শুক্রবার ১৬ জুন দেড় মাসে পা দিল উত্তর-পূর্ব ভারতের মণিপুরের হিংসার ঘটনা। ৩ মে থেকে এক দু’দিন বাদে রোজই হিংসার আগুনে জ্বলেছে বিজেপি শাসিত পাহাড়ি রাজ্যটি। মৃত্যু বেড়ে হয়েছে ১২০। এলাকা ছাড়া পঞ্চাশ হাজারের বেশি পরিবার। কিন্তু কোনও মন্তব্য করেননি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। অশান্তি শুরুর ২৬ দিনের মাথায় চারদিনের সফরে রাজধানী ইম্ফলে গিয়েছিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। তাঁর যাবতীয় উদ্যোগই ব্যর্থ হয়েছে।
শুক্রবার ভোরে, ইম্ফলে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী আরকে রঞ্জন সিং-এর বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেয় দুষ্কৃতীরা। তবে ঘটনার সময়ে মন্ত্রী বাড়ির ভিতরে ছিলেন না বলে জানা গেছে। ক’দিন আগে কংগ্রেস ও বিজেপির বিধায়কদের বাড়িতেও হামলা হয়। পরিস্থিতির চাপে শাসক ও বিরোধী দুই শিবিরেরই বহু নেতা সপরিবারে এলাকা ছেড়েছেন।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে মণিপুরে সেনা, আধা সেনা এবং স্থানীয় ও আশপাশের রাজ্যের পুলিশ মিলিয়ে প্রায় এক লাখ জওয়ান মোতায়েন আছে। তারপরও কেন হিংসার লাগাম পরানো যাচ্ছে না নিরাপত্তা আধিকারিকেরা তার কোনও ব্যাখ্যা দিতে পারছেন না।
তবে সব কিছু ছাপিয়ে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক মহল বিস্মিত প্রধানমন্ত্রীর নীরবতা নিয়ে। একটি টুইট করেও রাজ্যবাসীকে শান্তি ফেরানোর আর্জি জানাননি তিনি। মণিপুর নিয়ে বৈঠক করেছেন বলেও খবর নেই।
প্রধানমন্ত্রীর এই অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন তুললেন কংগ্রেস রাহুল গান্ধী। প্রাক্তন কংগ্রেস নেতা এখন যুক্তরাষ্ট্রে আছেন। ২০ জুন তাঁর দেশে ফেরার কথা। সেখান থেকেই রাহুল প্রশ্ন তুলেছেন, "মণিপুর জ্বলছে, প্রধানমন্ত্রী মৌনী কেন?"
প্রাক্তন কংগ্রেস সভাপতি মণিপুরের হিংসার জন্য বিজেপির ঘৃণা ও বিভাজন রাজনীতিকেও কাঠগড়ায় তুলেছেন। বলেছেন, ‘বিজেপির ঘৃণার রাজনীতিতে পুড়ছে মণিপুর। প্রধানমন্ত্রীকে নীরবতা ভেঙে মণিপুর নিয়ে সর্বদলীয় বৈঠক ডাকার পরামর্শ দিয়েছেন কংগ্রেস নেতা। তিনি ঘৃণার রাজনীতি নিয়েও ফের সরব হয়েছেন। বলেছেন, "ঘৃণার দোকার বন্ধ করে ভালবাসার বাজার খোলা দরকার।"
দু’দিন আগেই কংগ্রেস এক বিবৃতিতে প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশে বলে, "আমরা আপনার মন কি বাত-এর শততম পর্ব শুনেছি। এবার অনুগ্রহ করে মণিপুর কি বাত শুরু করুন।" মুখ খুলেছেন কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খাড়্গে, প্রিয়াঙ্কা গান্ধী। কংগ্রেস নেত্রীর কথায়, "মণিপুরের পরিস্থিতি খুবই উদ্বেগজনক। সরকার হাত গুটিয়ে আছে।"
শুধু মণিপুর নয়, দিল্লিতে কুস্তিগিরদের আন্দোলন নিয়েও প্রধানমন্ত্রী নীরব। একজন কুস্তিগির প্রকাশ্যে দাবি করেছেন, এক অনুষ্ঠানের ফাঁকে তিনি কুস্তি ফেডারেশনের কর্তা ব্রিজ ভূষণের কূকীর্তির কথা প্রধানমন্ত্রীর কানেও তুলেছিলেন। তারপরও প্রধানমন্ত্রী বা তাঁর অফিস কিছুই বলেননি।
কংগ্রেস এই ইস্যুতেও প্রধানমন্ত্রীকে নিশানা করেছে। মনে করিয়ে দিয়েছে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী কীভাবে মনমোহন সিংহকে মৌনী প্রধানমন্ত্রী বলে উপহাস করতেন।
কংগ্রেসের লাগাতার আক্রমণের মুখেও প্রধানমন্ত্রী মুখ খোলেননি। লক্ষণীয় হল, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ’ও মণিপুর নিয়ে আর প্রকাশ্যে মন্তব্য করা বন্ধ করে দিয়েছেন।
এমনকী মণিপুরের মুখ্যমন্ত্রী এন বীরেন সিংহও কদাচিৎ মিডিয়ার মুখোমুখি হচ্ছেন। কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর বাড়ি পুড়িয়ে দেওয়ার ঘটনায় তিনি ফের শান্তি বজায় রাখার আহ্বান জানিয়েছেন। তবে বিগত দেড় মাসের গোলমালে মুখ্যমন্ত্রী বার তিনেক সংবাদমাধ্যমের মুখোমুখি হন। সামাজিক মাধ্যমেও মুখ খুলছেন না তিনি।
অন্যদিকে, জেপি নাড্ডা-সহ বিজেপি নেতারাও চুপ। রাজনৈতিক মহল মনে করছেন, মোদী তাঁর চেনা কৌশলই অবলম্বন করেছেন মণিপুর এবং কুস্তিগিরদের আন্দোলন নিয়ে। জমি অধিগ্রহণ অর্ডিন্যান্স, সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন, কৃষি আইন বিরোধী আন্দোলনের সময় প্রধানমন্ত্রী কদাচিৎ মুখ খুলেছেন। তিনি আসলে দেখাতে চান, প্রধানমন্ত্রীর অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে। চারপাশের সব কিছু নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় তাঁর নেই। তিনি চানও না।
এখন গোটা বিজেপি পরিবার মণিপুর নিয়ে নীরবতার আশ্রয় নেওয়ায় রাজনৈতিক মহলের একাংশ মনে করছে, পাহাড়ি ওই রাজ্যে বড় ধরনের কোনও পদক্ষেপ করা হতে পারে। যার দায় বিজেপি না নেওয়ার কৌশল হিসাবেই আগেভাবে নীরবতার আশ্রয় নিয়েছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও তাই প্রকাশ্যে কিছু বলছেন না।