"আমি আকাশ (ছদ্মনাম), আমার বয়স ২২ বছর। ছোটবেলা থেকেই আমার বোনদের ছোট ছোট শাড়ি, তাদের পোশাক, প্রসাধনী আমার অনেক ভালো লাগত । আমিও এখনো আমার পোশাকে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি না। ছোটবেলায় গাছের ফুল, কাগজ কেটে গয়না বানাতাম, লুকিয়ে লুকিয়ে শাড়ি পড়তাম আর আম্মুর লিপস্টিক লাগাতাম। প্রত্যেকটা লিপস্টিকে একটা ঘ্রাণ রয়েছে, সেই সুগন্ধে আমি আমার সত্ত্বাকে খুঁজে পাই।
একদিন এমন অবস্থায় আমার ছোট চাচা দেখে ফেললেন, আব্বুর কাছে নালিশ দিলেন। আব্বু আমাকে প্রচণ্ডভাবে মারলেন। আব্বুর হাতের পাঁচ আঙ্গুলের ছাপ আমার গালে ও পিঠে খুব স্পষ্টভাবে অনেকদিন ছিল। আমার গলা ধরে ছুড়ে মারল দেওয়ালে। মাথা ফেটে এককোণ দিয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়লো। আমার দুচোখ দিয়ে অবিরল কান্নার ধারা আর মাথা থেকে বেরিয়ে আসা রক্ত যেন মিলে মিশে একাকার হয়ে গেল।
আম্মু এভাবে রক্ত বেরিয়ে আসা দেখে আমাকে জড়িয়ে ধরলো বলল “রবিনের আব্বু তোমার আল্লাহর দোহাই লাগে তুমি আর ওকে মাইরো না। ও ছোট মানুষ, ও এত কিছু বোঝে না”। তারপর আব্বু আম্মুকেও মারল। আমি অনেক ভয় পাচ্ছিলাম এরপর আম্মুর কান্নার আওয়াজ শুনতে শুনতে আমার চোখের চারপাশ অন্ধকার হয়ে আসছিলো। আমার যখন জ্ঞান ফিরল, তখন আমি হাসপাতালের বেডে।
তারপর থেকে এই শাড়ি, প্রসাধনী দেখলে আমার ভয় লাগে আর লিপস্টিক এর মাঝে আমি রক্তের ঘ্রাণ পাই”।– কথাগুলো লিখেছেন বাংলাদেশের এলজিবিটিকিউ সম্প্রদায়ের একজন। এবং এই ধরণের ঘটনা বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে নিয়মিতই ঘটে থাকে।
বহুজাতিক মার্কেট রিসার্চ কোম্পানি ইপসোস গ্রুপ (IPSOS Group)-এর গবেষণায় উঠে এসেছে বিশ্বের ২০ শতাংশ মানুষ এলজিবিটিকিউ সম্প্রদায়ের। এদিকে সমাজসেবা অধিদপ্তরের জরিপমতে বাংলাদেশে হিজড়াদের সংখ্যা ১০ হাজারের একটু বেশি, সমকামী এবং উভকামীদের সংখ্যার কোন হিসাব পাওয়া যায় নি। কিন্তু আমরা যদি ইপসোসের রিসার্চটি বাংলাদেশের জন্যেও গ্রহণযোগ্য ধরে নেই তবে বাংলাদেশের ১৭ কোটি মানুষের মধ্যে প্রায় সাড়ে তিন কোটি মানুষ এই সম্প্রদায়ের। কিন্তু বাংলাদেশ সরকার কি তাদের স্বীকৃতি দিতে প্রস্তুত? মানবাধিকারের বৈশ্বিক মানদণ্ডে বাংলাদেশ কতটুকু পিছিয়ে আছে?
