অ্যাকসেসিবিলিটি লিংক

“আমি আমার দেশে (মিয়ানমারে) গিয়ে কেন ক্যাম্পে থাকব?”


রোহিং্যা ক্যাম্প, বাংলাদেশ
রোহিং্যা ক্যাম্প, বাংলাদেশ

বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়ে থাকা রোহিঙ্গা-নেতারা বলছেন, মিয়ানমারের রাখাইনে বসবাসের পরিবেশ সৃষ্টি না হওয়া পর্যন্ত তারা সেখানে প্রত্যাবাসনে আগ্রহী নন।

তারা আশংকা করছেন, মিয়ানমারের অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর মতো নাগরিক মর্যাদা ও সুযোগ সুবিধা নিশ্চিতসহ নিজ জমিতে ফিরে যেতে না পারলে, তারা ভবিষ্যতে আরো ক্ষতির শিকার হবেন।

ভয়েস অফ আমেরিকাকে উখিয়া ও টেকনাফের রোহিঙ্গা শরনার্থীরা বলেছেন, রাখাইন তাদের জন্য নিরাপদ এবং বসবাসের উপযুক্ত হলে তারা বাংলাদেশে "এক মুহূর্তের" জন্যে থাকতে চান না। বরং নিজ দেশ ছেড়ে এমন আশ্রিত জীবন তাদের কেবল কষ্ট দেয়।

বাংলাদেশ সরকার যা বলছে

বাংলাদেশ সরকার রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

চীনের সহযোগিতায় মিয়ানমার সরকারের নতুন তৈরী করা গ্রামে পরীক্ষামুলক প্রত্যাবাসনের একটি উদ্যোগ চলমান।

বাংলাদেশের শরনার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোহাম্মদ মিজানুর রহমান ভয়েস অফ আমেরিকাকে জানান, “ইতোমধ্যে পরীক্ষামুলক প্রত্যাবাসনের উদ্দেশ্যে চারটি পরিবারকে ট্রানজিট ক্যাম্পে নেওয়া হয়েছে। তারা সেখানে আছেন। আমাদের ট্রানজিট সেন্টার গুলো প্রস্তুত করছি৷ নতুন করে ট্রানজিট কেন্দ্র নির্মানের জন্য টেন্ডার আহবান করা হয়েছে। সেগুলো নির্মান কাজ শুরু হবে।মিয়ানমারের সাথে আমাদের যোগাযোগ আছে।“

ফিরে গেলে নিরাপত্তার আশঙ্কা

২০১৭ সালে আগস্টের শেষ দিকে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নির্যাতন, অগ্নিসংযোগ ও হত্যাকান্ডের প্রেক্ষিত সীমান্ত পাড়ি দিয়ে নাফ নদীর পাশে প্রাণ ভয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয় বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গা শরণার্থী।

জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা বলছে, রাখাইনে “টেকসই” প্রত্যাবাসন "সহায়ক" পরিবেশ এখনো সৃষ্টি হয়নি।

ওদিকে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ মে মাসে বলেছে, বাংলাদেশ ও মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সাথে আলোচনা না করেই, তাদেরকে ফেরত পাঠানোর বন্দোবস্ত করেছে।

মানবাধিকার সংস্থাটি বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষকে মনে করিয়ে দিয়ে বলেছে, এটা ভুলে যাওয়া ঠিক হবে না, কি কারনে তারা শরনার্থী হয়েছে এবং যার কোন কারনেই পরিবর্তন ঘটেনি।

যে ৬ লাখ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী মিয়ানমারের "জঘন্য" শিবিরে বা গ্রামে অবস্থান করছে সাইক্লোন মোখার পরে জান্তা সরকারতাদের ত্রান-সাহায্য পর্যন্ত বাধাগ্রস্ত করেছে, বলে মানবাধিকার সংস্থাটি জানায় ।

টেকনাফের দমদমিয়া ক্যাম্পের কাটাতারের পাশে ঢিবির উপরে পাঁচ সন্তান ও স্ত্রীকে নিয়ে বাস করেন ৩২ বছর বয়সী রোহিঙ্গা আবু শামা। গত ৫ মে বাংলাদেশ থেকে রোহিঙ্গাদের ২০ সদস্যের যে প্রতিনিধি দল রাখাইনে দিনব্যাপী সফর করে সেখানে ছিলেন শামা।

লাম্বাশিয়া ক্যাম্পের রোহিঙ্গা নারী নেত্রী মিনারা বলেন, “আমরা যেভাবে চাই, সেভাবে সুযোগ না দিলে তারা আমাদের মেরে ফেলেবে। আমাদের ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছে যখন, তখন আমাদের মেরে ফেলতে কতক্ষণ? আমাদের বাড়িঘর যা ছিল পুড়িয়ে দিয়েছে তো সব, সেগুলো পুড়িয়ে দিয়ে তো আমাদের সরিয়েছে তারা। সুতরাং অন্য গোষ্ঠীদের যেভাবে রাখছে সেভাবে আমাদেরও সুযোগ সুবিধা না দিলে কিভাবে যাব।”

