১১ জুলাই বিশ্ব জনসংখ্যা দিবস। অতি সম্প্রতি জনসংখ্যার নিরিখে ভারত চীনকে ছাপিয়ে গিয়ে সর্বোচ্চ জনসংখ্যার দেশ হয়ে উঠেছে। ভারতের জনসংখ্যা এখন ১, ৪২৮.৬ মিলিয়ন। একটি দেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে যেমন জড়িয়ে থাকে তার অর্থনীতি তেমনি এই ক্রমবর্দ্ধমান জনসংখ্যার প্রয়োজনীয় শিক্ষা, স্বাস্থ্য, আয় এবং অন্যান্য মৌলিক অধিকারগুলি সরকার তথা রাষ্ট্র সঠিক পরিকাঠামোর মাধ্যমে নিশ্চিত করতে পারছে কি না সেই বিষয়টিও বিচার্য হয়ে ওঠে। একটি দেশের নির্দিষ্ট আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে বিষয়টির বিশ্লেষণ প্রয়োজন হয়।
বিশ্বের মধ্যে সর্বোচ্চ জনসংখ্যার দেশ হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে ভারতে এই বিষয়গুলি কীভাবে দেখা যেতে পারে সেই বিষয়ে ভয়েস অফ আমেরিকা কথা বলেছে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ও মানবীবিদ্যা চর্চা বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক স্বাতী ঘোষ-এর সঙ্গে।
ভয়েস অফ আমেরিকা-র পক্ষ থেকে সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন সুদর্শনা চক্রবর্তী।
ভয়েস অফ আমেরিকা: ভারত সবে মাত্র চীনকে অতিক্রম করে বিশ্বের সর্বোচ্চ জনসংখ্যার দেশ হয়ে উঠেছে। ভারতের অর্থনীতিতে এই জনসংখ্যা বৃদ্ধি কী প্রভাব ফেলতে পারে?
স্বাতী ঘোষ: দু’টো বিষয় এর সঙ্গে জুড়ে যাচ্ছে। একটা চীনকে অতিক্রম করা, সেই বিষয়টা স্বতন্ত্র। আরেকটি বিষয় হল জনসংখ্যা বৃদ্ধি যে হারে আমাদের দেশে চলছে, তা চলছেই। ফলে চীনকে অতিক্রম করায় আলাদা ভাবে আমাদের অর্থনীতির উপরে তো প্রভাব নেই।
আমাদের যে পপুলেশন গ্রোথ, সেক্ষেত্রে আমাদের তাঁদের জন্য আলাদা করে কোনও পরিকল্পনা নেই – জনসংখ্যাকে আমরা ‘রিসোর্স’ বলে মনে করি, কিন্তু সেই ‘রিসোর্স’-কে আমরা ফলপ্রসূভাবে ব্যবহার করতে পারি না। না তাঁদের আমরা কোনও কাজে লাগাতে পারি, না তাঁদের কোনও কাজ দিতে পারি। এবং এইরকম ‘রিসোর্স’ মনে করাতেও এক ধরনের সমস্যা থাকে, যেন পপুলেশন-কে সব সময়েই একটা পরীক্ষা দিয়ে যেতে হবে, প্রডাক্টিভিটি-র পরীক্ষা, এফিশিয়েন্সি-র পরীক্ষা, তবেই তাঁরা যথার্থভাবে কন্ট্রিবিউট করছেন – এরকমটা মনে করা হয়। ফলে এই মনে করাটার সঙ্গেই আমি একমত হব না।
ভয়েস অফ আমেরিকা: অনেক সময়েই সাধারণভাবে যেটা মনে করা হয় যে জনসংখ্যা বাড়লে দেশে জিনিসপত্রের বিক্রিও বাড়বে, যা একরকমভাবে দেশের অর্থনীতির উন্নতি হবে। বাস্তব ছবিটা কি সেরকম?
