গুরুত্বপূর্ণ পাঁচটি বইমেলা।

১। ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলা (জার্মানি):

ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলাকে বলা হয় বাণিজ্যিক দিক থেকে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বইমেলা। জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট শহরে কয়েক’শ বছর ধরে এই মেলা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। ঐতিহাসিকভাবে দ্বাদশ শতাব্দীতে প্রাথমিকভাবে এর সূচনা হয়। আনুষ্ঠানিকভাবে এই বইমেলার সূচনা হয় ১৪৬২তে। নতুন রূপে এই বইমেলা ফিরে আসে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে ১৯৪৯ সালে। মেলায় প্রায় ৩ লক্ষ পাঠক-ক্রেতা সমাগম হয়। প্রতি বছর অক্টোবর মাসের মাঝামাঝি পাঁচ দিনব্যাপী এই মেলা আয়োজিত হয় ফ্রাঙ্কফুর্ট ট্রেড ফেয়ার গ্রাউন্ড-এ। প্রথম তিনদিন থাকে কেবল বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে আগমনকারীদের জন্য। পরবর্তী দু’দিন মেলা উন্মুক্ত থাকে সবার জন্য। মেলাটি মূখ্যত তিন ভাগে বিভক্ত থাকে – (ক) নিজেদের প্রকাশনা নিয়ে উপস্থিত থাকেন যারা তাদের জন্য, (খ) মেলায় আসা পাঠক-ক্রেতাদের জন্য, (গ) ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে তৈরি হওয়া বিজনেস সেন্টার। ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলার অন্যতম আকর্ষণ হল ‘গেস্ট অফ অনার’ বা সাম্মানিক অতিথি হিসাবে কোনও এক নির্দিষ্ট দেশের উপস্থিতি। এই বইমেলায় ‘গেস্ট অফ অনার’ হওয়াকে প্রতিটি দেশই অত্যন্ত সম্মানজনক মনে করে এবং এর জন্য বিভিন্ন দেশের মধ্যে যথেষ্ট প্রতিযোগিতাও থাকে। গত কয়েক বছরে ফ্রান্স, জর্জিয়া, নরওয়ে, কানাডা ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলায় ‘গেস্ট অফ অনার’ হয়েছে।

২। বুক এক্সপো আমেরিকা (যুক্তরাষ্ট্র):

১৯৪৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ডিসি-তে ‘আমেরিকান বুক সেলার অ্যাসোসিয়েশন’-এর ‘কনভেনশন এবং ট্রেড শো’ নামে শুরু হয় বই নিয়ে এই আয়োজনের। ১৯৭১ সালে নাম বদলে ‘বুক এক্সপো আমেরিকা’ নাম রাখা হয়। মে মাসের শেষে বা জুন মাসের শুরুতে চার দিন ধরে যুক্তরাষ্ট্রের বড় বড় শহরে পালাক্রমে চলত এ বইমেলা। ২০০৮-এ লস অ্যাঞ্জেলেস-এ, নিউইয়র্ক সিটিতে ২০০৯-১৫ সালে এবং সর্বশেষ ২০১৬ সালে শিকাগোয় হয়েছে এ মেলা। ২০২০ সালে কোভিড-১৯ মহামারীর পর থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ হয়ে গেছে বুক এক্সপো। ২০২০ সালেই আয়োজক সংস্থা ‘রিডপপ’ ঘোষণা করেছিল ‘বুক-এক্সপো’ ও সাম্প্রতিক সময়ে তার সঙ্গে শুরু হওয়া জনপ্রিয় দু’টি ইভেন্ট ‘দ্য বুককন’ ও ‘আনবাউন্ড’ আপাতত ‘অবসর’ নিচ্ছে। ২০২২-এর মে মাসে ভার্চুয়ালি অনুষ্ঠিত হয় ‘ইউএস বুক শো’, যা ২০২১ সালে শুরু করেছিল পাবলিশার্স উইকলি ‘বুক এক্সপো’র বিকল্প হিসাবে। তবে অদূর ভবিষ্যতে ‘অবসর’ ভেঙে ‘বুক এক্সপো’-র ফিরে আসার কোনও সম্ভাবনা এখনই দেখা যাচ্ছে না।

৩। লন্ডন বুক ফেয়ার (ইংল্যান্ড):

বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম বইমেলা হলো ইংল্যান্ড-এর লন্ডন বুক ফেয়ার। ১৯৭১-এর ৫ নভেম্বর এ মেলার যাত্রা শুরু হয়। বর্তমানে ১০০টিরও বেশি দেশ লন্ডন বইমেলায় অংশ নেয়। প্রতি বছর এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি লন্ডন-এ আয়োজিত হয় এই মেলা। ইউরোপিয়ান প্রকাশক, বিক্রেতা, এজেন্টদের বিরাট সমাগম হয় প্রতি বছর এই মেলায়, সংখ্যাটি প্রায় ২৫ হাজার। ২০০৬ সাল পর্যন্ত এ মেলা চলত অলিম্পিয়া এক্সিবিশন সেন্টার-এ। মাঝে কয়েক বছর এই মেলার স্থানবদল হলেও ২০১৫ থেকে লন্ডন বুক ফেয়ার চলছে অলিম্পিয়াতেই। প্রায় দুই হেক্টর জায়গা জুড়ে বিস্তৃত লন্ডন বুক ফেয়ার-এ তিন দিন ধরে চলে দু'শরও বেশি ইভেন্ট যেখানে বিভিন্ন নামজাদা বক্তারা তাদের বক্তব্য রাখেন, থাকে আলাপচারিতা, প্রশ্নোত্তর পর্ব। বইমেলার ভেতরে থাকে ‘অথর্স এইচকিউ’, ‘চিলড্রেনস্‌ হাব’, ‘ক্রস-কালচারাল হাব’-এর মতো অসংখ্য বিভাগ। এই বইমেলার অন্যতম আকর্ষণের মধ্যে রয়েছে ‘অথর্স অফ দ্য ডে’ ও ‘ইলাস্ট্রেটর অফ দ্য ফেয়ার’ প্রোগ্রাম দু’টি।