সীমান্তের অপরপাশে রাখাইনে কিছুদিন আগ পর্যন্তও আরাকান আর্মির সাথে মিয়ানমারে জান্তা সরকারের সেনাবাহিনীর সংঘাত চলেছে। পরিস্থিতির কিছুটা উন্নয়ন হলেও, টেকনাফ অবস্থানরত কয়েকজন রোহিঙ্গা নেতা বলেন, আরাকান রোহিঙ্গা সলভেশন আর্মি তাদের অনেককেই লক্ষ্যবস্তুতে পরিনত করছে।

তাদের অনেকেই মনে করছেন, নিজ ভুমি ফিরে যেতে না পারলে তাদের পুর্বের উন্নত জীবন যাত্রা ফিরে আসবে না। তাছাড়া ভবিষ্যতে আরাকান আর্মির সাথে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নতুন করে সংঘাত শুরু হলে, রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীই সবচেয়ে ক্ষতির শিকার হবে।

তাদের স্বাভাবিক চলাচল স্বাধীনতা ও নাগরিকত্ব অধিকার নিশ্চিত করার কোন ঘোষণা তারা পায়নি। এছাড়া অনেক নেতারা রাখাইনে ফেরত যাবার পর তাদের জীবনের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত।

মিয়ানমারে ফেরার আগে নাগরিক অধিকারের সুরক্ষা চান রোহিঙ্গা শরণার্থীরা

১৯৮২ সালে মিয়ানমারের নাগরিকত্ব আইনে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর নাগরিকত্ব কার্যত কেড়ে নেওয়া হয়। ফলে তারা নিজ দেশেই রাষ্ট্রহীন হয়ে পড়ে। তারপর থেকে কয়েক দফায় গত প্রায় চার দশকে বিভিন্ন সময় মিয়ানমার রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী বাস্তুচ্যুত হয়েছেন।

রোহিঙ্গা শরনার্থীরা বলছেন শিকার হয়েছে হত্যা, লুট, ধর্ষনসহ জাতিগত বিদ্বেষের।

এইচ আর ডব্লিউ অভিযোগ করছে, মিয়ানমারের জান্তা সরকার ২০২১ সালের সেনা অভ্যুথানের পর থেকে হাজার হাজার রোহিঙ্গা নারী, পুরুষ আর শিশুদেরকে আটকে করেছে "অননুমোদিত ভ্রমনের" অভিযোগে। জান্তা সরকার নতুন করে রাখাইনের রোহিঙ্গা গ্রাম ও ক্যাম্পগুলোতে চলাচলের ও সহায়তার উপরে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে, যা সেখান পানি ও খাদ্য স্বল্পতার বাড়িয়ে দিয়েছে ।

তবে এগুলো ছাড়াও বড় ধরনের চিন্তার কারন রোহিঙ্গারা ফেরত গেলে তাদেরকে জাতীয় অনুমোদন কার্ড দেওয়া হবে। যে কার্ড রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্বের অধিকার নিশ্চিত করেনা।

মিয়ানমারে নাগরিক অধিকারের প্রশ্নে রোহিঙ্গা নেতা আবু শামা ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন “তারা আমাদের যে জায়গায় নিয়ে গেছে, সে জায়গায় আমরা আগেও চলাফেরা করেছি। তো তারা যে ১৫ টি জায়গা হিসাব করেছে, সে রকম আমরা চাই না। আমাদের নিজের গ্রাম, নিজের ঘর-বাড়ি, আগে যেরকম ছিলো, আগে যেমন চলাফেরা করতে পারতাম, সে রকম চলতে পারলে, এখনই চলে যাব।… আমি আমার দেশে গিয়ে কেন ক্যাম্পে থাকব? সেটা তো আমার দেশ, আমার দেশে গিয়ে কিভাবে ক্যাম্পে থাকব?...মিয়ানমারে যে জাতিগুলো আছে এর মধ্যে আমরাও আছি, সেখানে ভিন্ন ভিন্ন জাতির জন্য সমান অধিকার নিশ্চিত হলে বাংলাদেশ থেকে এখনই চলে যাব।"

তার মতো, আরেক রোহিঙ্গা নূর আহম্মদও জানান “আমরা সেখানে (মিয়ানমারে ) চলে যাব, যদি ওখানে অন্য ১৩৫ জাতিগোষ্টি আছে, ( মিয়ানমারে সরকার) তাদের যেভাবে দেখে আমাদেরও সেভাবেই দেখে, একই সুযোগ সুবিধা দেয় তবে এখনি চলে যাব।…সেখানে গাড়িতে উঠলে ১০০ বার্মিজ কিংবা রাখাইন থাকলে তাদের নামায় না আর একজন রোহিঙ্গা থাকলে তাকে নামিয়ে ফেলে। তো এভাবে পার্থক্য থাকলে আমরা কিভাবে ওখানে যাবো?”

