ভারতে কর্নাটকে বিধানসভা ভোটের দিন ঘোষণার মুখে রাজ্যে সরকারি চাকরি ও শিক্ষায় মুসলিমদের জন্য বরাদ্দ চার শতাংশ সংরক্ষণের সুবিধা বাতিল করে দিয়েছে রাজ্যের বিজেপি সরকার। সেখানে বিধানসভা নির্বাচনের প্রচারে কংগ্রেস-সহ বিরোধী দলগুলির অন্যতম ইস্যু বিজেপি সরকারের এই সিদ্ধান্ত।
মুসলিমদের সংরক্ষণ বাতিলের সিদ্ধান্ত যে শুধু ভোটমুখী কর্নাটকেই সীমাবদ্ধ থাকবে না তা স্পষ্ট হয়েছে গত সপ্তাহে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের কর্ণাটকের পার্শ্ববর্তী রাজ্য তেলেঙ্গানা সফরে। শাহ সেখানে গিয়ে ঘোষণা করে এসেছেন, তেলেঙ্গানায় বিজেপি সরকার গড়া মাত্র মুসলিমদের জন্য বরাদ্দ সংরক্ষণ বাতিল করে দেবে। এ বছরই এই রাজ্যেও বিধানসভার ভোট আছে। অমিত শাহ জোর গলায় ঘোষণা করেছেন, বিজেপি ধর্মের ভিত্তিতে সংরক্ষণ মানে না।
এই ব্যাপারে প্রস্তুতি নিচ্ছে পশ্চিমবঙ্গের বিজেপিও। দলের ওবিসি মোর্চার নেতারা বাংলায় অন্যান্য অনুন্নত শ্রেণির তালিকায় মুসলিমদের জন্য বরাদ্দ সংরক্ষণ বাতিলের দাবি নিয়ে হাইকোর্টে যাওয়ার প্রস্তুতি নিয়েছে। রাজভবন থেকে সবুজ সংকেত পেলেই রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোসের দরবারেও হাজির হবেন মোর্চার নেতারা।
যদিও পশ্চিমবঙ্গে ওবিসি তালিকায় মুসলিমদের যে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের নাম রয়েছে তাদের ধর্মের কারণে বাছা হয়নি। আসলে অন্যান্য অনুন্নত শ্রেণি বা ওবিসি হিসাবে চিহ্নিত হওয়ার মাপকাঠিই হল আর্থ-সামাজিকভাবে পশ্চাৎপদ হয়ে থাকা। সেখানে জাত-ধর্ম বিচারেরও কোনও বিধান নেই। ধর্ম নির্বিশেষে আর্থিকভাবে পিছিয়ে থাকা অংশের মানুষ এই তালিকার অন্তর্ভুক্ত হতে পারেন। এই তালিকাভুক্ত গোষ্ঠী/সম্প্রদায়ের মানুষ রাজ্য সরকারের চাকরি ও শিক্ষায় ১৭ শতাংশ পদ/আসনে সংরক্ষণের সুবিধা পান।
পশ্চিমবঙ্গে বার্ষিক আয় এবং সামগ্রিক পশ্চাৎপদতার নিরিখে ওবিসি-দের ‘এ’ এবং ‘বি’ এই দুটি ক্যাটাগরিতে ভাগ করা হয়েছে। এ ক্যাটাগরিতে অন্তর্ভুক্ত ৯২টি সম্প্রদায়ের জন্য ১০ শতাংশ সংরক্ষণ বরাদ্দ। বাকি সাত শতাংশ বরাদ্দ বি ক্যাটাগরিতে থাকা ২৪টি সম্প্রদায়ের জন্য।
দেড় দশক আগে সাচার কমিটির রিপোর্টে বলা হয়েছিল বাংলায় মুসলিমরা আর্থ-সামাজিকভাবে সবচেয়ে পিছিয়ে। রাজ্যের ওবিসি তালিকা বর্তমানে তার প্রমাণ। আর্থিক অনগ্রসরতার নিরিখে এমন অনেক পেশায় যুক্ত সম্প্রদায় ওবিসি তালিকাভুক্ত হয়েছে যেগুলিতে গরিব মুসলিমরাই বেশি সংখ্যায় যুক্ত। দুই ক্যাটিগরি মিলিয়ে মুসলিমরা অর্ধেকের বেশি। হিন্দু, শিখ, খ্রিস্টান সম্প্রদায়েরও বেশ কিছু গোষ্ঠীর নাম বাংলার ওবিসি তালিকায় আছে।
