নতুন ও ভবিষ্যতকে আলিঙ্গন করতে শিক্ষার্থীদের পরামর্শ দিয়েছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।মঙ্গলবার (২৩ মে) কাতারের শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যত নেতা হওয়ার জন্য তার জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে অর্জিত সাতটি পরামর্শ তুলে ধরেন তিনি।
দোহায় কাতার বিশ্ববিদ্যালয়ের রিসার্চ কমপ্লেক্স মিলনায়তনে শিক্ষার্থীদের সামনে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী, 'বাংলাদেশ: আ ডেভেলপমেন্ট মডেল: লার্নিং ফ্রম শেখ হাসিনা' প্রতিপাদ্যের ওপর বক্তৃতা করেন। তিনি বলেন, “আমি আমার জীবনের অভিজ্ঞতা ও সংগ্রাম থেকে ভবিষ্যত নেতাদের জন্য কয়েকটি পরামর্শ দিতে চাই: প্রথম: উপযুক্ত মূল্য উপস্থাপন করুন, দ্বিতীয়: আপনার দৃষ্টিভঙ্গিতে মনোনিবেশ করুন, তৃতীয়: আপনার দৃষ্টিভঙ্গি উপলব্ধি করার জন্য সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা করুন, চতুর্থ: উদাহরণ দিয়ে নেতৃত্ব দিন এবং পরিবর্তনকারী নির্মাতা হোন, পঞ্চম: আপনার মানুষ ও দলকে বিশ্বাস করুন, ষষ্ঠ: আপনার মাতৃ-আত্মাকে আহ্বান করুন এবং সপ্তম: নতুন ও ভবিষ্যতকে আলিঙ্গন করুন।’
বাংলাদেশের ইতিহাস ও সাম্প্রতিক উন্নয়নের কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে বলেন, “বাংলাদেশ ভূখণ্ড এক সময় ঐশ্বর্য ও সমৃদ্ধির দেশ ছিল। ১৯৪৭ সালে অবিভক্ত ভারত বিভক্ত হওয়ার আগ পর্যন্ত, ঔপনিবেশিক শাসকরা এটিকে নির্মমভাবে শোষণ ও লুণ্ঠন করে এবং তারপর পাকিস্তান লুন্ঠন করে।তখন, দুর্ভিক্ষ, চরম দারিদ্র্য, অনাহার, অপুষ্টি, মৃত্যু ইত্যাদির ব্যাপকতা এই ভূখণ্ডে সাধারণ জনগণের প্রতি শাসকদের প্রতিশ্রুতি না থাকার কারণে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছিলো।”
শেখ হাসিনা শিক্ষার্থীদের জানান, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে দীর্ঘ ২৩ বছরের সংগ্রাম ও ৯ মাসের স্বাধীনতা যুদ্ধের পর ১৯৭১ সালে স্বাধীন দেশ হিসেবে বাংলাদেশের জন্ম হয়। ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত তার সরকারের প্রথম শাসনামলে বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক রূপান্তরের জন্য একটি দৃঢ় ভিত্তি গড়ে তুলতে সক্ষম হয়।
তিনি বলেন যে ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে তার দল পুনরায় ক্ষমতায় আসার পর এবং এরপর পরপর আরো দুই মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পর গত সাড়ে চৌদ্দ বছরে তারা বাংলাদেশকে তার বাবার স্বপ্নের সুখী ও সমৃদ্ধ 'সোনার বাংলাদেশ' এর জন্য প্রস্তুত করেছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, “২০১৫ সালে বাংলাদেশ নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয় এবং আমরা ২০৩১ সালের মধ্যে উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশ এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উচ্চ আয়ের দেশে পরিণত হওয়ার স্বপ্ন দেখি। এরই মধ্যে আমরা স্বল্পোন্নত দেশ থেকে ২০২৬ সালের মধ্যে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেছি।”
তিনি বলেন, “বাংলাদেশ এখন বিশ্বের ৩৫তম বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ, যার জিডিপি হচ্ছে ৪৬ হাজার ৭৫ কোটি ডলার। ২০০৫-২০০৬ সালে জিডিপি’র আকার ছিল মাত্র ৬০০০ কোটি ডলার। ২০০৬ সালে মাথাপিছু আয় ছিল ৫৪৩ ডলার, যা ২০২২ সালে বেড়ে দাঁড়িয়েছে দুই হাজার ৮২৪ ডলারে। ২০০৫-২০০৬ সালে দারিদ্র্য-হার ছিল ৪১ দশমিক ৫ শতাংশ, যেখানে বর্তমান দারিদ্র্য-হার ১৮ দশমিক ৭ শতাংশ এবং চরম দারিদ্র্যের হার ৫ দশমিক ৬ শতাংশে নেমে এসেছে।”