২০২২ সালে যুক্তরাষ্ট্র যখন বাংলাদেশের মানবাধিকার নিয়ে রিপোর্ট প্রকাশ করে, তখন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম বলেন, "এই রিপোর্টে সমকামিতার বৈধতা নিয়ে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়টি বলা হয়েছে। আপনি একটি মুসলিম দেশ দেখান, যেখানে সমকামিতাকে বৈধতা দেওয়া হয়েছে। এটি আমাদের ইসলাম ধর্মের পরিপন্থী এবং আমার ধারণা এটা সব ধর্মের পরিপন্থী।" অথচ তুরস্ক, লেবানন, বাহরাইন সহ বেশ ক’টি মুসলিম দেশ সমকামীতাকে বৈধতা দিয়েছে।
এ প্রসঙ্গে পররাষ্ট্র মন্ত্রী আব্দুল মোমেন বলেন, “বাংলাদেশ সরকার মনে করে যে, মানবাধিকার লঙ্ঘনের নামে অন্যান্য দেশের মূল্যবোধ যেমন- এলজিবিটি অধিকার, সমকামী বিবাহ ইত্যাদি চাপিয়ে দেয়ার প্রবণতা দুঃখজনক এবং অযাচিত। তারা মানবাধিকারের নামে আমাদের ধর্মকে আঘাত করতে চায় এবং আমরা তা প্রত্যাখ্যান করেছি।"
এলজিবিটিকিউ সম্প্রদায়ের মানবাধিকার এবং মর্যাদা নিয়ে যারা কাজ করছেন, তারা মনে করেন, বাংলাদেশ এখনও অনেক পিছিয়ে আছে এবং চরমপন্থী মুসলমান জনগোষ্ঠীর কারণে আরও দুঃসাধ্য এবং সময়সাপেক্ষ হবে এই সম্প্রদায়ের মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াই। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এই সম্প্রদায়ের মানুষদের প্রতিনিয়তই বৈষম্য, হয়রানি এবং সহিংসতার সম্মুখীন হতে হয়। এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কর্তৃপক্ষ থাকে মুখ ফিরিয়ে।
কথা হচ্ছিল এলজিবিটিকিউ কমিউনিটির একটি সংস্থার সংগঠক, অয়ন (ছদ্মনাম)-এর সাথে। তিনি জানালেন, ২২ বছর বয়সী আকাশের মতো বাড়ি থেকে মারধোরের শিকার হতে হয় নি তাকে। কিন্তু তার মানে এই নয় যে স্বাভাবিক ভাবে মেনে নিয়েছে তাঁর পরিবারের মানুষগুলো।
“সবাই আমার মতো প্রিভিলেজড না। চাইলেই পড়াশোনা করে দেশের বাইরে চলে যেতে পারে না তারা। পারিবারিক এবং সামাজিক বিড়ম্বনা নিত্যদিনের ঘটনা তাদের জন্য। তার ওপর আছে ইসলামিক কট্টরপন্থীদের হাতে জীবন হারানোর ভয়”- বললেন অয়ন।
আনুষ্ঠানিকভাবে হিজড়াদের স্বীকৃতি
২০১৩ সালের নভেম্বর মাসে বাংলাদেশ সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে হিজড়াদের স্বীকৃতি দেয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয়। হিজড়াদের স্বীকৃতি দেয়া হলেও সরকারী কার্যালয়গুলোর নিজেদের মধ্যে সমন্বয় না থাকায় দেখা যায় নানা অসঙ্গতি। পাসপোর্টে লিঙ্গের জায়গায় নারী, পুরুষের পাশাপাশি রয়েছে ‘এক্স (X)’। আবার জাতীয় পরিচয়পত্রের ক্ষেত্রে লিঙ্গের জায়গায় নারী ও পুরুষের পাশাপাশি হিজড়া নির্বাচন করার ব্যাবস্থা আছে। এদিকে এসএসসি ও এইচএসসির ফর্মের ক্ষেত্রেও নারী ও পুরুষের বাইরে আর কোন লিঙ্গ নির্বাচন করা যায় না। এর ফলে পড়াশোনার সার্টিফিকেট, পাসপোর্ট ও জাতীয় পরিচয়পত্রের তথ্যে গড়মিল হয় এবং তা পরবর্তীতে বিদেশ যাওয়ার ক্ষেত্রে নানা রকমের বিড়ম্বনা তৈরি করে থাকে। এছাড়াও, সরকারী চাকরিতে আবেদনের ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য পরীক্ষার সময় নানাভাবে লাঞ্ছিত হতে হয় হিজড়া সম্প্রদায়ের মানুষদের। কাগজে কলমে তাদের স্বীকৃতি দেয়া হলেও সমাজের প্রতিটি স্তরে এখনও রয়েছে বৈষম্য ও হয়রানি।
“সরকার আমাকে হিজড়া লিঙ্গ হিসেবে চেনে, সাধারণ মানুষ আমাকে Third Gender হিসেবে চেনে, ডাক্তারের কাছে গেলে তারা বলে Disorder of Sex Development (DSD)। কিন্তু এগুলোর কোনোটাই আমি নই। আমি একজন Intersex মানুষ। প্রতিটি Intersex মানুষ সুস্থ ও স্বাভাবিকভাবে প্রাকৃতিক নিয়মে জম্নগ্রহণ করে। তাই তাদেরকে সেভাবেই বাঁচতে দেয়া উচিত”।– বলেন আকাশ (ছদ্মনাম)।
সমকামীতা বাংলাদেশে শাস্তিযোগ্য অপরাধ
