অ্যাকসেসিবিলিটি লিংক

একুশ শতকে পৃথিবীর বিপন্ন মাতৃভাষারা


ইউনেস্কো-র তথ্য বলছে প্রতি বছর গড়ে নয়টি করে ভাষা হারিয়ে যাচ্ছে পৃথিবী থেকে। গত শতাব্দী যেমন ছিল ভাষা আন্দোলনের শতাব্দী, একই সঙ্গে তা ছিল ভাষা বিলুপ্তির সবচেয়ে ভয়াবহ সময়। বিগত একশ বছরে যত মুখের ভাষা হারিয়ে গেছে এবং বিপন্ন হয়ে পড়েছে তার পরিসংখ্যান উদ্বেগজনক। ভাষা ও সাংস্কৃতিক এই বিপন্নতার গুরুত্ব এবং তা প্রতিরোধের প্রয়োজনীয়তা ইউনেস্কো স্বীকার করে নিয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে যদি এই বিলুপ্তি আটকানো না যায় তাহলে আগামী শতাব্দীতে পৃথিবীর অর্ধেকের বেশি ভাষা হারিয়ে যাবে বা মৃত ভাষা হিসেবে থেকে যাবে খাতায় কলমে, সে ভাষা আর কারো মুখের ভাষা বা আদানপ্রদানের ভাষা থাকবে না।

এই মুহূর্তে পৃথিবীতে সাত হাজারের উপর কথ্য ভাষা রয়েছে যার প্রায় তিন হাজারের কাছাকাছি বিপন্ন। ইউনেস্কো এই বিপন্নতার তারতম্য অনুযায়ী চারভাগে ভাগ করেছে তালিকা। ‘ভালনারেবল’ থেকে ‘ক্রিটিকালি এনডেঞ্জারড’ পর্যন্ত। গত একশ বছরে মুখের ভাষার এই অবলুপ্তির পিছনে রয়েছে নানা কারণ। নগরায়ন, শিল্পায়ন, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি থেকে যুদ্ধ, মহামারী এমনকি তথ্যপ্রযুক্তি বিপ্লবও। ইউনেস্কোর তথ্য অনুযায়ী দেখা যাচ্ছে পৃথিবীর সাত হাজার জীবিত ভাষার মধ্যে মাত্র দশটি ইন্টারনেটের ৮০% প্রতিনিধিত্ব করে। শুধুমাত্র কত সংখ্যক মানুষ বলেন একটা ভাষা, সেই দিয়ে বিপন্নতার তীব্রতা বোঝা যায় না। এমন হতে পারে যে লাখের উপর মানুষ কথা বললেও সে ভাষা বিপন্ন হতে পারে যদি দেখা যায় সেই ভাষায় কথা বলা মানুষের পরবর্তী প্রজন্ম সে ভাষা শিখছেন না আর। আবার এমনও হতে পারে মাত্র পাঁচশ জন রয়েছেন কোনো গোষ্ঠীতে এবং তাদের সবাই এমনকি পরবর্তী প্রজন্মও সে ভাষায় কথা বলে তাহলে তাকে সজীব ভাষা বলা যেতে পারে। ভাষার এই বিপন্নতা ঠেকাতে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের গুরুত্ব অপরিসীম, ১৯৯৯ থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ ও ভাষা দিবসকে শ্রদ্ধা জানিয়ে ইউনেস্কো ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষণা করে এবং জাতিসংঘও তাকে স্বীকৃতি দেয় কয়েক বছরের মধ্যে। এই বছরও নানা প্রকল্প ঘোষণা করেছে ইউনেস্কো, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য মাতৃভাষায় শিক্ষার প্রসার ও যেসব ভাষা বিপন্ন তাকে পুনরুজ্জীবিত করা। ইউনেস্কোর তালিকায় থাকা পৃথিবী জুড়ে এমন বিপন্ন ভাষার সংখ্যা প্রচুর, তার কয়েকটা দেখে নেওয়া যাক।

