অ্যাকসেসিবিলিটি লিংক

উদ্বাস্তু বিষয়ক জাতীয় নীতি নেই ভারতের, রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুদের অবস্থান প্রশ্নের মুখে


রোহিঙ্গা শরণার্থী তসলিমা, দিল্লি, ২০২০।
রোহিঙ্গা শরণার্থী তসলিমা, দিল্লি, ২০২০।

জাতিসংঘের হিউম্যান রাইটস ওয়াচ-এর তথ্য অনুযায়ী ভারতে এই মুহূর্তে বসবাসকারী রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুর সংখ্যা আনুমানিক ৪০ হাজার। তাদের মধ্যে অন্তত ২০ হাজার জাতিসংঘের হিউম্যান রাইটস্‌ কমিশন-এ নথিভুক্ত আছেন।

ভারতের রাজধানী দিল্লি সহ, জম্মু ও কাশ্মীর, হায়দ্রাবাদ, হরিয়াণা ও পশ্চিমবঙ্গে উদ্বাস্তু শিবিরে এই রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী বাস করে। যদিও ভারত মনে করে যে ভারতে আশ্রয় নেওয়া এই রোহিঙ্গা শরণার্থীরা আদপে ‘বেআইনি পরিযা্য়ী’। এই মনোভাবের বড় কারণ ভারতের উদ্বাস্তু বিষয়ে কোনও জাতীয় পলিসি বা নীতি নেই এবং সেই হাতে গোনা কয়েকটি দেশের মধ্যে ভারত রয়েছে যারা জাতিসংঘের ১৯৫১-র রিফিউজি কনভেনশন-এ স্বাক্ষর করেনি। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী ২০০-র বেশি রোহিঙ্গা উদ্বাস্তু ভারতের বিভিন্ন ডিটেনশন ক্যাম্প-এ আটক হয়ে আছেন।

নারী অধিকার নিয়ে কাজ করা একটি অলাভজনক সংগঠন ‘দ্য আজাদি প্রজেক্ট’ ও রিফিউজি ইন্টারন্যাশনাল নামক একটি আন্তর্জাতিক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের উদ্যোগে তৈরি হওয়া একটি রিপোর্ট – ‘আ শ্যাডো অফ রিফিউজি: রোহিঙ্গা রিফিউজিস্‌ ইন ইন্ডিয়া’ প্রকাশিত হয়েছে গত মে মাসে। এই রিপোর্ট থেকে জানা যাচ্ছে, ভারত সেই সমস্ত রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুদের ভারত ছাড়ার অনুমতি দিচ্ছে না যারা জাতিসংঘের রিফিউজি এজেন্সি থেকে উদ্বাস্তু হিসাবে স্বীকৃতি পেয়েছেন এবং যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, জার্মানি ও অন্যান্য ইওরোপিয়ান দেশ যারা জি-টোয়েন্টি ফোরাম-এর মতো মঞ্চের সদস্য দেশে পুনর্বাসনের অনুমোদন পেয়েছেন। পাশাপাশি বর্তমান সরকারের অধীনে ভারতে ক্রমেই তাদের বিরুদ্ধে মুসলমান-বিদ্বেষী ও উদ্বাস্তু-বিরোধী মানসিকতাও বৃদ্ধি পেয়েছে। তাছাড়া তারা সব সময়েই ভীত থাকেন যে তাদের মিয়ানমার-এ ফেরত পাঠিয়ে দেওয়া হবে, যেখানকার গণহত্যার পরিবেশ থেকে তারা পালিয়ে এসে উদ্বাস্তু হয়ে পড়েছেন। এই রিপোর্টে এই তথ্যই উঠে এসেছে।

