অ্যাকসেসিবিলিটি লিংক

ঢাকার গাউছিয়া মার্কেট: নারীদের কেনাকাটার তীর্থস্থান


গাউছিয়া মার্কেটে জুয়েলারি দেখছেন একজন ক্রেতা।
গাউছিয়া মার্কেটে জুয়েলারি দেখছেন একজন ক্রেতা।

কেনাকাটার জন্য ঢাকা নগরীর ব্যস্ততম স্থান ঢাকা নিউ মার্কেট এলাকা। একসময় বলা হতো সেফটিপিন থেকে স্যান্ডেল কেনার একমাত্র ভরসার জায়গা ঢাকা নিউমার্কেট ও তৎসংলগ্ন গাউছিয়া মার্কেট। বাংলাদেশের সবচেয়ে পুরোন ও ঐতিহ্যবাহী বানিজ্যিক স্থান এই মার্কেটগুলো। ইসলাম ম্যানশন, নূর ম্যানশন, চিশতিয়া সুপার মার্কেট, গাউছিয়া মার্কেট, চাঁদনী চকসহ পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে বেশ কয়েকটি মার্কেট। এই মার্কেটগুলোতে সারাদিন থাকে অসংখ্য ক্রেতাদের আনাগোনা। যার মধ্যে নারীক্রেতার সংখ্যাই বেশি। প্রায় প্রতিদিনই ভীড় লেগে থাকে মার্কেটগুলোতে। গাউছিয়া মার্কেট লাগোয়া চাঁদনী চক, গজ কাপড় কেনার জন্য বেশ জনপ্রিয়। এ মার্কেটের নীচতলায় রয়েছে সারি সারি কাপড়ের দোকান। তেমনই একটি দোকানে কাপড় কিনছিলেন সাদিয়া রহমান। সাদিয়া বলেন, “ঢাকা শহরে বেড়ে ওঠা প্রতিটি মেয়ের জীবনের আনন্দ-ভালোবাসার নাম গাউছিয়া মার্কেট, চাঁদনী চক মার্কেট। সালোয়ার কামিজ তৈরির কাপড়, জুতা-স্যান্ডেল, শাড়ি-ব্লাউজ সবকিছু কিনতে এখানে আসা হয়। আর তার সাথে অতি অবশ্যই এখানকার ফুচকা ও লাচ্ছি।”

মার্কেটের গেটের কাছে কেনাকাটা করছিলেন লুবনা ইয়াসমীন। বললেন, “এখন গাউছিয়াতে ঢুকতে ভয় করে। এত বাজে ভাবে দোকানের সংখ্যা বেড়েছে, কোনো কারণে বিপদ আসলে বের হওয়া যাবে না।” আশির দশকের স্মৃতি রোমন্থন করে বললেন, “ছোটবেলায় চাঁদনী চকে জুতা কিনতে আসতাম। গাউছিয়ার পুরোনো দোকান ‘পাকিজা শাড়ি’। সেখান থেকে আম্মা বেশিরভাগ শাড়ি কিনতেন। ধানমন্ডি হকার্স মার্কেটের সামনে গরম গরম জিলাপি খেতে খুব মজা ছিলো। সেই দোকানটা এখনও আছে, কিন্তু আগের মতো বিরাট সাইজও নাই, সেই স্বাদও নাই।”