৪। আন্তর্জাতিক কলকাতা বইমেলা (ভারত):

আর্ন্তজাতিক কলকাতা বইমেলা বিশ্বের বৃহত্তম অবাণিজ্যিক বইমেলা অর্থাৎ যেখানে শুধুমাত্র পাঠকই ক্রেতা, কেবল পাইকারি ডিস্ট্রিবিউটর-রা নয়। এশিয়ার বৃহত্তম এবং বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম বইমেলাও কলকাতা বইমেলা। পাবলিশার্স ও বুকসেলার্স গিল্ড এই মেলার আয়োজক। কলকাতার করুণাময়ী এলাকার সেন্ট্রাল পার্ক-এ স্থায়ী বইমেলা প্রাঙ্গনে বর্তমানে এই মেলা আয়োজিত হয়। মূলত বাংলাভাষার বই-ই এই বইমেলার প্রধান আকর্ষণ। সঙ্গে ভারতবর্ষের বিভিন্ন ভাষা ও বিদেশী ভাষার বইও থাকে অসংখ্য স্টলে। ১৯৭৬ সালে শুরু হওয়া এই বইমেলা ১৯৮৪ সালে আন্তর্জাতিক বইমেলার স্বীকৃতি অর্জন করে। জানুয়ারির শেষ বুধবার ১২ দিনব্যাপী এই বইমেলার উদ্বোধন হয়। ২০২৩ সালের সদ্য সমাপ্ত মেলায় বিক্রির পরিমাণ ছিল প্রায় ২৭ কোটি টাকা। এবছর বইমেলায় রেকর্ড সংখ্যক ৯৪৯টি স্টল ছিল। বইমেলার অন্যতম আকর্ষণ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের প্যাভিলিয়ন, যেখানে সেই দেশের বই দেখতে পারেন পাঠকেরা এবং প্রতি বছর মেলায় থাকে একটি নির্দিষ্ট দেশ, থিম হিসাবে। সদ্য সমাপ্ত ৪৬তম আর্ন্তজাতিক কলকাতা বইমেলার থিম ছিল স্পেন। তাছাড়া এই মেলায় ছোট ও বিকল্প পত্রিকাদের জন্য লিটল ম্যাগাজিন প্যাভিলিয়ন থাকে, যা অন্য কোনও বইমেলায় প্রায় চোখে পড়ে না। থাকে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, আলোচনাসভার জন্য মুক্তমঞ্চ। তাছাড়া আয়োজক গিল্ড-এর প্যাভিলিয়ন-এও প্রতিদিন কবিতা পাঠ, আলোচনা ইত্যাদি অনুষ্ঠিত হয়।

৫। অমর একুশে গ্রন্থমেলা (বাংলাদেশ):

অমর একুশে গ্রন্থমেলা উৎসর্গ করা হয়েছে সেই শহীদদের প্রতি, যারা ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ভাষার মর্যাদা রক্ষার জন্য প্রাণ দিয়েছিলেন। বাংলাদেশের মতো ভাষা শহীদদের স্মরণে উৎসর্গ করা বইমেলার আয়োজন বিশ্ব বইমেলার ইতিহাসে বিরল। ১৯৭২-এর ২১ ফেব্রুয়ারি বাংলা একাডেমী -র সামনে মুক্তধারা প্রকাশনা সংস্থা ছোট পরিসরে বই বিকিকিনি শুরু করে। পরে আরও প্রকাশনা সংস্থা এতে যোগ দেয়। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরের বছর থেকেই এই মেলার গোড়াপত্তন হয়। ১৯৭৮ সাল থেকে বাংলা একাডেমী আনুষ্ঠানিকভাবে এই মেলার আয়োজন করতে শুরু করে। ফেব্রুয়ারি মাস জুড়ে চলা একুশে বইমেলা এশিয়ার অন্যতম বড় বইমেলা। মেলা চলে বাংলা একাডেমী প্রাঙ্গনে ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। মেলায় রয়েছে স্থায়ী ‘নজরুল মঞ্চ’ যেখানে সারা মাস জুড়ে চলে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, রয়েছে ‘লেখক কুঞ্জ,’ যেখানে মেলার দিনগুলিতে লেখকেরা উপস্থিত থাকেন। উল্লেখ করা যেতে পারে ২০২২ সালের মেলায় প্রায় ৫২ কোটি টাকার বই বিক্রি হয়েছিল।

এইগুলি ছাড়াও বিশ্বের নানা প্রান্তে ছোট-বড় অনেক বইমেলা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। যাদের ভাষাগত বৈচিত্র্যের পাশাপাশি পরিকাঠামোগত অনেক বৈচিত্র্যও আছে। যেমন ‘হংকং বইমেলা’-র মূল উদ্দেশ্যই হল কম দামে পাঠকের কাছে বই পৌঁছে দেওয়া। আবার ইতালি শহরের ‘বোলোগ্‌না চিলড্রেন’স বুক ফেয়ার’ শিশুসাহিত্যের সবচেয়ে বড় বইমেলা। পৃথিবীর নানা দেশে এভাবেই বইমেলা বইয়ের দুনিয়ায় হাত ধরে নিয়ে চলেছে প্রজন্মের পর প্রজন্মকে দশকের পর দশক ধরে।

XS
SM
MD
LG