ভারতে রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুদের সামাজিক, রাজনৈতিক অবস্থান নিয়ে ভয়েস অফ আমেরিকা কথা বলেছে, জেনিভা গ্র্যাজুয়েট ইনস্টিটিউট-র নৃতত্ত্ব ও সমাজবিজ্ঞানের পিএইচডি গবেষক সুচরিতা সেনগুপ্ত-র সঙ্গে। তিনি ভারতের অবস্থান প্রসঙ্গে বলেন, “যদিও আমরা রিফিউজি কনভেনশন-এ স্বাক্ষরকারী নই, কিন্তু ভারতের একটা উদ্বাস্তু-বান্ধব ইতিহাস বা ঐতিহ্য আছে, তা সে ১৯৪৭ হোক বা ১৯৭১। কোনও রিফিউজি পলিসি না থাকলেও টিবেটিয়ান, চাকমা বা শ্রীলঙ্কান – সব উদ্বাস্তুদের ক্ষেত্রেই ভারতের বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ থেকেছে। বর্তমানে রোহিঙ্গাদের ক্ষেত্রে যা দেখা যাচ্ছে তা ব্যতিক্রমী। যদিও ভারতে তাদের ক্যাম্প অবস্থান আছে। এই মানসিকতা কেন্দ্রের। তবে পশ্চিমবঙ্গের কথা বললে বলতে হয় যে রোহিঙ্গাদের বিষয়ে রাজ্য সরকারের অবস্থান অনেকটাই মানবিক, অতটা হার্ড-লাইনড স্ট্যান্ড পয়েন্ট নয়।”

সুচরিতা নিজের গবেষণা ও কাজের সূত্রে ভারতে রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুদের পরিস্থিতি দেখার সুবাদে জানান তাদের কেন্দ্র করে অনেক সময়েই বেআইনিভাবে ভারতের নাগরিক সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার বা সামাজিক স্থিতিশীলতা অশান্ত করার যে অভিযোগ করা হয়, তা সঠিক নয়, কোনওটাই খুব একটা প্রমাণিত নয়, সবটাই অনুমানের স্তরে থাকে। উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, “যেমন অনেক সময়েই ধরে নেওয়া হয় পশ্চিমবঙ্গের সীমান্তবর্তী জেলাগুলির অধিকাংশ মুসলমান জনগোষ্ঠীর মানুষেরা বাংলাদেশী। যেমন কোনও প্রামাণ্য ভিত্তি থাকে না এই কথাগুলি বলার যে মুসলমান হলেই তিনি আমদের দেশের নাগরিক নন, এ দেশে থাকার অধিকার নেই, তারা বেআইনি অনুপ্রবেশকারী।”

তার মতে, রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুদের এই রাষ্ট্রহীনতার বিষয়টিকে মানবিকভাবেই বিচার করা প্রয়োজন, “যেহেতু এটি হয়েছে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াতে, যেখানে ভারত, মিয়ানমার, বাংলাদেশ অতীতে একটাই অংশ ছিল আর এই পরিযায়ী হয়ে ওঠার বিষয়টি ঘটছে দেশভাগের সময় থেকে, এই সামাজিক-ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটটি মনে না রাখলে বোঝা সম্ভব নয় যে আজও এরা কেন এভাবে সীমান্ত পেরোচ্ছেন। যে দেশ এতবড় একটা দেশভাগ প্রত্যক্ষ করেছে, সীমান্তের উপরেই তৈরি যে রাষ্ট্র তৈরি হয়েছে, তার উদ্বাস্তু ইস্যুতে এই মানসিকতা অর্থহীন। কেন এই মানুষগুলি দেশছাড়া সেই সামাজিক-রাজনৈতিক বিষয়গুলি বিশ্লেষণ করতে হবে। শেষ পর্যন্ত এটা মানুষের বেঁচে থাকার লড়াই।”

