ভারতের অভিন্ন দেওয়ানি বিধি সংক্রান্ত বিষয়টি নতুন করে পর্যালোচনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে দেশের বর্তমান আইন কমিশন। কমিশনের এই সিদ্ধান্ত নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন তুলেছে কংগ্রেস। বুধবার ১৪ জুন কমিশন এক প্রেস বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জানায়, অভিন্ন দেওয়ানি বিধিকে কেন্দ্র করে উত্থাপিত বিষয়গুলি তারা ফের খতিয়ে দেখবে। এই ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট সব মহলের মতামত পেতে তারা আগ্রহী।
কংগ্রেসের জনযোগাযোগ দফতরের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক জয়রাম রমেশ বৃহস্পতিবার ১৫ জুন সকালে এ নিয়ে এক লম্বা বিবৃতি দিয়ে ল’ কমিশনের সিদ্ধান্তকে নরেন্দ্র মোদী সরকারের বিভাজন ও মেরুকরণ রাজনীতির আর একটি পদক্ষেপ বলে বর্ণনা করেছেন। তাঁর বক্তব্য, ২২তম আইন কমিশনের নয়া সিদ্ধান্তের পিছনে অন্য কোনও কারণ থাকতে পারে না। কারণ, ২১তম কমিশন এই সংক্রান্ত বিবাদের নিষ্পত্তি করে দিয়েছে।
ভারতের অভিন্ন দেওয়ানি বিধি বা ইউনিফর্ম সিভিল কোড হল ভারতে নাগরিকদের ব্যক্তিগত বিষয়ে অভিন্ন আইন, যা জাত, ধর্ম নির্বিশেষে সব নাগরিকের উপর সমানভাবে প্রযোজ্য হবে। বর্তমানে, বিভিন্ন সম্প্রদায়ের ব্যক্তিগত আইন চালু আছে যা তাদের ধর্মীয় বিধান দ্বারা পরিচালিত হয়। বিয়ে, বিবাহ বিচ্ছেদ, দত্তক নেওয়া, ভরণপোষণের বিষয়গুলি ব্যক্তিগত আইনের আওয়ায় পড়ে। এই ব্যাপারে আদালতও হস্তক্ষেপ করতে পারে না। যেমন বিয়ে নিয়ে হিন্দু, মুসলিম, খ্রিস্টান, পার্সি এবং শিখদের জন্য পৃথক আইন চালু আছে। বিজেপি তথা হিন্দুত্ববাদীদের দাবি হল দেশে একটাই ব্যক্তিগত আইন থাকবে। হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানের জন্য আলাদা আইন থাকতে পারে না।
ওই বিষয়ে আপত্তি তুলে বিরোধীরা বলেছেন, অভিন্ন বিধি চালু করার অর্থ হল হিন্দু বিধি বাকিদের উপর চাপিয়ে দেওয়া। কারণ, বিজেপি মনে করে হিন্দুত্ব ও ভারতীয়ত্ব অভিন্ন।
কংগ্রেসের বক্তব্য, ২১ তম আইন কমিশন এই সংক্রান্ত বিতর্কের নিষ্পত্তি করে দিয়েছে। তাদের অভিমত ২০১৮ সালেই স্পষ্ট করেছে কমিশন। সেই সংক্রান্ত সুপারিশ সরকারিভাবে প্রকাশ করা হয়েছে। আগের কমিশনের মূল কথাটি হল, দুটি সংস্কৃতি বা আচার-বিচার ধারার মধ্যে ফারাক মানেই সেটা বিভেদ বা বৈষম্য নয়।
আগের কমিশনের রিপোর্টের ১৮২ নম্বর পাতার ১.১৫ অনুচ্ছেদটি উল্লেখ করেছেন জয়রাম। তাতে ‘পারিবারিক আইনের সংস্কার সংক্রান্ত পরামর্শ পত্র’-তে বলা হয়েছে, "ভারতীয় সংস্কৃতির বৈচিত্র উদযাপন করতে গিয়ে নির্দিষ্ট গোষ্ঠী বা সমাজের দুর্বল অংশগুলিকে এই প্রক্রিয়ায় সুবিধাবঞ্চিত করা উচিত নয়। এই বিভেদের সমাধান মানেই সব মতভেদ দূর করা নয়। ২১তম কমিশন তাই মনে করে একটি অভিন্ন নাগরিক বিধি প্রদান এই পর্যায়ে প্রয়োজনীয় বা কাম্য নয়। বেশিরভাগ দেশ এখন ঐক্য রক্ষার লক্ষ্যেই বিভিন্নতাকে স্বীকৃতি দিচ্ছে। পার্থক্যের অস্তিত্ব বৈষম্য নয়। বরং এটি একটি শক্তিশালী গণতন্ত্রের ইঙ্গিত দেয়।"
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, পর্যবেক্ষকদের মতে, আগের কমিশনের কাছ থেকে মনঃপুত সুপারিশ না পেয়ে বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্ব এই অভিন্ন দেওয়ানি বিধি নিয়ে নয়া কৌশল নিয়েছে। তারা কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে এই ব্যাপারে পদক্ষেপ না করে বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলিকে এগিয়ে দিয়েছে। গত এক বছরে অনুষ্ঠিত প্রতিটি বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি রাজ্যে রাজ্যে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি চালু করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। যদিও জনমনে তা খুব একটা সাড়া ফেলেছে বলে জানা যায়নি।
তাছাড়া অভিন্ন দেওয়ানি বিধি সংক্রান্ত দুটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ মোদী সরকার ইতিমধ্যেই সেরে ফেলেছে। এক. ২০১৯-এর লোকসভা ভোটের আগে তিন তালাক নিষিদ্ধ করে নতুন আইন তৈরি করেছে সরকার। বিবাহ বিচ্ছেদে তালাক হল মুসলমদের ব্যক্তিগত আইনের বিষয়। দুই, ২০১৯-এর লোকসভা ভোটের পর কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা প্রত্যাহার করে নিয়েছে ভারত সরকার। সংবিধানের ৩৭০ নম্বর অনুচ্ছেদে কাশ্মীরিদের জন্য কতগুলি বিশেষ সুবিধা প্রদান করা ছিল।