ভারতের পুরাণ 'রামায়ন' অবলম্বনে তৈরি চলচ্চিত্র ‘আদিপুরুষ’ নিয়ে বিতর্ক যেন কিছুতেই থামছে না। ছবির ভিএফএক্স নিয়ে আপত্তি তো ট্রেলার মুক্তির পর থেকে ছিলই, আর এখন মুক্তির পর সংলাপ নিয়েও বিতর্ক তৈরি হয়েছে। হনুমানের মুখে সাধারণ মানুষের মতো ভাষা শুনে ক্ষোভে ফেটে পড়েছেন দর্শকরা। পরিস্থিতি এমন জায়গায় পৌঁছয় যে, সিনেমা নিষিদ্ধ করার দাবি তুলে প্রধানমন্ত্রীকে চিঠিও লেখা হয়। এরমধ্যেই ছবির সংলাপ লেখক মনোজ মুনতাশিরকে বিশেষ নিরাপত্তা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিল মুম্বই পুলিশ।
জানা গিয়েছে, পরিচালক ওম রাউতের পাশাপাশি ‘আদিপুরুষ’ ছবির চিত্রনাট্যকার ও সংলাপ লেখক মনোজ মুনতাশির খুনের হুমকি পেয়েছেন। এরপরই মুম্বই পুলিশের কাছে নিরাপত্তা চেয়ে আবেদন করেন মনোজ। অভিযোগ পাওয়ার পরেই তদন্ত শুরু হয়। পরে পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়, "মনোজ মুনতাশিরের অভিযোগ আমরা খতিয়ে দেখেছি। তাঁকে খুনের হুমকি দেওয়ার কারণেই বিশেষ নিরাপত্তা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।"
এদিকে পুলিশের তরফে বিশেষ নিরাপত্তা পাওয়ার পর মনোজ এমন একটি মন্তব্য করেছেন, যা নিয়ে ফের নতুন করে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। তিনি বলেন, "হনুমান তো আসলে ভগবান নন। তিনি ভক্ত। কিন্তু শক্তিমান, বুদ্ধিমান, পরাক্রমশালী হওয়ার কারণে তাঁকে আমরা ভগবানের মর্যাদা দিই। সেই আসনে বসিয়েছি। বজরংবলি আসলে খুবই সাধারণ, আমাদের মতো। তাই আমি সাধারণ মানুষের মতোই সংলাপ বসিয়েছিলাম হনুমানের মুখে।"
এদিকে ‘আদিপুরুষ’ নিয়ে এমন বিতর্কের জেরে বেশ কিছু সংলাপ বদলে ফেলার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন নির্মাতারা। তাঁরা একটি বিবৃতি জারি করে বলেন, "ছবিটি বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে প্রশংসিত হচ্ছে। নানা বয়সের দর্শকের মন জয় করেছে। তবে সংলাপ নিয়ে অনেকেরই ক্ষোভের কথা কানে এসেছে আমাদের। তাই সংলাপে বেশ কিছু পরিবর্তনের কথা ভেবেছি। দর্শকের মূল্যবান মতামতের পরেই আমরা এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছি।"
আসলে ‘আদিপুরুষ’ ছবিতে হনুমানের মুখের একটি নির্দিষ্ট সংলাপ তুমুল শোরগোল ফেলেছে সোশ্যাল মিডিয়ায়। সিনেমা সমালোচকদের মতে, এমন নিম্নমানের সংলাপ যে দর্শকরা একেবারেই খুশি মনে মানতে পারবেন না, তা সম্ভবত বুঝতে পারেননি নির্মাতারা। অথবা ভেবেছিলেন, বিতর্কে ভর করেই ছবির সাফল্য আসবে। তবে বিষয়টি যে এতটা জটিল হয়ে যাবে, তা বুঝতে পারেননি কেউই। এরপরই তড়িঘড়ি সংলাপ বদলের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
মুক্তির পর থেকেই বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে ‘আদিপুরুষ’। ছবিটি নিষিদ্ধ ঘোষণার দাবিতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে চিঠি লিখেছে ‘অল ইন্ডিয়া সিনে ওয়ার্কার্স অ্যাসোসিয়েশন’। তাঁদের দাবি, পৌরাণিক মহাকাব্য রামায়ণকে ‘আদিপুরুষ’ ছবিতে বিকৃত করা হয়েছে। ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হেনেছে ওম রাউত পরিচালিত এই ছবিটি। সেই অভিযোগ তুলে পরিচালক ওম রাউত, চিত্রনাট্যকার মনোজ মুনতাশির শুক্লা এবং প্রযোজকদের বিরুদ্ধে এফআইআর দায়ের করার দাবিও জানানো হয়েছে।