স্বাতী ঘোষ: তারমানে তখন আমি জনসংখ্যাকে দেখছি কনজিউমার (উপভোক্তা) হিসাবে। যদি আমরা একেবারে হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট (মানব উন্নয়ন)-এর জায়গা থেকে দেখি, তাহলে জনসংখ্যাকে হয় ‘প্রডাক্টিভ লেবার’ হয়ে উঠতে হবে, নয় তো তাঁর অর্থনীতিতে উৎপাদনশীল ভূমিকাটাই থাকছে না বা অস্বীকার করা হচ্ছে। ফলে সেই জনসংখ্যার প্রয়োজন নেই, তাঁকে কমিয়ে আনো, এরকম একটা জায়গা তৈরি হয়। অথবা জনসংখ্যা মানেই হল কনজিউমার, তার মানে বাজারের জন্য তাঁর ভূমিকা জরুরি। তাঁর ভূমিকা বাজারে যা উৎপাদিত হচ্ছে তা কেনা। মানে আমরা সব সময়েই দেখি হয় উৎপাদন নয় উপভোক্তার জায়গা থেকে জনসংখ্যাকে। ফলে একেবারে হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট-এর জায়গাটায় যদি আমরা জোর দিই, তাহলে কখনওই মানুষকে ‘রিডিউস’ করে আনা যায় না, তাঁর শুধুমাত্র দু’টি ভূমিকায়। তাঁর অনেক সৃজনশীল জায়গা থাকে, নির্দিষ্ট মানবাধিকারের জায়গা থেকে বললেও – এই জনসংখ্যা বৃদ্ধি, তাকে নিয়ন্ত্রণ এইসব পলিসি-র কথা আমরা ভাবতেই পারি না, ভাবা উচিতই না, আসতেই পারে না।
ভয়েস অফ আমেরিকা: ভারতের কি এই মুহূর্তে এই জনসংখ্যার যে প্রাথমিক মৌলিক অধিকার – শিক্ষা, স্বাস্থ্য, উপার্জন – তা দেওয়ার পরিকাঠামো রয়েছে?
স্বাতী ঘোষ: পরিকাঠামো যেটুকু রয়েছে সেটুকুও ব্যবহার করা হচ্ছে না। কারণ এটা ভীষণই একপেশে। যাঁদের সেই সুযোগ আছে, যাঁদের সেই ‘অ্যাক্সেস’ আছে, যাঁরা সেগুলো পেয়ে থাকেন, শিক্ষা-স্বা্স্থ্য-পুষ্টি – বেসিক জায়গাগুলোর কথা বলছি আমি, বা ধরুন কাজ, চাকরি, আয় – এগুলো তাঁরা পেয়েই থাকেন। সেই অংশটার তুলনায় যে অংশটা পান না, যে অংশটা শুধুমাত্র সংখ্যা হিসাবে থেকে যান, পপুলেশন বৃদ্ধি করছেন এই এতবড় একটা ফিফার হিসাবে যাঁদের ‘ডিনোট’ করা হয় (দেখানো হয়), সেই অংশটার জন্য কি উপর থেকে শিক্ষা একটু দিলাম, স্বাস্থ্য একটু দিলাম – এরকম করা যায়? আমার প্রশ্ন এই নৈতিক জায়গাটা নিয়ে।
ভয়েস অফ আমেরিকা: ভারতের যে সুবিধাবঞ্চিত জনসংখ্যা তাঁদের কথা মাথায় রেখে কি কোনও জন্মনিয়ন্ত্রণ নীতি আসা দরকার?