ইয়িডিশ ভাষা: ইয়িডিশ ভাষা ছিল জার্মানির আশখেনাজি ইহুদিদের মুখের ভাষা। নবম শতক থেকে হিব্রু ও জার্মানিক ভাষার মিশ্রণে এই ভাষা তৈরি হয় জার্মানির পশ্চিমে অবস্থিত আশখেনাজি ইহুদির মধ্যে। এই ভাষার অক্ষর হিব্রু। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে দশ লাখের উপর ইয়ডিশ ভাষাভাষী মানুষ ছিলেন, যার মধ্যে কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রে লাখের উপর। হলোকাস্ট ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর ইজরায়েল-এর গঠন এই ভাষার বিপন্নতার সূত্রপাত। নাৎসি হলোকাস্টে জার্মানি, পোল্যান্ড ও পূর্ব ইউরোপে যে ব্যাপক গণহত্যার শিকার হন ইহুদিরা তার সিংহভাগ এই ভাষাভাষী মানুষ। যুদ্ধের পরে নতুন রাষ্ট্র ইজরায়েল তৈরি হলে আরো বহু মানুষ সেখানে চলে যান। যারা চলে যান হিব্রুর প্রভাবে ক্রমশ তাদের পরবর্তী প্রজন্মের থেকে হারিয়ে যেতে থাকে এই ভাষা। এ ছিল আইজ্যাক অ্যাসিমভ, সল বেলো-র মতো সাহিত্যিকের মুখের ভাষা ছিল এবং তারা ছিলেন ইয়িডিশ-এ সাবলীল। অ্যালবার্ট আইনস্টাইন ছিলেন আশখেনাজি ইহুদি। তা সত্ত্বেও একুশ শতকে দেখা যাচ্ছে যে এই ভাষা বলার মানুষ দ্রুত কমছে। রাশিয়াতে ইহুদিদের মধ্যে মাত্র দুহাজার মানুষ কথা বলেন ইয়িডিশ ভাষায়। যুক্তরাষ্ট্রে ২০০০ সালের জন গণনার ছয় বছরের মধ্যে ১৫% কমে যায় এই ভাষায় কথা বলা মানুষের সংখ্যা।

চেরকি ভাষা: আমেরিকান-ইন্ডিয়ান আদিবাসী চেরোকিদের মাতৃভাষা চেরকি, যা প্রায় অবলুপ্তির পথে। মাত্র দেড় থেকে দু-হাজার মানুষ এই ভাষায় কথা বলেন এখন। নর্থ ক্যারোলাইনা আর ওকলাহোমায় অবস্থিত চেরোকি ইন্ডিয়ানদের সংখ্যা তিন লাখের উপর, কিন্তু এই ভাষায় কথা বলতে পারেন ও আদানপ্রদান করেন এমন মানুষ ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছেন। ভাষাবিজ্ঞানীরা মনে করেন গ্রেট লেক রিজিয়ন থেকে এই আদিবাসী সম্প্রদায় পরিযায়ী হয়ে আসে দক্ষিণ পূর্বে, প্রায় তিন হাজার বছর আগে এবং আমেরিকা মহাদেশের নিজস্ব জনজাতির ভাষা হিসেবে এর গুরুত্ব অপরিসীম। উনিশ শতকের গোড়ায় এই মুখেমুখে প্রচলিত ভাষার লিপি তৈরির চেষ্টা করেন চেরকিরা। যদিও খুব ফলপ্রসূ হয়নি সে উদ্যোগ। সেই লিপিকে এখন সংরক্ষণ ও ব্যবহারের চেষ্টা চলছে এবং এই ভাষাকে সজীব রাখার জন্য উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। চেরকি জাতির সম্মিলিত তিন কাউন্সিল, ভাষা মৃত্যুর বিপদ ঘোষণা করে তাকে বাঁচানোর উদ্যোগ নিয়েছে।

মাপুচে ভাষা: দক্ষিণ আমেরিকার চিলি ও আর্জেন্তিনার মাপুচেদের ভাষা মাপুচে। দক্ষিণ আমেরিকার প্রাচীনতম ভাষার একটা মাপুচে, যার অস্তিত্ব ছিল ইনকা সভ্যতার উত্থানেরও আগে থেকে। স্প্যানিশ ঔপনিবেশিক কালেও এক সময় মধ্য চিলির প্রধান ভাষা ছিল মাপুচে। কিন্তু আধুনিক সময়ে যত নাগরিক সংস্কৃতি বেড়েছে ও আদিবাসীর সাংস্কৃতিক যাপন বিলুপ্ত হয়েছে মাপুচের জায়গা নিয়েছে স্প্যানিশ। চল্লিশ বছর আগেও দু-লাখের উপর মানুষ কথা বলতেন এই ভাষায়, অথচ একুশ শতকের শুরুতে দেখা গেছে যে মাপুচে জনসংখ্যার মাত্র ষোল শতাংশ এই ভাষায় কথা বলতে পারে আর আঠারো শতাংশ বুঝতে পারে। স্পেনীয় ঔপনিবেশিক সময়ে এই ভাষা আরাউকানিয়ান নামে পরিচিত ছিল, ঔপনিবেশিক শব্দ বলে আরাউকানিয়ানের বদলে মাপুচে নামে তারা ফিরে যায়। অথচ আশ্চর্যের বিষয় একুশ শতকে এসে দেখা যাচ্ছে এই প্রাচীন ভাষাটি স্প্যানিশ ভাষার প্রভাবে মুখের ভাষা হিসেবে বিলুপ্ত হয়ে যেতে বসেছে।