সেই চিঠিতে লেখা হয়েছে, “অবিলম্বে সিনেমা প্রদর্শন বন্ধ করা এবং ভবিষ্যতের জন্যও আদিপুরুষ থিয়েটার এবং ওটিটি প্ল্যাটফর্মগুলিতে নিষিদ্ধ করা হোক। যে নাগরিক যে ধর্মের বিশ্বাসীই হোক না কেন, ভারতে সবাই প্রভু শ্রী রামকে একজন ঈশ্বর হিসাবেই বিবেচনা করেন। এই ছবিতে ভগবান রাম এবং রাবণকে ভিডিও গেমের চরিত্রের মতো করে দেখানো হয়েছে। তাই ‘আদিপুরুষ’ দেশের প্রত্যেক নাগরিকের বিশ্বাসকেই আঘাত করেছে।”
সেই চিঠিতে আরও বলা হয়েছে যে, “এই ছবির পরিচালক, প্রযোজক ও সংলাপ লেখকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানাচ্ছি। পরিচালক ওম রাউত, লেখক মনোজ মুনতাশির শুক্লা এবং সিনেমার প্রযোজকদের বিরুদ্ধে এফআইআর করা দরকার। ওঁরা হিন্দু ধর্মের অনুভূতিতে আঘাত করেছেন। আমাদের ভগবান শ্রী রাম, মা সীতা এবং রামসেবক ভগবান হনুমানের ভাবমূর্তিকে রক্ষা করা প্রয়োজন। কিন্তু তারা রামায়ণ নিয়ে ছবি বানাতে গিয়ে অপমান করেছেন।”
শুক্রবার ১৬ জুন মুক্তির পর থেকেই সোশ্যাল মিডিয়া থেকে সর্বত্র ‘হট টপিক’ হয়ে উঠেছে ওম রাউত পরিচালিত ছবি আদিপুরুষ। প্রভাস, কৃতি শ্যানন, সইফ আলি খান অভিনীত বিগ বাজেট ছবিটি মুক্তির মাত্র দুদিনের মধ্যেই বিশ্বজুড়ে ২০০ কোটি টাকার ব্যবসা করেছিল। কিন্তু চতুর্থ দিন, অর্থাৎ সোমবার ১৯ জুন থেকেই নাকি লাভের অঙ্কে বিপুল পতন শুরু হয়েছে।
আসলে মহাকাব্য রামায়ণের আধারে তৈরি এই ছবিটি মুক্তির পরমুহূর্ত থেকেই নেটিজেনদের বিরূপ সমালোচনার মুখে পড়েছিল। ইতিমধ্যে সীতাকে ভারতের কন্যা হিসাবে দেখানোর কারণে নেপালের কাঠমাণ্ডু এবং পোখারাতে ছবিটির স্ক্রিনিং নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
সংবাদ সূত্রের খবর, এইসব কারণেই রাতারাতি ব্যবসা পড়েছে আদিপুরুষের। জানা গেছে, ছবিটির হিন্দি সংস্করণটির সোমবারের বক্স অফিস সংগ্রহ মাত্র ৮.৫ কোটি টাকা। মুক্তির চতুর্থ দিনে প্রায় ৭৫-৭৭% কমেছে ছবিটির ব্যবসা। সব মিলিয়ে এই ৪ দিনে ভারতে হিন্দি ভাষায় মুক্তি পাওয়া ছবিটির আয় দাঁড়িয়েছে মাত্র ১০৮ কোটি ৫০ লক্ষ টাকা।
যদিও বিশ্বজুড়ে ভালই ব্যবসা করেছে রাম-সীতা-রাবণের এই কাহিনি। রবিবার পর্যন্ত দেশি এবং আন্তর্জাতিক বক্স অফিসে আদিপুরুষ-এএ মোট সংগ্রহ ৩৪০ কোটি টাকা। এর মধ্যে শুধু শুক্রবারেই ১৪০ কোটি টাকার ব্যবসা করেছিল ছবিটি। শনিবার সেই আয় এক ধাক্কায় অনেকটাই কমে দাঁড়িয়েছিল ১০০ কোটি টাকা। রবিবারও ধারাবাহিকতা বজায় রেখে ১০০ কোটি টাকার ব্যবসা করেছে আদিপুরুষ।
আদিপুরুষের জেরে খানিকটা হলেও প্রভাব পড়েছে ভারত-নেপাল সম্পর্কে। রামায়ণের সীতা ছিলেন মিথিলার রাজা জনকের কন্যা। আর সেই মিথিলা নাকি নেপালে অবস্থিত। তাই ছবিতে সীতাকে ভারতের কন্যা বলায় রেগে উঠেছেন নেপালের মানুষজন। কাঠমাণ্ডুর মেয়র বালেন শাহ আদিপুরুষ সহ সমস্ত ভারতীয় ছবির প্রদর্শন নিষিদ্ধ করেছেন শহরে। কোনও হলে যেন আদিপুরুষ না চলে, তা নিশ্চিত করতে কাঠমাণ্ডুর রাস্তায় রাস্তায় রীতিমতো পুলিশ বাহিনী নামানো হয়েছে।