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বলেন, “আমরা খাদ্য নিরাপত্তা, বিনামূল্যে ও সাশ্রয়ী মূল্যের আবাসন, কমিউনিটি স্বাস্থ্যসেবা, বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা, নারীর ক্ষমতায়ন, আর্থিক অন্তর্ভুক্তি, ডিজিটাল সেবা, বিদ্যুতের সহজলভ্যতা, দুর্যোগ প্রস্তুতি এবং জলবায়ু অভিযোজনে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছি।”
শেখ হাসিনা বলেন, “আমরা জ্ঞানভিত্তিক স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে চাই। স্মার্ট বাংলাদেশে থাকবে স্মার্ট সরকার, স্মার্ট অর্থনীতি, স্মার্ট জনগোষ্ঠী, স্মার্ট সমাজ এবং স্মার্ট জনশক্তি। মানুষকে ডিজিটাল ডিভাইস ব্যবহারে দক্ষ করে তোলা হবে, যাতে তারা চতুর্থ শিল্প বিপ্লবে অবদান রাখতে পারে।”
নারী শিক্ষা প্রসঙ্গে শেখ হাসিনা বলেন, “আমার সরকার নারী শিক্ষাকে অগ্রাধিকার দিয়েছে। এক দশকের প্রচেষ্টার পর, আমরা এখন লিঙ্গ বৈষম্য হ্রাসে দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বোচ্চ অবস্থানে আছি… প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষায় আমাদের মেয়েদের পক্ষে লিঙ্গ সমতা রয়েছে।”
তিনি বলেন, “নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে আমরা বিশ্বের শীর্ষ দশটি দেশের মধ্যে রয়েছি। বাংলাদেশ সম্ভবত একমাত্র দেশ যেখানে প্রধানমন্ত্রী, সংসদের স্পিকার, বিরোধী দলীয় নেতা এবং সংসদ উপনেতা সকলেই নারী। স্থানীয় সরকারের ক্ষেত্রে নারীদের জন্য ৩৩ শতাংশ সংরক্ষিত আসন রয়েছে। আমি আমাদের যোগ্য নারীদের সর্বত্র শীর্ষ নেতৃত্বের পদে বসিয়ে সমস্ত কাঁচের আবরণ ভেঙে দেয়ার বিষয়টি তুলে ধরেছি।”
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আজকের বাংলাদেশ একটি পরিবর্তিত বাংলাদেশ। একে উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। ক্ষুধা, দারিদ্র্য, অপুষ্টি, নিরক্ষরতা ইত্যাদি দ্রুত হারিয়ে যাচ্ছে। দেশে আমাদের কষ্টার্জিত উন্নয়ন অলৌকিক কিছু নয়। এটা আমাদের নারী ও পুরুষের সম্মিলিত কাজ। আমি শুধু তাদেরকে কাঙ্ক্ষিত পথে পরিচালিত করার চেষ্টা করেছি। তবে আজকের অবস্থানে পৌঁছানো সহজ যাত্রা ছিল না। আমাকে সারা জীবন প্রচুর অগ্নিপরীক্ষা ও নিপীড়নের সম্মুখীন হতে হয়েছে।’
শেখ হাসিনা বলেন, “আমি শুধু আমার দেশবাসীর ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য সংগ্রাম চালিয়ে গেছি। যতদিন বেঁচে থাকবো ততদিন এটা চালিয়ে যাবো, ইনশাআল্লাহ। আমার স্বপ্ন আমাদের বদ্বীপকে আবার সমৃদ্ধির দেশে পরিণত করা।”
ইকোনমিক ফোরামের উদ্বোধনীতে শেখ হাসিনা
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মঙ্গলবার সকালে দোহায় তৃতীয় কাতার ইকোনমিক ফোরামের উদ্বোধনী অধিবেশনে যোগ দেন। লুসাইল শহরে অবস্থিত ফেয়ারমন্ট এবং র্যাফেলস হোটেলে চলমান এই ফোরাম শেষ হবে ২৫ মে।
কাতারের আমির তামিম বিন হামাদ আল থানির আমন্ত্রণে ফোরামে যোগ দিতে শেখ হাসিনা সোমবার দোহায় পৌঁছান শেখ হাসিনা। বিশ্বব্যাপী চলমান বহুমুখী চ্যালেঞ্জ ও সংকট এবং এর ফলে উদ্ভূত বিরূপ অর্থনৈতিক পরিণতি মোকাবেলায়, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতা বৃদ্ধির মাধ্যমে একটি সমাধান খুঁজে বের করা এই ফোরামের মূল উদ্দেশ্য।