নগরীর কোথায় এই মার্কেটগুলো

১৯৫০ সালের পরে ঢাকার আজিমপুর ও ধানমন্ডি এলাকাসমূহে বেড়ে ওঠা নতুন জনবসতির চাহিদা পূরণের জন্য বিপনীকেন্দ্র গড়ে তোলার কথা ভাবা হয়। পুরাতন ঢাকা ও নতুন ঢাকার মধ্যে যোগসুত্র স্থাপনের উদ্দেশ্যে ঢাকার প্রাণকেন্দ্রে গড়ে ওঠে বিপনিবিতানগুলো। ১৯৫২ থেকে ১৯৫৪ সাল সময়কালে গড়ে ওঠে ঢাকা নিউমার্কেট। এর অবস্থান ঢাকার আজিমপুরে। নিউমার্কেটের পূর্বদিকে রয়েছে মিরপুর রোড, উত্তরে ঢাকা কলেজ, পশ্চিম পাশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা এবং দক্ষিণ দিকে পিলখানা রোড। ১৯৬০ সালের দিকে নিউ মার্কেটের পূর্ব পাশে মিরপুর রোডের ওপারে গাউছিয়া মার্কেট ও নূর ম্যানশন মার্কেটের কাজ শুরু হয়। অনেকগুলো ধাপ পেরিয়ে এর নির্মাণ কাজ শেষ হয়। এই মার্কেটপ্লেসটি প্রায় ৩৮ হাজার বর্গফুট যার মধ্যে গাউছিয়া মার্কেটের আয়তন প্রায় ২০ হাজার বর্গফুট এবং নূর ম্যানশন প্রায় ১৮ হাজার বর্গফুট। এখানে একে একে আরো গড়ে উঠেছে চিশতিয়া সুপার মার্কেট, হোসাইনিয়া মার্কেট, মেহেরবাপ্লাজা, রহমানিয়া প্লাজা, গোল্ডেনপ্লাজা। এই সাতটি মার্কেট একসাথে এমনভাবে লাগোয়া, বাইরে থেকে দেখলে মনে হয় পুরোটাই একটি মার্কেট।

এই সাতটি মার্কেটের দক্ষিণে চাঁদনী চক মার্কেট। উত্তরে সাইন্স ল্যাব পর্যন্ত আছে ধানমন্ডি হকার্স মার্কেটসহ আরো অনেকগুলো মার্কেট। মার্কেটগুলোর অবস্থান ঢাকার অত্যন্ত ব্যস্ততম এলাকা নীলক্ষেত ও সাইন্সল্যাবের মাঝখানে। মিরপুর রোড ধরে ঢাকা ও এর আশেপাশের স্থানগুলো থেকে সহজেই এই এলাকায় আসা যায়। এমনকি নরসিংদী, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর থেকেও গুলিস্তান হয়ে খুব সহজেই এখানকার মার্কেটগুলোতে আসা যায়। তাই ঢাকা ও ঢাকার আশেপাশের মানুষের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয় স্থান এটি। তবে নগরীর ব্যস্ততম এলাকা হওয়ায় এখানে যানজট লেগেই থাকে।

শাড়ি দেখাচ্ছেন বিক্রেতা। স্থান নূর ম্যানশন।
শাড়ি দেখাচ্ছেন বিক্রেতা। স্থান নূর ম্যানশন।

গাউছিয়া মার্কেটের ব্যবসায়ী ও ঢাকা মহানগর দোকান মালিক সমিতির দপ্তর সম্পাদক মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম জানালেন, “গাউছিয়া সহ এখানকার সাতটি মার্কেটে প্রায় তিন হাজারের মতো দোকান রয়েছে। মার্কেটের দোকানগুলোর এত বেশি হাতবদল হয়েছে যে, এখন আর পুরোনো মালিকদের খুঁজে পাওয়া যাবে না। অনেক দোকানের পুরোনো নাম রয়ে গেছে কিন্তু মালিকানা চেঞ্জ হয়ে গেছে আরো অনেক আগেই। আবার অনেক দোকান মালিকেরা ভাড়া দিয়েছেন, যখন যে ভাড়া নিচ্ছে সে নতুন নাম দিচ্ছে। অনেক দোকান মালিক মারা গিয়েছেন, অনেকের ছেলেমেয়েরা দেশের বাইরে থাকে অথবা ব্যবসা করে না, দোকানগুলো ভাড়া দিয়েছে কিংবা পজিশন বিক্রি করে চলে গেছে।”

কী আছে এখানে

গৃহস্থালি থেকে শুরু করে ব্যক্তিগত ব্যবহারের পন্য, পোশাক, প্রসাধন, প্রয়োজনীয় থেকে সৌখিন সবধরণের পন্য এখানে পাওয়া যায়। রাজধানীর অন্যান্য মার্কেট, বড় শপিংমলের তুলনায় গাউছিয়া ও নিউমার্কেটে সাশ্রয়ী মূল্যে কেনাকাটা করা যায় বলেই এখানকার জনপ্রিয়তা বেশি। গাউছিয়া ও তার আশেপাশের মার্কেটগুলো মূলত সবধরণের কাপড়ের জন্যই প্রসিদ্ধ। এখানে প্রধানত শাড়ি, থ্রি পিস, সালোয়ার-কামিজ, গজ কাপড়, লেস-ফিতা, আন্ডারগার্মেন্টস, বেবি প্রোডাক্ট, কসমেটিকস, জুয়েলারি, বুটিক, ফুড কর্নার রয়েছে। এখানে খুচরা ও পাইকারি পন্যের শত শত দোকান রয়েছে।