ককবরক ভাষা: ভারতের উত্তর পূর্বে ত্রিপুরা রাজ্যের জনজাতির প্রাচীন ভাষা ককবরক। ত্রিপুরার সংলগ্ন প্রতিবেশী রাষ্ট্র বাংলাদেশের কিছু অঞ্চলেও এই ভাষাভাষী মানুষ রয়েছেন। এই ভাষা সিনো-টিবেটিয়ান ভাষা গোষ্ঠীর মধ্যে পড়লেও এবং কলোমা নামে লিপি থাকলেও তা অবলুপ্ত। পরবর্তীতে এর দুই লিপি এক রোমান হরফ ও বাংলা হরফ দিয়ে তৈরি। যদিও আট লাখের উপর ককবরক ভাষায় কথা বলেন ভারতে, তবুও একে ইউনেস্কো বিপন্ন ভাষা হিসবেই অভিহিত করেছে।

নুরিস্তানি ভাষা: নুরিস্তানি ভাষা আফগানিস্তানের পূর্ব সীমান্তে, পাকিস্তানের চিত্রল জেলার কাফিরি জনগোষ্ঠীর মুখের ভাষা। দুর্গম পার্বত্য অঞ্চলের উপভাষার বৈচিত্র্যও প্রচুর। এই ভাষা ইন্দো-এরিয়ান ভাষাগোষ্ঠীর অন্তর্গত এবং এর আরেক নাম কাফিরিস্তানি। এই অঞ্চলের প্রাচীন নাম কাফিরিস্তান থেকে এই নাম এসেছে। পরবর্তীতে ইসলাম ধর্ম এখানে প্রধান হয়ে উঠলে এর নাম বদলে নুরিস্তান হয় আর ভাষার নাম নুরিস্তানি। এই প্রত্যন্ত এলাকার খুবই কম সংখ্যক মানুষ কথা বলেন এই ভাষায় এবং ক্রমশ দারি ও পাশ্তো আফগানিস্তানের দুই সরকারি ভাষার প্রভাবে ক্রমশ হারিয়ে যেতে বসেছে নুরিস্তানি, এমনটাই মনে করা হচ্ছে। এই ভাষা নিয়ে গবেষণা করার উপায় না থাকায় এবং সজীব রাখার জন্য কোনো প্রকল্প নেওয়ার সম্ভাবনা না থাকায় আশঙ্কা করা হচ্ছে এই ভাষা হারিয়ে যেতে পারে।

সামি ভাষা: বিস্তীর্ণ স্ক্যান্ডিনিভিয়া জুড়ে একসময় সামি ছিল একটা প্রধান ভাষা। ল্যাপল্যান্ড নামে আগে পরিচিত ছিল যে অঞ্চল তার প্রাচীণ বাসিন্দা সামিভাষী মানুষেরা। ফিনল্যান্ড, সুইডেন, নরওয়ে ও রাশিয়ার কোলা পেনিনসুলায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে এদের বাস এবং জনসংখ্যাও উদ্বেগজনকভাবে কম। সামি-র এগারোটি উপভাষার মধ্যে নয়টিতে এখনো কথা বলেন মানুষ এবং সেগুলোও হারিয়ে যেতে বসেছে। মূলত তাদের যে জীবনচর্যা ছিল বল্গা হরিণ প্রতিপালন ও যাযাবর জীবন, তার পরিবর্তন এই বিপন্নতার বড় কারণ। ইন্দো-ইউরোপিয়ান ভাষাভাষী মানুষের আগমনের বহু আগে থেকে থাকা এই মানুষদের ও তাদের ভাষার মৃত্যু হলে তা ইউরোপ তথা পৃথিবীর বহুমাত্রিক সংস্কৃতির ক্ষতি।

তথ্যসূত্রঃ www.unesco.org, "UNESCO Atlas of the World's Languages in Danger", www.sorosoro.org

www.languageconservancy.org, www.arcticpeoples.com, www.ethnologue.com,

www.britannica.com

XS
SM
MD
LG