এদিকে সমকামী ও উভকামী জনগোষ্ঠীর জন্য সরকারের দিক থেকে কোন ধরণের কাজই করা হয়নি এখন পর্যন্ত, জানালেন অয়ন- “বিভিন্ন দাতা সংস্থা থেকে ছোট কমিউনিটি লেভেলে কিছু কিছু কাজ হয় শহরগুলোতে কিন্তু পলিসি লেভেলে সেভাবে কোন কাজ হচ্ছে না”। উপরন্তু, সমকামীতা এখনও বাংলাদেশে শাস্তিযোগ্য অপরাধ। বাংলাদেশ দন্ড বিধির ৩৭৭ ধারা অনুযায়ী যে ব্যক্তি স্বেচ্ছাকৃতভাবে কোন পুরুষ,নারী বা জন্তুর সহিত,প্রাকৃতিক নিয়মের বিরুদ্ধে যৌন সহবাস করে সেই ব্যক্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে বা যেকোন বর্ণনার কারাদণ্ডে–যার মেয়াদ দশ বছর পর্যন্ত হতে পারে-দন্ডিত হবে এবং তদুপরি অর্থদণ্ডেও দণ্ডনীয় হবে। যদিও প্রাকৃতিক নিয়ম বিরুদ্ধ যৌন সহবাসের সর্বজনীন স্বীকৃত সংজ্ঞা এখনো নির্ণীত হয়নি। এই ৩৭৭ ধারা বাতিলের জন্য বিভিন্ন সংগঠন থেকে ইউ পি আর চলাকালীন সময়ে দাবি তোলা হয়েছে, যা সরকার পক্ষ থেকে বারবার নাকচ করে দেওাা হয়েছে। কিন্তু ধারাটি বাতিল হলেও সামগ্রিকভাবে সামাজিক সচেতনতা তৈরি না হলে কোন কাজের কাজ হবে না বলে মনে করেন অয়ন। পৃথিবীর অনেক দেশেই (যেমন সাউথ আফ্রিকা) ধারাটি বাতিল হলেও দৃশ্যমান কোন পরিবর্তন আসেনি এলজিবিটিকিউ সম্প্রদায়ের মানুষের জীবনে। অয়নের মতে, “এই সম্প্রদায়ের মানুষের মুখ্য প্রয়োজন একটি ভালো চাকরি, বাসা থেকে বের করে দিলে একটি থাকার জায়গা, মর্যাদাপূর্ণ স্বাস্থ্য সেবা, নিরাপদে মন খুলে কথা বলার মতো এক বা একাধিক সেইফ স্পেইস, এই বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করতে পারার স্বাধীনতা ইত্যাদি। ৩৭৭ ধারা বাতিলের পাশাপাশি এই জিনিসগুলে নিয়ে একসাথে কাজ করতে হবে”।
এলজিবিটিকিউ কমিউনিটির বিভিন্ন সংস্থার সংগঠক, কর্মী ও সদস্যরা মনে করেন মূলত পাঁচটি বিষয় নিয়ে কাজ হতে পারে- স্বাস্থ্য, আইন ও সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়গুলোর নিজেদের মধ্যে সমন্বয় এবং সচেতনতা বৃদ্ধি, মাধ্যমিক পর্যায়ে যৌন শিক্ষা পাঠ্য-পুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করা এবং চরমপন্থীদের চাপের মুখে তা অপসারণ না করা, সরকারী নীতিমালা তৈরির ক্ষেত্রে নিজেদের প্রতিনিধিদের পাশাপাশি এই সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিদের মতামত গ্রহণ করে নীতিমালা প্রণয়ন করা, মন খুলে কথা বলার জন্য নিরাপদ স্থান তৈরি করা যেখানে নানা ধরণের আলোচনা, বিতর্ক, অনুষ্ঠান, নাটক ইত্যাদি আয়োজন করা সম্ভব, বিভাগীয় শহরগুলোতে মানসিক স্বাস্থ্যের চিকিৎসক নিয়োগ করা ও সমকামী বান্ধব সব ধরণৈর স্বাস্থ্যসেবা।
সামনে নির্বাচন। নির্বাচন পরিচালনা বিধিমালার মনোনয়নপত্রে ‘লিঙ্গ’ পরিচয়ে সংশোধন এনে ‘পুরুষ’ ও ‘মহিলা’র পাশাপাশি ‘হিজড়া’ যুক্ত করা হয়েছে, যার ফলে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ‘হিজড়া’ পরিচয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবেন হিজড়া পরিচয়ের নাগরিকরা। নির্বাচন কমিশন সচিব মো. জাহাংগীর আলম স্বাক্ষরিত এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন ২৩ ফেব্রুয়ারি গেজেট আকারে প্রকাশ করা হয়। গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) এর ক্ষমতাবলে বিধিমালায় এই সংশোধন এনেছে নির্বাচন কমিশন। কিন্তু রাষ্ট্রপতি নির্বাচন, জেলা পরিষদ নির্বাচন, সিটি করপোরেশন নির্বাচন, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন বিধিমালায় এখনো এই সংশোধনীটি আসে নি।
২০১৪ সালে পহেলা বৈশাখের মঙ্গল শোভা যাত্রায় এলজিবিটিকিউ সম্প্রদায়ের রেইনবো র্যালি দেখা গেলেও ২০১৬ সালে বাংলাদেশের প্রথম এলজিবিটি ম্যাগাজিন ‘রূপবান’-এর প্রতিষ্ঠাতা জুলহাজ মান্নানের হত্যাকাণ্ডের পর থেকে আরও দমে গেছে এই সম্প্রদায়ের মানুষ।
(প্রতিবেদক যাদের সাথে কথা বলেছেন তারা নিজের পরিচয় প্রকাশ করতে না চাওয়ায় ছদ্মনাম ব্যবহার করা হয়েছে।)