সালমা ইয়াসমিন মিরপুরে থাকেন। বললেন, “২০০০ সাল থেকে ২০০৫ সাল পর‌্যন্ত ইডেন কলেজে পড়াকালীন কয়েকজন বন্ধু মিলে নিয়মিত মার্কেটগুলোতে ঢু দিতাম। ঐ সময়টাতে আমার মনে হতো পৃথিবীর যাবতীয় প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিউমার্কেট এলাকায় পাওয়া যায়। এই এলাকায় ফুটপাত জুড়ে যে দোকানগুলো নানারকম জিনিসের পসরা সাজিয়ে বসে থাকে সেগুলো দেখতে আমার ভীষণ ভালো লাগে। গাউছিয়া মার্কেটের ওভার ব্রিজের সিঁড়ির নিচে স্যান্ডেল-জুতার দোকানে নানা বাহারি জুতা হাতে নিয়ে কিংবা পরে দেখতাম আমাকে মানাবে কি না। তখন যে কোনো জুতার দাম ছিলো ১৫০টাকা। আরো কিনতাম ব্যাগ, চুলের ক্লিপ, ছোট্ট কালো টিপ...আরো কত কি ! নিজের প্রয়োজন ছাড়াও বাসার অন্যান্য সদস্যদের এবং প্রতিবেশীদের নানা প্রয়োজনীয় জিনিসের লিস্ট নিয়ে যেতে হতো। তবে এসব শপিংয়ের ফরমায়েশ পেলে খুশিই হতাম।"

মাহমুদা জেসমিন চৌধুরী ১৯৯৯ সাল থেকে কাতারপ্রবাসী। বললেন, “গাউছিয়ায় বস্ত্রবিতান নামে একটি দোকানের কথা বেশি মনে পড়ে। বিরাট দোকান, এমন কোনো গজ কাপড় ছিলো না যেটা পাওয়া যেতো না। এবার দেশে এসে দেখলাম সেই দোকানটি নেই, সে জায়গায় অন্য নামের দোকান। দেশে আসলে এদিকে আসি, পুরোনো জায়গাগুলো ঘুরে ঘুরে দেখি।”

চাঁদনী চক মার্কেটে কাপড় মেলে দেখাচ্ছেন বিক্রেতা।
চাঁদনী চক মার্কেটে কাপড় মেলে দেখাচ্ছেন বিক্রেতা।

ঢাকা শহরের ট্রাফিক জ্যাম ঠেলে এখন অনেকেই নিয়মিত গাউছিয়া যান না। এখন ঢাকা শহরের সব এলাকাতেই রয়েছে ছোট-বড় বিভিন্ন মার্কেট। সময় বাঁচাতে তাই কেনাকাটাগুলো সবাই আশেপাশের মার্কেট থেকেই করেন। আবার অনলাইনে পন্য কেনার সুবিধা হওয়ায় মার্কেটে না গিয়েও ঘরে বসেই পন্য হাতে পাচ্ছেন্ ক্রেতা। এ ক্ষেত্রে পিছিয়ে নেই গাউছিয়ার দোকানিরা। অনেক পোশাক- শাড়ির খুচরা ও পাইকারি বিক্রির দোকান তাদের ফেসবুক পেজ, ইউটিউব চ্যানেল থেকে নিয়মিত লাইভ ও আপডেট দিয়ে ক্রেতাদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করেন। ক্রেতারাও ঘরে বসে তাদের পছন্দের পন্য অর্ডার করতে পারছেন। নূর ম্যানশনের বুটিক হাউস “নিবিড় ফ্যাশন”এর একজন কর্মী জানালেন, এই বুটিকটি ২০০৮ সালে প্রতিষ্ঠিত। মূলত বিয়ে ও উৎসবের পোশাক বিক্রি করেন তারা। ক্রেতাদের দ্রুত সেবা প্রদান ও পন্যের প্রচারের লক্ষ্যে ২০১৮ সাল থেকে এই বুটিকের অনলাইন যাত্রা শুরু হয়। এরপর এতটাই ভালো সাড়া পেয়েছে যে, ঢাকা শহরের বিভিন্ন এলাকায় বেশ কিছু আউটলেট খুলেছে “নিবিড় ফ্যাশন”।