জাতিসংঘ থেকে যেমন বলা হয়েছে যে রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুদের বিষয়টি দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আঞ্চলিক বিষয় ও তা এখানকার রাষ্ট্রপ্রধানদেরই আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করতে হবে, তার সঙ্গে সুচরিতা দ্বিমত পোষন করেন, কারণ তাঁর বক্তব্য বিষয়টি ‘গ্লোবাল’। কিন্তু তিনি এও বলেন এটা বাস্তব যে, যেহেতু মিয়ানমার, বাংলাদেশ ও ভারতের সীমান্তই এক্ষেত্রে লঙ্ঘিত হচ্ছে ও এই তিনটি দেশই বিষয়টির সঙ্গে সবচেয়ে বেশি জড়িত, তাই ভারত ও বাংলাদেশের নাগরিকদের মনে রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে নানা প্রশ্ন রয়েছে এবং নানাভাবে এই ধারণাটিও রয়েছে যে ভারত বা বাংলাদেশের নাগরিকদের জীবনে এর প্রভাব পড়তে পারে। “এই বিষয়ে সবচেয়ে বড় ভূমিকা নিঃসন্দেহে মিয়ানমার-এর। ভারত হোক বা বাংলাদেশ তখনই এই উদ্বাস্তুদের মিয়ানমার-এ ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়া করা যেতে পারে যদি সেখানে তাঁদের জীবনের সম্পূর্ণ সুরক্ষা ও ‘ডিগনিটি’ সুনিশ্চিত করা যায়। এই বিষয়টি ভালো করে বুঝে নেওয়ার দায়িত্ব যে দেশ থেকে ফেরত পাঠানো হচ্ছে তার সরকারের উপরেও বর্তায়,” মত সুচরিতার।

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উঠে আসে। তা হল – বিগত বছরগুলিতে এই উদ্বাস্তু ক্যাম্পগুলিতেই অনেকের জন্ম হয়েছে, তারা সেই ক্যাম্পেই বেড়ে উঠছে, বা খুবই কম বয়সে যারা এই ক্যাম্পগুলিতে এসেছে, তাদের বিষয়ে তিন দেশেরই সরকারি সিদ্ধান্ত কী হবে তার কোনও স্পষ্ট নির্দেশিকা নেই। সুচরিতা বলেন, “রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুদের অনেকের রিফিউজি কার্ড আছে। ভারতে অরুণাচল প্রদেশে চাকমা শরণার্থীদের জায়গা দেওয়ার উদাহরণ আছে, দলাই লামা-র ঘটনা দেখেছি, শ্রীলঙ্কার উদ্বাস্তুদের দেখেছি, ভূটানিজ উদ্বাস্তদের দেখেছিল, তাছাড়া দেশভাগজনিত উদ্বাস্তরা তো আছেনই। এই ধারা অনু্যায়ীই রোহিঙ্গাদের নিয়েও ভারত অবশ্যই ভাবতে পারে। ১৯৪৭ ও ১৯৭১-এর দু’টি ওয়াটার শেড ইভেন্ট-এর থেকে রোহিঙ্গা ইস্যুটি কোনও অংশে কম তো নয়ই, অভিঘাতের দিক থেকে তা অনেকটাই বেশি, কারণ মিয়ানমার-এর খবর খুব বেশি বাইরে না আসায় এই বিষয়টি নিয়ে যতটা আলোচনা হওয়ার কথা ততটা হয় না। মিয়ানমার-ভারত-বাংলাদেশকে একজোট হয়েই এর সমাধান খুঁজতে হবে। আসলে উদ্বাস্তু নিয়ে সংশয় সব সময়েই থাকে, সব সময়েই থেকেছে, এটা থাকবেই – অনস্বীকার্য। সেক্ষেত্রে ভারত সরকারের দায়িত্ব ভারতের নাগরিকদের, রোহিঙ্গাদের বিষয়ে কোনও রকম ভুল ধারণা যাতে তৈরি না হয় সে বিষয়ে সচেতন থাকা এবং একটি মানবিক দৃষ্টিকোণ দিয়ে বিষয়টিকে বিচার করে তার সামাজিক-রাজনৈতিক সমাধান খোঁজায় সচেষ্ট হওয়া।”

XS
SM
MD
LG