লাম্বাশিয়া ক্যাম্পের রোহিঙ্গা নারী নেত্রী মিনারা ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন, “আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যদি বিচার করে দেয়, বার্মায় যত সম্প্রদায় আছে, বৌদ্ধ, হিন্দু, ওঅন্যান্য জাতিগোষ্টি, তারা যেভাবে নাগরিক সুযোগ সুবিধা পায় রোহিঙ্গাও যেন তেমন পায়, সে বিচার করে দিলে সুযোগ সুবিধা পাবো আশা করি।…যদি এই রকম বিচার করে না দেয় তাহলে আমরা আগে যেভাবে কষ্ট পেয়েছি সে রকমই কষ্টইআবার পাবো।“

বাংলাদেশের রোহিং্যা ক্যাম্পে সংকট

জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআর-এর হিসেবে ৩৪ রোহিঙ্গা শরনার্থী শিবিরে বর্তমানে ৯,৬১,১৭৬ জন অনিশ্চিত ভবিষ্যত নিয়ে বাস করছেন। যার ৯৩ শতাংশ এসেছে ২০১৭ পরে অথবা পরবর্তীতে বাংলাদেশে জন্মগ্রহণ করেছেন ।

দাতাদের তহবিল সংকটের কারনে নতুন করে এ বছরের জুন মাস থেকে ১০ ডলার থেকে ৮ ডলারে জনপ্রতি মাসিক খাদ্য বরাদ্দ নির্ধারণ করেছে (জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি, ডব্লিউ এফ পি)। কমেছে কাজের সুযোগ।

রোহিঙ্গা নারীদের মধ্যে সেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘এডুকেশন এন্ড উইজডম ডেভেলপমেন্ট ফর রোহিঙ্গা উইমেন' শিক্ষা প্রসারে কাজ করছেন রোহিঙ্গা নারী নেত্রী মিনারা। তিনি বলেন, এখানে আমরা ক্যাম্পের মধ্যে (ক্যাম্প-১ এর জি-১৫ ব্লকে) তিন পরিবারে তিনটি মেয়ে কাজ করি, আর ১১০ পরিবারের মেয়ে কাজ ছাড়া, আমরা না হয় চাকুরী করে ছেলেমেয়েদের কোনো রকম দেখভাল করতে পারি, কিন্তু বাকিরা বেশি কষ্টে পড়ে গেছে।

রেশন যেহেতু কমিয়ে ফেলছে তখন আমাদের সমস্যা বেড়ে যাবে, আমার আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে আবেদন করতে ইচ্ছে করছে, যে আগে আমাদের যে পরিমাণ রেশন দিয়েছিল সে রকম দেয়ার জন্য অনুরোধ করতে ইচ্ছে করে” ।

এর পাশাপাশি, কক্সবাজার পুলিশের হিসাব অনুযায়ী কেবল জানুযারী থেকে মে মাস পর্যন্ত শরনার্থী শিবিরের রোহিঙ্গাদের নিজেদের মধ্যে বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাথে সংঘাতে অন্তত ২৫ রোহিঙ্গা নিহত হয়েছে।

রোহিঙ্গা শিবিরে হত্যাকান্ড, অপহরণ, চাঁদাবাজিসহ অপরাধমুলক কর্মকাণ্ড সাধারণ রোহিঙ্গাদের নূন্যতম জীবনযাত্রাকে বাধাগ্রস্ত করছে। বাড়ছে আতঙ্ক। ইতোমধ্যে জীবনবাজি রেখে, অনেকে সাগর পথে পাড়ি জমিয়েছেন থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়ার উদ্দেশ্যে।

“…ক্যাম্পে যে থেকেছে সে বুঝতে পারে। আমাদের নিজের ঘরবাড়ি আছে সেখানে যেতে চাই আমরা। আমাদের শরণার্থী জীবনে কষ্ট কি সেটি এই ৬ বছরে বুঝতে পারছি। আবার যদি বার্মায় গিয়ে একই রকম জীবন পার করতে হয় তাহলে আমাদের জীবন তো শেষ। কিন্তু আমাদের ছেলে, সন্তানের ভবিষ্যৎ চিন্তা করে [রাখাইনের] ক্যাম্পে যেতে চাই না। আমাদের যদি আমাদের ঘরবাড়িতে নিয়ে যেতে চায়, আমরা সকলেই চলে যাবো," মিনারা বলেন ।

XS
SM
MD
LG