সাশ্রয়ী ও সুলভ মূল্যে ফ্যাশনেবল পোশাক, জামা, স্যান্ডেল ও আনুষাঙ্গিক পাওয়া যায় বলে মধ্যবিত্ত নারীদের কাছে গাউছিয়া মার্কেট এখনো সমান জনপ্রিয়। কথা হয় ফারহানা লিজার সঙ্গে। বললেন, “বরের চাকরির সুবাদে মানিকগঞ্জ থাকি। ৩-৪ মাসে একবার ঢাকায় আসি। ঢাকায় এলেই গাউছিয়া, চাঁদনী চক মার্কেট থেকে নিজের ও বাচ্চাকাচ্চাদের জন্য জামাকাপড় কিনে নিয়ে যাই। আর নিউমার্কেট থেকে সংসারের অনেক প্রয়োজনীয় জিনিস কিনি। এখন সব জায়গাতেই সবকিছু পাওয়া যায় ঠিকই কিন্তু ঢাকার নিউমার্কেট, গাউছিয়া মার্কেট ও এর আশেপাশের মার্কেটের দোকানগুলোতে অন্যান্য জায়গার চেয়ে কমমূল্যে কেনা যায়। একই পন্যের অনেক ভ্যারাইটিও এখানে পাওয়া যায় ফলে পন্য যাচাই বাছাই করে কেনা সম্ভব হয়।”

খোলা-বন্ধের দিন

ধানমন্ডি, পান্থপথ, কলাবাগান, এ্যালিফেন্ট রোড, আজিমপুর এলাকার সব মার্কেট মঙ্গলবার পূর্ণ দিবস ও বুধবার অর্ধদিবস বন্ধ রাখা হয়। তাই গাউছিয়া মার্কেট এই কর্মসূচিতে পড়ে। তবে বিভিন্ন উৎসবে মার্কেট কমিটি সরকারের অনুমতিসাপেক্ষে সাপ্তাহিক ছুটির দিনেও মার্কেট খোলা রাখে। যেহেতু এ সময়গুলোতে কেনাকাটা সবচেয়ে বেশি হয়।

খাবার দাবার

ধানমন্ডি হকার্স মার্কেটের কোণাটা সব সময় থাকে জমজমাট। পথচলতি মানুষ সেখানে একবার থামবেই। এখানে একটা বড় গামলায় মাখা হচ্ছে সবজির পাকোড়া। খুব ছোট ছোট পাকোড়া তেলে ভেজে ছোট ছোট প্লেটে তুলে তার ‍ওপর তেতুলের চাটনি দিয়ে গরম গরম পরিবেশন করা হয়। একদম রাস্তার পাশে ভাজা হচ্ছে গরম জিলাপি। জিলাপি সিরাতে ডুবিয়েই উঠিয়ে দেয়া হয় ক্রেতাদের পাতে। আর সেই গরম জিলাপির কী স্বাদ!

বহু বছর ধরেই এখানে এই খাবারের দোকানটি আছে। শুধুমাত্র এ দুটো আইটেমই তারা নিয়মিত করে থাকেন।

ধানমন্ডি হকার্স মার্কেটের কোণায় ভাজা হচ্ছে সবজির পাকোড়া ও জিলাপি।
ধানমন্ডি হকার্স মার্কেটের কোণায় ভাজা হচ্ছে সবজির পাকোড়া ও জিলাপি।

এই এলাকার খাবার নিয়ে কথা বলেছিলাম কয়েকজনের সঙ্গে।

হকার্স মার্কেটের সবজির বড়া খেতে খেতে সৈয়দা আক্তার স্বপ্না বললেন, “সেই ১৯৯২ সাল থেকে মানে এখন পর্যন্ত মার্কেট মানে নিউ মার্কেট, গাউছিয়া, চাঁদনী চক আর হকার্স মার্কেট। আমার খালারাও উত্তরা থেকে এখানে শপিংয়ে আসে। এখানকার সবজির বড়া, গরম গরম জিলাপি, কলিজার সিঙাড়া আর নিউমার্কেটের ফুচকা ও লাচ্ছি আমার খুব প্রিয়।”