পশ্চিমবঙ্গের বিজেপির ওবিসি মোর্চার দাবি, রাজ্যের ওই তালিকা বাতিল করতে হবে। মোর্চার সাধারণ সম্পাদক প্রসেনজিৎ ঘোষ বলেন, "আমরা রাজ্য সরকারকে একাধিকবার বলেছি, রাজ্যের তালিকা মুসলিমদের বাড়তি সুবিধা পাইয়ে দেওয়ার উদ্দেশে তৈরি হয়েছে। এই তালিকা বাতিল করতে হবে।"
বিজেপির ওবিসি মোর্চার দাবি, "জাতীয় ওবিসি কমিশনের তালিকায় ১৬টি এমন পেশার উল্লেখ আছে যেগুলি বাংলার তালিকাতেও আছে। ওই পেশাগুলিতে মুসলিমরাই বেশি সংখ্যায় যুক্ত। বাংলায় কেন্দ্রীয় কমিশনের তালিকা মেনে মুসলিমদের সংরক্ষণের সুবিধা দিলে আমাদের আপত্তি নেই। কিন্তু বর্তমান ওবিসি তালিকায় চোখ বুলিয়ে যে কেউ বুঝতে পারবেন সেখানে হিন্দুরা অত্যন্ত বঞ্চিত। মুসলিমরা বেশি সংখ্যায় যুক্ত এমন কিছু পেশা ও সম্প্রদায়কে ওবিসি তালিকায় স্থান করে দেওয়া হয়েছে।"
প্রসেনজিৎ ঘোষের বক্তব্য, "আমরা মুসলিমদের সংরক্ষণের সুবিধা কেড়ে নিতে চাই না। গোটা দেশের মতো বাংলাতেও সাধারণ ক্যাটিগরিতে ১০ শতাংশ আসন/পদ আর্থিকভাবে পিছিয়ে থাকা প্রার্থীদের জন্য সংরক্ষিত। মুসলিমরা সেই সংরক্ষণের সুবিধা পেতে পারে।" তাঁর বক্তব্য, কর্নাটকেও মুসলিমদের সংরক্ষণ কেড়ে নেওয়া হয়নি। তাদের সংরক্ষণের নিয়ম বদল করা হয়েছে। দরিদ্র মুসলিমরা সাধারণ ক্যাটিগরির জন্য বরাদ্দ ১০ শতাংশ সংরক্ষণের সুবিধা ওই রাজ্যেও পাবেন।
বাংলায় ওবিসি সংরক্ষণ চালু হয়েছিল বামফ্রন্ট আমলে প্রক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যর সময়ে। গোড়ায় ১০ শতাংশ সংরক্ষণের ব্যবস্থা হয়। পরে তা বৃদ্ধি করে ১৭ শতাংশ করেন তিনি। তাঁর সময় থেকেই ওবিসি কমিশন গড়ে বিভিন্ন সম্প্রদায়কে তালিকাভুক্ত করার কাজ শুরু হয়।
তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ক্ষমতায় আসার পরও তালিকা তৈরির কাজ পুরোদমে চলছে। বর্তমানে প্রায় ১৭১টি সম্প্রদায়/গোষ্ঠীর নাম রাজ্যের ওবিসি তালিকায় রয়েছে। কলকাতা হাইকোর্টের আইনজীবী কার্তিকচন্দ্র কাপাসের দাবি, ওবিসি তালিকায় মুসলিমদের বাড়তি সুবিধা দেওয়া হয়েছে অভিযোগ করে তিনি অনেক আগেই মামলা করেছেন। বেশ কয়েকবার শুনানির পর মামলা আর এগোয়নি। বিজেপির ওবিসি মোর্চার সাধারণ সম্পাদকের দাবি, তারা মামলার কাগজপত্র তৈরি করেছেন। তার আগে রাজ্যপালের সঙ্গে দেখা করে তাঁকে এই বিষয়ে অবহিত করতে চান।
এই ব্যাপারে রাজ্যের অনগ্রসর শ্রেণি কল্যাণ দফতরের মন্ত্রী বুলু চিক বরাইকের বক্তব্য জানার চেষ্টা হয়েছিল। কিন্তু পাওয়া যায়নি।