স্বাতী ঘোষ: এই যে জন্মনিয়ন্ত্রণ – এই যে ‘নিয়ন্ত্রণ’ শব্দটা – এটা অত্যন্ত ব্যক্তিগত পরিসরে রাষ্ট্রের ঢুকে পড়া। এরকম একটা প্রয়াস আমরা আমাদের দেশে দেখেছিলাম, জরুরি অবস্থার সময়ে। সেই জায়গায় ব্যক্তির অধিকারের জায়গাগুলো, একটা দাম্পত্য জীবনে অধিকারের জায়গাগুলো, সেখানে রাষ্ট্রের কতটা ভূমিকা, আদৌ থাকা উচিত কি না – বিশেষ করে যদি নিয়ন্ত্রণের কথা আসে, তাহলে তো সেটা অত্যন্ত অন্যায় বলেই আমি মনে করি। এবং নিয়ন্ত্রণ করার ভাবনাটা আসে কোন জায়গা থেকে যে – ‘আমি জনসংখ্যা বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ করব, মানে আমার একটা নির্দিষ্ট সংখ্যক মানুষ চাই, যাঁরা দেশের অর্থনীতিতে কন্ট্রিবিউট করতে পারবেন।’ কীভাবে করবেন? হয় উৎপাদনশীল হয়ে উঠে, দেশের জন্য, সমাজের জন্য, বাজারের জন্য তাঁরা রয়েছেন অথবা উপভোক্তা হিসাবে তাঁরা তাঁদের ভূমিকা পালন করছেন। ফলে ‘নিয়ন্ত্রিত সংখ্যা হলে আমি তাঁদের সব দিকটাই দেখা যায় এবং তাঁদের অল্পবিস্তর নিশ্চয়ই শিক্ষা, স্বাস্থ্যও দিতে পারি, যতটা আমার সাধ্যে কুলোবে’ – এই যে দৃষ্টিভঙ্গি রাষ্ট্রের এটা আমার ব্যক্তিগতভাবে আপত্তিজনক মনে হয়।
ভয়েস অফ আমেরিকা: জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে জুড়ে যায় মহিলাদের প্রজনন স্বাস্থ্য ও তাঁদের অধিকারের জায়গাটিও। যদি নারী অধিকারের ও মহিলা স্বাস্থ্যের জায়্গা থেকে বিষয়টি দেখা হয়, তাহলে কী কোনও পদক্ষেপ জরুরী বা তাঁদের চাহিদাগুলি নিয়ে আলাদাভাবে কথা বলা উচিত বলে মনে করেন?
স্বাতী ঘোষ: এটা সানগ্রিকভাবে দেখলে ভালো হয়। এটা শুধু মহিলাদের প্রজনন স্বাস্থ্যর বিষয় নয়। এটা আরও বৃহত্তর ব্যাপার। কেন শুধুমাত্র মহিলাদেরই এই দায়িত্বটা নিতে হবে? কারণ একা মহিলারা তো সন্তানেত জন্ম দেন না, জন্ম দেন, কিন্তু সন্তান জন্মের প্রক্রিয়ায় তো শুধুমাত্র মহিলাদের বা তাঁদের রিপ্রোডাক্টিভ বডি-র ভূমিকা থাকে না।
ভয়েস অফ আমেরিকা: আপনার সঙ্গে একমত হয়েও বলা যায়, সেক্ষেত্রেও কারা মা হবেন, কীভাবে মা হবেন, কারা মা হবেন না, সন্তান জন্মের সময়ে বা পরে মা ও শিশুর স্বাস্থ্য – এগুলোও তো বিচার্য বিষয়।
স্বাতী ঘোষ: সবই ঠিক, এভাবেই হয়ে আসছে। আপনি যেটা বলছেন, সবটাই তাই। কিন্তু তার সবটাই কেন মায়ের উপর হয়? বাবা হওয়াটা, বা সেই সংখ্যাটাও তো বাবা হওয়ার ক্ষেত্রে উল্লিখিত হওয়া উচিত। সেটা উল্লিখিত হয় না। আমার মনে হয়, সেটা একতরফা হয়ে যায়। মায়ের স্বাস্থ্য গুরুত্বপূর্ণ, তাঁর অন্য স্বাস্থ্য সংক্রান্ত বিষয় গুরুত্বপূর্ণ নয়, শুধু প্রজনন স্বাস্থ্য গুরুত্বপূর্ণ এই ভাবনার সঙ্গে আমি সহমত নই। এটা একটা যৌথ দায়িত্বের মধ্যে পড়ে, যেটা যাঁরা একসঙ্গে থাকছেন, সন্তান জন্ম দেওয়ার কথা ভাবছেন, তাঁদের একেবারে ব্যক্তিগত জায়গা। রাষ্ট্র কতটা পর্যন্ত সেখানে ঢুকতে পারে বা পারে না, সেগুলো প্রশ্নসাপেক্ষ।