গৃহিনী তিথী ফারহানার (বয়স ৩৮) মনের কোণে অনেক স্মৃতি জমে আছে। বললেন, “ইডেন কলেজে ভর্তি হওয়ার পরে আমরা দুষ্টুমি করে বলতাম, গাউছিয়ায় অনার্স করি। পাঁচ বান্ধবী ছিলাম, প্রতিদিনই কারো না কারো প্রয়োজনে গাউছিয়া যেতে হতো। নিউমার্কেটে ঘোড়ার ডিম নামে একটা বিস্কিট টাইপ খাবার (মেরাং কুকিজ) পাওয়া যেতো। এটা কিনতেই হতো। নিউ মার্কেটের ব্রিজের নিচে কিংসের ফুচকা-চটপটি, গেটের কাছের আমসত্ব, হকার্সের ছোট পাকোড়া ও জিলাপি এখনও খাওয়া হয়।” আবার বুয়েটের শিক্ষার্থী জামান আরিফার কছে প্রিয় নীলক্ষেতের তেহারি।

ষাটের দশকে জনপ্রিয় দোকান ছিলো নিউমার্কেটের নোভাল্টি আইসক্রিম। গাউছিয়ায় জনপ্রিয় দোকান ছিলো ফ্লেমিংগো। লাচ্ছি, ফালুদা, আইসক্রিম, ফুচকার জন্য সেই ষাটের দশক থেকে আজ অবধি জনপ্রিয় গাউছিয়া, নিউমার্কেটের দোকানগুলো।

বাজে অভিজ্ঞতা

তবে পরিবেশ নিয়ে অভিযোগ আছে অনেকরই। অনেকের মতেই এইসব এলাকায় বিশেষত গাউছিয়া, নূর ম্যনশন এইসব মার্কেটে হাঁটাচলা করার পরিবেশ নেই। তিথী ফারহানা বললেন, “গাউছিয়া ও হকার্স মার্কেটে কিছু বাজে অভিজ্ঞতা আগেও ছিলো, এখনো আছে। এখানে একদল বিকৃত মানসিকতার পুরুষ ভিড়ের মধ্যে ঘোরাফেরা করে। এরা কোনো দোকানে ঢুকে না। ব্যাগ কাটা, মোবাইল ফোন নেয়া এগুলোও তাদের উদ্দেশ্য না। ভিড়ের মধ্যে মেয়ের শরীরে অনাকাঙ্খিতভাবে স্পর্শ করাই এদের মুখ্য উদ্দেশ্য থাকে। কলেজে পড়ার সময় আমরা কলেজ ব্যাগ সামনে নিয়ে হাঁটতাম, আর চেষ্টা করতাম মেয়েদের মাঝখানে থাকতে যাতে সামনে বা পেছন থেকে কেউ বাজেভাবে স্পর্শ করতে না পারে।”

ইডেন মহিলা কলেজের শিক্ষার্থী ছিলেন সাইদা ইসলাম । তার অভিজ্ঞতা থেকে বললেন, “গাউসিয়া থেকে চাঁদনী চক যাওয়ার যে রাস্তাটা ওটা পার হওয়া ছিল সবচেয়ে কঠিন কাজ। এখনো মনে আছে ওই জায়গাটা পার হওয়ার সময় ব্যাগটা বুকে দুই হাত দিয়ে চেপে ধরে চোখে মুখে একটা রাগি রাগি ভাব নিতাম। কিভাবে যেন উল্টো দিক থেকে আসা বাজে মনোভাবের লোকের চেহারা দেখেই বুঝতাম। তখন সরাসরি রাগান্বিত চোখে তাকাতাম, এটা খুব কাজে দিত।”

আন্ডার গার্মেন্টেসের দোকানগুলোতে রয়েছে নারী বিক্রেতা। তাই নারী ক্রেতারাও স্বচ্ছন্দে কেনাকাটা করছেন।
আন্ডার গার্মেন্টেসের দোকানগুলোতে রয়েছে নারী বিক্রেতা। তাই নারী ক্রেতারাও স্বচ্ছন্দে কেনাকাটা করছেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সাদিয়া রহমান বললেন, “অনেক সময় দোকানের কর্মচারীরাও অনেক খারাপ ব্যবহার করে। পন্য পছন্দ না হলে বা দাম পছন্দ না হলে , চলে যেতে উদ্যত হলেই পেছন থেকে আজেবাজে কথা বলতে থাকে। তবে ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীদের সাথে দোকান মালিকদের গন্ডোগোলের পরে এবং আরো কয়েকটি ঘটনায় কিছু দোকানীর বিরুদ্ধে পুলিশ কমপ্লেইনের পর এ আচরণের অনেকটা পরিবর্তন ঘটেছে।”

মারাত্মক অগ্নি-ঝুঁকিতে এই মার্কেটগুলো

২০১৮ সালে বাংলাদেশ ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স টিম ঢাকার মোট ১৮০৫টি মার্কেটে জরিপ চালায়। জরিপে দেখা যায়, এর মধ্যে ১৮০০টি মার্কেটই অগ্নি-ঝুঁকিপূর্ণ। সবচেয়ে মারাত্মক ঝুঁকিতে আছে ৬০০ শপিং কমপ্লেক্স। সেই ঝুঁকিপূর্ণ মার্কেটগুলো মধ্যে অন্যতম গাউছিয়া, নূর ম্যানশন, চাঁদনীচক মার্কেট। ফায়ার সার্ভিসের প্রতিবেদন অনুসারে এসব শপিং মলে অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থা নেই। অক্সিজেন সিলিন্ডার, পানির রিজার্ভ ট্যাংক, বালুভর্তি বালতি ও রেসকিউ সিঁড়িসহ অন্যান্য অগ্নিনির্বাপণ সামগ্রীও নেই।

এরপর আবার ২০১৯ সালের ৫ এপ্রিল বাংলাদেশ ফায়ার সার্ভিসের পরিদর্শন টিম রাজধানীর গাউছিয়া মার্কেটের নূর ম্যানশন শপিং কমপ্লেক্সকে অতি ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করে ভবনের প্রবেশমুখে লাল রঙের ব্যানার টাঙিয়ে দেয়। ফায়ার সার্ভিস টিম তখন জানায়, অগ্নি নিরাপত্তার সরঞ্জাম স্থাপন করা হলে ব্যানার সরিয়ে নেয়া হবে। সে বছর এর আগে ৩১ মার্চ তারিখেও একবার এমন ব্যানার টাঙানো হয়েছিলো যা পরদিনই মার্কেটের ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে ছিঁড়ে ফেলা হয়েছিলো। মার্কেটের ব্যবসায়ী সমিতির পক্ষ থেকে বারবারই দাবী করা হয়েছে মার্কেটটিতে আগুন লাগার ঝুঁকি নেই।

এই প্রতিবেদক সরেজমিনে দেখতে পান, ৬ তলা বিশিষ্ট নূর ম্যানশনের ১ম থেকে ৪র্থ তলা পর্যন্ত ৩৯১টি কাপড়-চোপড় ও ফেব্রিক্সের দোকান আছে। বাকি ৫ম ও ৬ষ্ঠ তলায় গার্মেন্টস কারখানা। পুরো মার্কেট কাপড়চোপড়ে ভরা। প্রায় একই অবস্থা গাউছিয়া, চাাদনীচক, চিশতিয়া ইত্যাদি সব লাগোয়া মার্কেটগুলোতেও। এ মার্কেটগুলোয় একাধিক সিঁড়ি থাকলেও সেগুলো বেশ সংকীর্ণ। গাউছিয়া ও নূর ম্যানশনের এই সংকীর্ণ সিঁড়িগুলোতেই আবার ছোটখাটো দোকান। ফলে একসাথে অনেক মানুষ জরুরি অবস্থায় বের হওয়ার সুযোগ নেই। কোনো জরুরি বহির্গমনের সিঁড়িও নেই। অথচ মার্কেটগুলোতে প্রতিদিন হাজার মানুষের সমাগম ঘটে। এত জনাকীর্ণ বিপনিবিতানগুলোর কোথাও ফায়ার এক্সটিংগুইশার (অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র) চোখে পড়ে না।

XS
SM
MD
LG